দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতায় থাকা লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) জন্য জনসমর্থন হারানোর পাশাপাশি জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এক উত্তাল পর্যায়ের সম্মুখীন হয়েছে। সমর্থন হ্রাসের নেপথ্যে থাকতে পারে বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, রাজনৈতিক দুর্নীতি, বার্ধক্যজনিত সমাজ ও সঙ্কুচিত শ্রমশক্তি। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল জনসাধারণের হতাশাকেই দর্শায়। সে সময়ে এলডিপি গত এক দশকের মধ্যে প্রথম বারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের অংশ হারায়, দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার জন্য ১১ নভেম্বর একটি বিশেষ ন্যাশনাল ডায়েট সেশনের প্ররোচনা দেয়। সাম্প্রতিক ভোটে শিগেরু ইশিবার মন্ত্রিসভার অনুমোদন ৩৪ শতাংশের মতো কমে যাওয়ার পাশাপাশি এলডিপি-র সমর্থনের হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ভোটের আগে পার্লামেন্টে সমর্থনের জন্য এলডিপি-কে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিপি) আদালতে পাঠানোর জন্য প্ররোচিত করেছে। লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং এর জোট অংশীদার কোমেইতো জাপানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বৃহত্তম ব্লক ধরে রাখলেও তারা ২০১২ সাল থেকে তাদের নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে এবং প্রাইম মিনিস্টার শিগেরু ইশিবা তাঁর নীতিগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট বিরোধী দলগুলির উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। এই ভঙ্গুরতা আরও স্পষ্ট হয়েছিল, যখন ইশিবার নিশ্চিতকরণ ভোট ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম বারের মতো রানঅফ নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়, যা ন্যাশনাল ডায়েটের প্রতি দুর্বল সমর্থনকেই দর্শায়। তা সত্ত্বেও, সর্বাধিক ভোটের দল হিসাবে জাপানের আইনপ্রণেতারা বিশেষ ডায়েট অধিবেশনে শিগেরু ইশিবাকে প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে পুনরায় নিশ্চিত করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতায় থাকা লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) জন্য জনসমর্থন হারানোর পাশাপাশি জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এক উত্তাল পর্যায়ের সম্মুখীন হয়েছে।
কেন ইশিবা তড়িঘড়ি নির্বাচনের ডাক দিলেন?
২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর স্ন্যাপ নির্বাচন করার জন্য ইশিবার সিদ্ধান্ত বিদ্যমান দলীয় আর্থিক কেলেঙ্কারি দ্বারা চালিত হয়েছিল, যার মধ্যে অপ্রতিবেদিত রাজনৈতিক তহবিল জড়িত ছিল এবং যা ইতিমধ্যেই এলডিপি-র সমর্থনকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আস্থার প্রতি আরও ক্ষয় এড়াতে ইশিবা তাঁর প্রশাসনিক নীতির বক্তৃতা ও দলীয় প্রতিনিধিদের প্রশ্নের জবাব-সহ আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতাগুলি পূরণ করার পরে অবিলম্বে ডায়েট নির্বাচন মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। প্রশাসনের ভাবমূর্তি আরও খারাপ হওয়ার আগে জনসাধারণের আস্থা অর্জনের উদ্দেশ্যে দ্রুত নির্বাচন করা হয়েছিল। কারণ এটি এলডিপি-র জন্য শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখাই নয়, আসন হারানোর বিষয়টি এড়ানোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসলে কেলেঙ্কারি নিয়ে দীর্ঘায়িত বিতর্ক আরও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ঘন ঘন নেতৃত্বের পরিবর্তন সত্ত্বেও এলডিপি এক দশক ধরে জাপানকে শাসন করেছে এবং কম ভোটার উপস্থিতি ও বিভক্ত বিরোধিতার কারণে আবার জয়ের জন্যই প্রস্তুত ছিল। জোট অংশীদার কোমেইতোর সমর্থন-সহ এলডিপি-র বিজয়ও তাই যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য কোমেইতোর উপর নির্ভর করার বিষয়টি দলটিকে এলডিপি-র নীতির উপর আরও প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়। কোমেইতো চিরাচরিত ভাবে এলডিপি-র কিছু কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রতিহত করেছে, যেমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অর্জন এবং অস্ত্র রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। এর ফলে এই সব কিছুই জাপানকে দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের দাবির বিরোধিতাকারী ইউক্রেন বা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে অস্ত্র পাঠাতে বাধা দিয়েছে।
সাধারণ নির্বাচন তাই প্রাইম মিনিস্টার ইশিবার জন্য একটি সমালোচনামূলক পরীক্ষাও ছিল। প্রধান বিরোধী দল কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ জাপান (সিডিপি) সবেমাত্র ইয়োশিহিকো নোদাকে তাদের নেতা হিসাবে বেছে নিয়েছিল এবং মনে করা হয়েছিল যে, তারা নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল না। কারণ জাপানি কমিউনিস্ট পার্টি (জেসিপি) শতাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। এটি বিরোধী ভোটকে বিভক্ত করে এবং সম্ভাব্য ভাবে এলডিপি-র জন্য আসন ক্ষতির সম্ভাবনাকেও হ্রাস করে। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জয় এলডিপি-র মধ্যে ইশিবার অবস্থানকে শক্তিশালী করে তোলার পাশাপাশি জনসমর্থনও বৃদ্ধি করতে পারত এবং পার্টির আর্থিক কেলেঙ্কারির ফল প্রশমিত করতে সাহায্য করত। পার্লামেন্টের অনেক এলডিপি সদস্য (এমপি) তাই রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দ্রুত স্থিতিশীল করতে আগাম নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন।
কোমেইতো চিরাচরিত ভাবে এলডিপি-র কিছু কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রতিহত করেছে, যেমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অর্জন এবং অস্ত্র রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। এর ফলে এই সব কিছুই জাপানকে দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের দাবির বিরোধিতাকারী ইউক্রেন বা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে অস্ত্র পাঠাতে বাধা দিয়েছে।
আগামী দিনের পথ
যাই হোক, প্রাইম মিনিস্টার ইশিবার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের জন্য প্রাথমিকভাবে অপ্রত্যাশিত ক্ষতির কারণে সাধারণ নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থতা জাপানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেছে। রাজনৈতিক তহবিল ঘিরে কেলেঙ্কারির মাঝেই ইশিবার ক্ষমতা সমন্বিতকরণের প্রয়াসের ফলে সৃষ্ট এই নির্বাচন আসলে সিডিপি এবং ডিপিপি-র মতো বিরোধী দলগুলির জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে। এলডিপি ও কোমেইতো নির্বাচনে সর্বাধিক আসন জিতলেও তাদের এখন আইন পাস করার জন্য ছোট বিরোধী দলগুলির উপর নির্ভর করতে হবে। এটি এমন একটি ক্ষীণ ও জটিল পথ, যার মধ্যে দিয়ে প্রশাসনকে এগিয়ে চলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এই নতুন গতিশীল প্রভাবেরও একটি পরিসীমা আছে। এটি আইন প্রণয়নের অগ্রগতিকে বাধা দিতে পারে; অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে নীতির ধারাবাহিকতাকেও প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে যখন জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক উত্তেজনার আলোকে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করতে চায়। নির্বাচনটি ব্যাঙ্ক অফ জাপানের বিদ্যমান আর্থিক কড়াকড়ি সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা উত্থাপন করে। কারণ যে কোনও রাজনৈতিক রদবদল জাপানের মুদ্রাস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে পরিকল্পিত আর্থিক নীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। উপরন্তু, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা জাপানের বাহ্যিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির উপর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রদের সঙ্গে, চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনাপ্রবাহ এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন জাপান পূর্ব চিন সাগর এবং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের দৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
ইশিবা দ্রুতই একটি নতুন মন্ত্রিসভা প্রবর্তন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। সেই মন্ত্রিসভায় কেইসুকে সুজুকিকে বিচারমন্ত্রী, তাকু ইতোকে কৃষিমন্ত্রী এবং কোমেইতোর হিরোমাসা নাকানোকে ভূমিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হবে। অন্যান্য পদ সম্ভবত ইশিবার আগের মন্ত্রিসভার সদস্যরাই ধরে রাখবেন। ইশিবার তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলায় একটি সম্পূরক বাজেট চূড়ান্ত করা। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিপি) থেকে সমর্থন প্রয়োজন, যার নেতা ইউচিরো তামাকিও ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারির সম্মুখীন হয়েছেন। বিরোধী দলগুলির মধ্যে মতবিরোধও রয়েছে, যা প্রধান বিষয়টি নিয়েই দ্বিধাবিভক্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প প্রার্থীকে কেন্দ্র করে সমাবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ইশিবার সামনে অবশ্যই একটি কঠিন রাস্তা রয়েছে। দলের আইনপ্রণেতারাও আগামী বসন্তের বাজেট প্রকাশ্যে আসার আগে প্রাইম মিনিস্টার ইশিবাকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন বলেও জানা গিয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা জাপানের বাহ্যিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির উপর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রদের সঙ্গে, চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পরের বছরটি আপার হাউস নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত। ক্ষমতাসীন জোটের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা আরও দুর্বল হতে পারে যদি না ইশিবা জনগণের আস্থা পুনঃনির্মাণ করতে পারেন। কারণ অর্থ কেলেঙ্কারি আখেরেই জনগণের আস্থা হ্রাস করেছে। এলডিপি মহাসচিব হিরোশি মরিয়ামা রাজনৈতিক তহবিল কেলেঙ্কারিতে দলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত সমালোচনার প্রসঙ্গ টেনে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, কঠোর ভাবে এটির মোকাবিলা করা হয়েছে। এর পাশাপাশিই তিনি উল্লেখ করেছেন, এলডিপি সেই জনসাধারণের কাছে এই কথা জানাতে রীতিমতো যুঝছে, যারা সমস্যাটিকে ‘স্লাশ ফান্ড’ এবং ‘কর ফাঁকি’র সঙ্গে জড়িত বলে মনে করে। ইশিবা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানের পূর্ববর্তী বৈদেশিক এবং নিরাপত্তা নীতিগুলি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যাই হোক, সরকারকে স্থিতিশীল করতে, অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মাঝে পথ খুঁজে নিতে এবং রাজনৈতিক ভাবে খণ্ডিত ডায়েটের মাঝেই একটি সুসঙ্গত নীতি কাঠামো তৈরি করতে অভ্যন্তরীণ ভাবে জাপানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ক্ষমতাসীন জোট বা নতুন কোনও জোটের ক্ষমতার উপরেই নির্ভর করবে।
প্রত্নশ্রী বসু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.