Published on Aug 15, 2021 Updated 0 Hours ago

আগেকার মতোই এখনও সত্যিকারের যে ঘটনাটির রিপোর্টিং করা হচ্ছে, তার থেকে বেশী তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এইসব ঘটনার সংশ্লিষ্ট ছবি, এবং তার মাধ্যমে চালানো প্রচার বা প্রোপাগান্ডা।

শুধুই মরুভূমি?‌ ভারতে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার নেতিবাচক রিপোর্টে প্রাচ্যের প্রতি গভীর বিদ্বেষ স্পষ্ট

এই নিবন্ধটি লেখকদের ‘‌রিভিজিটিংওরিয়েন্টালিজম:‌ প্যানডেমিক, পলিটিক্স, অ্যান্ড দ্য পারসেপশনস ইন্ডাস্ট্রিজ’‌ শীর্ষক প্রবন্ধের ধারাবাহিক লিখন।


লর্ড বায়রনের ‘‌চাইল্ড হ্যারল্ড’‌স পিলগ্রিমেজ’‌ (‌১৮১২)‌ কবিতায় নায়ক হ্যারল্ড কলোসিয়াম–এর বিশালত্বের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কল্পনা করেছিলেন এক গ্ল্যাডিয়েটরের কথা যিনি আত্মমর্যাদা সম্পপন্ন হয়েও ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। যাকে, এক রবিবার, ছুটির দিনে কলোসিয়ামে সমবেত জনগণের সামনে রক্তপিপাসু রোমানদের বিনোদনের বলি হতে হয়েছিল।

জনগণের সামনে কাউকে যন্ত্রনা দেওয়া হল ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই যন্ত্রণার বিকৃত ছবি একদিকে যেমন জাতিগত আধিপত্য এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বার্তা বহন করে তেমনই সমাজের নিচের তলার মানুষদের ভীতির কারণও হয়ে ওঠে। এইসবেরই কেন্দ্রে থাকে আসলে নিজের ‌সম্পর্কে এক মহান ধারণা।

এ প্রসঙ্গে জন পোর্টম্যানের বহু চর্চিত ‘‌হোয়েন ব্যাড থিংস হাপ্পেনস টু আদার পিপল’ নামক বইটি উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে লেখক বলছেন, ‘‌অন্যের’‌ যন্ত্রণা থেকে তৃপ্তি পাওয়ার ঘটনা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়, বিশেষ করে যখন একটা বিশেষ জনগোষ্ঠী মনে করে যে ‘‌অন্য’‌রা এই যন্ত্রণা বা অবমাননার যোগ্য, তখন সেই বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে অন্যকে এই যন্ত্রণা দেওয়াটাই হয়ে ওঠে প্রকৃত এবং কল্পিত অপরাধের সঠিক বিচার। আর যন্ত্রণা দেওয়ার মধ্যে দিয়েই সেই সব অপরাধের যোগ্য শাস্তি হয়েছে এমন ধারণা থেকে তৈরি হয় এক আত্মতৃপ্তির অনুভূতি।

ভারত কোভিড–১৯–এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করছে। কোনো শ্রেণী বা অন্য বৈষম্যের কথা না ভেবে, তাই দেশ এখন মৃত্যুর সঙ্গে দৃঢ় ভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে ব্যস্ত। ভারতে যা কিছু ঘটছে তার খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং সারা বিশ্বে এ নিয়ে উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। গণচিতা এবং মৃত্যু মুখে পতিত মানুষের সর্বনাশের বার্তাবহ ছবিগুলি ট্রান্স–অ্যাটলান্টিক সংবাদমাধ্যমে প্রথম পাতার খবর হচ্ছে, চলে আসছে টেলিভিশনের প্রাইম টাইমে। এহেন মর্মান্তিক চিত্র যে শুধু মানুষের দুর্দশার কথা বলছে তা নয় একই সঙ্গে অদক্ষতা, পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া লোভী এবং দায়সারা মনোভাবের নানা কাহিনীর প্রসঙ্গকেও সামনে এনে দিছে। উপরন্তু, বিগত তিন শতাব্দী ধরে প্রাচ্যের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে যা চিহ্নিত করেছে, সেই অযোগ্যতার স্টিরিওটাইপ ধারণা আবার সামনে উঠে আসছে। নিজেদের অদক্ষতার কারণেই যে যন্ত্রণার ছবিগুলি দেখানো হছে তা আসলে যেন অদক্ষতারই ‘ন্যায্য ক্ষতিপূরণ’‌ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নতিতে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এখন যা স্থানীয়, তার প্রভাব পড়ছে বিশ্বজুড়ে। ভারত যেভাবে কোভিডের নতুন ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে চলেছে তার ছবি এবং ভিডিও ক্লিপও তাই ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে, আর তা আরও বহু গুণ বিস্তৃত করছে সামাজিক মাধ্যম গুলি। মর্মস্পর্শী ছবি আর মুন্সিয়ানার সঙ্গে বলা সব গল্পগুলি সোজাসুজি ঢুকে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষের ড্রয়িংরুমে। এইভাবেই, আজ সারা দুনিয়ার মানুষ এক দেশের জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক কাহিনীর শরিক হচ্ছেন।

বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তি অনেক অগ্রসর হয়েছে। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এখন যা স্থানীয়, তার প্রভাব পড়ে বিশ্বজুড়ে। ভারত যেভাবে কোভিডের নতুন ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে চলেছে তার ছবি এবং ভিডিও ক্লিপও তাই ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে, আর তা আরও বহু গুণ বিস্তৃত করছে সামাজিক মাধ্যম গুলি।

কিন্তু ঘটনা হল, যেভাবে ভারতের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তার সঙ্গে নিজেদের দেশের অতিমারী জনিত সংকটের রিপোর্টিংয়ের একটা বিশাল ফারাক থেকে যাচ্ছে। নিজেদের দেশের কথা বলা হচ্ছে অনেক বেশি সহমর্মিতার সঙ্গে, দাবি করা হচ্ছে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার। আর সেই সঙ্গে সেখানে একঘেয়ে জাতীয়তাবাদের ধারণা সাংবাদিকদের রিপোর্টিং–এর পরিসর বেঁধে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে, তাঁরা যখন ভারত সম্পর্কে বেদনাময় কাহিনী তুলে ধরছেন, তখন যে ছবিটা সবার সামনে আসছে তার মধ্যে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের এলিটদের দ্বিচারিতা প্রতিফলিত হচ্ছে, আর স্পষ্ট হচ্ছে দূরের ‘‌অন্য’‌ মানুষদের সম্পর্কে তাঁদের হীন মনোভাব। এই বিষয়টা অবশ্য নিকটবর্তী ‘‌অন্য’ ‌দের অভিজ্ঞতার থেকে খুব একটা পৃথক নয়। এই কাছের ‘‌অন্য’‌রা হলেন তাঁদের দেশের তলার শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা ভৌগোলিক এবং আবেগ গত ভাবে প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করলেও সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক ভাবে শ্রেণী, বর্ণ বা সংস্কৃতিগত বৈষম্যের কারণে প্রান্তিক।

ফিলিপ ড্রে তার বই ‘‌অ্যাট দ্য হ্যান্ডস অফ পার্সন্‌স আননোন:‌ দ্য লিঞ্চিং অফ ব্ল্যাক আমেরিকা’‌-তে অবৈধকরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি এও আলোচনা করেন যে কীভাবে কালো মানুষদের গণপ্রহারে মৃত্যু দেখতে পুরো পরিবার বেরিয়ে আসে তাদের রবিবারের সেরা পোশাক পরে। তিনি লিখেছেন এই দৃশ্য গুলো অনেকটা ইযেন উৎসব, সামাজিক হইচইতে ভরা গ্রামের মেলার মত;‌ সেখানে পরিবেশিত ‌খাদ্য-পানীয়ের মতো; আর তাই সেখানকার স্মারক ছবি এবং বীভৎস স্যুভেনির হিসেবে যে অসহায় মানুষকে হত্যা করা হল কখনও কখনও তাঁর শরীরের অংশ নিয়ে যাওয়া হতো। এ প্রসঙ্গে হাওয়ার্ড স্মিট ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে অধিকাংশ সময় এই ঘটনার শিকার হতেন যাঁরা, তাঁরা কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্তই নন। এগুলো একটা “প্রতীকী বিধি যেখানে ওই কালো মানুষটি তাঁর জাতির প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেন, এবং অনেক অপরাধের সাজা পাচ্ছেন… যে ভী‌ড় সমবেত হয় ওই যন্ত্রণা দেখতে তা কালো মানুষদের সাংঘাতিক ভাবে সচেতন করে বলে যে তাঁরা যেন শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ না করেন।” ঠিক যেমন কলোসিয়াম-এর বিরাট প্রান্তরে গ্ল্যাডিয়েটরের ভয়ঙ্কর মৃত্যু ছুটিরদিনে হিংস্র রোমানদের রোমাঞ্চিত করত, ঠিক তেমনই প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন কালো মানুষের উপর অত্যাচার, তাঁদের পেট ফাঁসিয়ে দেওয়া বা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, তাঁদের মৃত্যু যন্ত্রনার দৃশ্য শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের রক্ত পিপাসা চরিতার্থ করত।

এইভাবে গণপ্রহারে হত্যার জমানা অনেক দিন হল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যে মনোভাব প্রকাশিত হত তা আজও থেকে গেছে। যেভাবে শ্বেতাঙ্গ অফিসারেরা জর্জ ফ্লয়েড বা অন্য কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের হত্যা করেন, তা জাতিগত সম্পর্কের মধ্যে যে বিরাট ফাটল রয়েছে — তারই পরিচায়ক।

আগেকার মতোই এখনও সত্যিকারের যে ঘটনাটির রিপোর্টিং করা হচ্ছে, তার থেকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এইসব ঘটনার সংশ্লিষ্ট ছবি, এবং তার মাধ্যমে চালানো প্রচার বা প্রোপাগান্ডা। এর মধ্যে দিয়ে যে লক্ষ্য সাধিত হয় তা হলো শ্রোতা বা দর্শকদের মনকে এমন ভাবে চালনা করা যাতে তাঁরা একটা বিশেষ ভাবে ভাবতে বা কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন। এই যে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কাতর ভারতের একটা নীরব এবং বিকৃত ছবি তুলে ধরা হলো, তার মধ্যে একটা বিশেষ বার্তা নিহিত আছে। তাহল:‌ এই ভাইরাস তোমাদের নিজেদের স্থান কোথায় তা দেখিয়ে দিয়েছে, তোমরা কীভাবে ‘সুসভ্য পশ্চিমের’‌ থেকে ভালোভাবে অতিমারীর মোকাবিলা করার স্বপ্ন দেখতে পারো?

রঘু রাই বলেছেন, বিশেষ করে পশ্চিমী চিত্র সাংবাদিকদের উৎসাহিত করা হতো আন্তর্জাতিক জুরিদের কাছে বিশেষ আবেদন রাখবে এমন প্ররোচনামূলক ছবি ভারতে খুঁজে বেড়াতে। এলিটের দৃষ্টিতে দেখা বঞ্চনা ও হতাশার হৃদয় বিদারক কাহিনী অনেক সময় এর পেছনে থাকা তাৎক্ষণিক খ্যাতি ও লাগামহীন কেরিয়ার তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছবিটা ঢেকে রাখে। পুরস্কার জয়ী ইতালীয় চিত্র সাংবাদিক আলেসিও মামোর ‘ড্রিমিং ফুড’‌ ফটো সিরিজের জন্য মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের গ্রামের গরীব, ক্ষুধার্ত শিশুদের সামনে ‌টেবিলে রাখা হতো চমৎকার ছবি উঠবে এমন নকল খাবার, আর সেই শিশুদের বলা হত ওই টেবিলে তারা কী খাবার দেখতে চায় তা চোখ বুঝে কল্পনা করতে। এখন যে কালো মানুষের যন্ত্রণার বিস্তারিত ছবি টিভিতে দেখানো হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে, তার সঙ্গে কিন্তু সেই উত্তেজিত স্যুভেনির-সন্ধানী খুনি জনতার বিনোদনের বেশ মিল রয়েছে। আর এর বিপরীতে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ মানুষের অলঙ্ঘনীয় মর্যাদার অধিকার। এসব থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে জাতিগত ফাটল এখনও শুধু প্রকৃত বাস্তবতা নয়, জাতিগত স্টিরিওটাইপ-গুলো এখনও মানুষের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করে।

কাছের ‘অন্য’‌ মানুষদের প্রান্তিকীকরণ অবশ্য শুধু পশ্চিমী দুনিয়ার একতরফা নয়। বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের এলিট সম্প্রদায়ও তাদের নিজেদের দেশে এই বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের পটভূমি তৈরি করেছে। তাঁরা যখন তাঁদের বিরাট ঝকঝকে গাড়ি বা চীন দেশে নির্মিত দ্রুতগামী ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তখন যেসব দরিদ্র অঞ্চলের মধ্যেদিয়ে তাঁরা যান সেখানকার হতাশার ছবিটা সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসীন থাকেন। প্রান্তিক মানুষরা কখনই ওই ক্ষমতার অলিন্দে বা নীতি নির্ধারণের কেন্দ্রে জায়গা পান না। ওই জায়গা গুলো এলিটদের কুক্ষিগত। এই অতিমারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিদ্বেষের ছবি আরও স্পষ্ট করেছে, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান এবং শ্রেণীগত ও জাতিগত বিভেদ বাড়িয়েছে। গরীব মানুষেরা এবং প্রান্তিক মানুষেরা এই অস্থির সময় সব চেয়ে বেশি ভুগেছেন, কাজ হারিয়েছেন, এবং ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগও পাননি। এলিট সমাজ কিন্তু তাঁদের সম্পদ ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সব রকম চেষ্টা করেছে। এমনকি নিজেদের পছন্দ মতো ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য তাঁরা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও পৌঁছে গিয়েছেন।

প্রান্তিক মানুষরা কখনই ওই ক্ষমতার অলিন্দে বা নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে জায়গা পান না। ওই জায়গা গুলো এলিটদের কুক্ষিগত। এই অতিমারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিদ্বেষের ছবি আরও স্পষ্ট করেছেধনীদরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান এবং শ্রেণীগত ও জাতিগত বিভেদ বাড়িয়েছে। গরীব মানুষেরা এবং প্রান্তিক মানুষেরা এই অস্থির সময় সব চেয়ে বেশি ভুগেছেনকাজ হারিয়েছেনএবং ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগও পাননি। এলিট সমাজ কিন্তু তাদের সম্পদ ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সব রকম চেষ্টা করেছে। এমনকি নিজেদের পছন্দ মতো ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য তাঁরা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও পৌঁছে গিয়েছেন।

ভারতের জাতীয় চেতনার সংজ্ঞা কিন্তু তার প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দিয়েই নিরূপিত হয়, যা কিনা তার সমন্বয়শীল সামাজিক কাঠামো, কার্যকরী সংবাদমাধ্যম, সচেতন মানুষ এবং প্রাণবন্ত রাজনীতির পারষ্পরিক সম্পর্কের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। ভারতীয় বলতে যে একক ছবিটি উঠে আসে তা শত শত, বা হয়তো হাজার হাজার, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় পরিচিতির প্রতিভূ। যা আঞ্চলিক পরিচিতিকে দমিয়ে রাখেনা। এভাবেই ভারত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের এক বিশেষ উদাহরণ। এই ছবিটি আধুনিক জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাষ্ট্রের যুগে একটি অনন্য নজির দাবি করে। এই অদম্য মানসিক শক্তিই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করেছে সঙ্কটের সময় এগিয়ে আসতে, আর তার ফলে ভারতে অতিমারীর প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যরা যেখানে শুধু সরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল থেকেছে ভারতের কাহিনীটা সেখানে বেশ খানিকটা স্বতন্ত্র।

যেভাবে এ দেশে সেবা ও আত্মত্যাগের নানা কাহিনী শোনা গিয়েছে, যেভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্তব্য করতে গিয়ে নিজেদের জীবন দিয়েছেন, যেভাবে সাধারণ মানুষ অসমর্থদের সাহায্য করতে সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়েছেন, যেভাবে প্রতিবেশীরা বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন নিজ আঞ্চলের মানুষের উপর নজর রাখতে, যেভাবে যুবক-যুবতীরা অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, যেভাবে সাধারণ পুলিশ কর্মীরা হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষারত মানুষকে সাহায্য করেছেন, অথবা স্মার্টফোন হাতে থাকা যে কোনও একজন ভারতীয় যেভাবে একটা-না-একটা সামাজিক মাধ্যমের কোভিড সাপোর্টগ্রুপের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন, সেগুলোই ভারতের প্রকৃত কাহিনী। সেই কাহিনীও বলা প্রয়োজন ছিল, যদিও তা উন্নতশীল পৃথিবীর ছকে-বাঁধা গভীর হতাশার সেই সব গল্প বলে না যা শ্রোতাদের বা পাঠকদের সুড়সুড়ি দিতে পারে। এই কাহিনীগুলো হল আশা এবং ফের মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য লড়াই এর কাহিনী, মানুষের অলঙ্ঘনীয় বাধা পেরিয়ে আসার কাহিনী, যার মূলে আছে মানুষের অদম্য মনোভাব। রাষ্ট্র এই ভাইরাসের ভয়ঙ্কর প্রকোপের সামনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল;‌ আর তার ক্ষমতা যে কত সীমিত তা একেবারে প্রত্যক্ষে চলে এসেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের জায়গা নিতে যেভাবে সমাজ এগিয়ে এসেছিল, সেই গল্প বহু যুগ ধরে বলা হবে। বলা হবে কী ভাবে মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন এবং সেই অন্ধকার দিনে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজকের সেই গল্প গুলো আগামী প্রজন্মের জন্য প্রবাদ হয়ে থাকবে। কিন্তু তার পরিবর্তে পশ্চিমে যা প্রকাশিত হল তা হচ্ছে সম্পাদকীয় সংস্কার প্রসূত বিবরণ, স্টিরিওটাইপের পুনরাবৃত্তি এবং ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা থেকে বিযুক্ত দর্শকদের এরসঙ্গে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এভাবে ভারতের অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনীর গুরুত্বই শুধু কমিয়ে দেওয়া হল না, বিভেদের অস্ত্রে শানও দেওয়াও হল।

পশ্চিমে যা প্রকাশিত হল তা হচ্ছে সম্পাদকীয় সংস্কার প্রসূত বিবরণস্টিরিওটাইপের পুনরাবৃত্তি এবং ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা থেকে বিযুক্ত দর্শকদের এরসঙ্গে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এভাবে ভারতের আতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনীর গুরুত্বই শুধু কমিয়ে দেওয়া হল নাবিভেদের অস্ত্রে শানও দেওয়াও হল।

“অন্যদের যন্ত্রণা পেতে দেখলে কারুর আনন্দ হয়, আর তাদের যন্ত্রণা দিতে পারলে আরো ভালো লাগে (…) নিষ্ঠূরতা ছাড়া আসলে কোনো উৎসব হয় না,” বলেছিলেন নিৎসে। বর্তমানে পাঠকের ধরন ধারণ বদলে গিয়েছে এ বিষয়ে আমেদের খেয়াল রাখতে হবে। আর সেই সঙ্গে হিংসা ও সংঘর্ষের ঘটনার সামনে সারাদিন বসে থাকার কারণে দর্শকদের মধ্যে যে মানসিক আবসাদ তৈরি হছে, তা এক বিষাক্ত বৃত্তের মধ্যে সবাইকে টেনে নিয়ে যাছে। তখন মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ক্রমাগত যন্ত্রণা কে আরও নাটকীয় মাত্রা দিয়ে দেখান হছে। যারা দূরের ‘অন্য,’‌ তাদের কষ্টের কাহিনীকে বিকৃত ‌করা হছে;‌ এই কাহিনী গুলো আর সত্যিকারের অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায় আনেক ফারাক। এক পেশে মনোভাব দিয়ে, আগাম সবকিছু ধরে নেওয়া এবং নানা ধরনের স্টিরিওটাইপ দিয়ে দূরের ‘অন্য’‌ দের বিষয়ে ‌তথ্য সরবরাহ করার প্রয়াস আদতে প্রকৃত ঘটনাকে নাটকীয় মোড়ক দেওয়ার এক আদর্শ কাঠামো তৈরি করে। পুরো মাস ধরে ভারতের পরিস্থিতির কভারেজ যেভাবে করা হয়েছে, তা ছিল অসংবেদনশীল এবং বাণিজ্যিক বিনোদনের এক মিনি সিরিজ, যার সঙ্গে তুলনীয় শুধু অতীতের গণপ্রহারে মানুষকে মেরে ফেলার রবিবাসরীয় কাহিনী।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Samir Saran

Samir Saran

Samir Saran is the President of the Observer Research Foundation (ORF), India’s premier think tank, headquartered in New Delhi with affiliates in North America and ...

Read More +
Jaibal Naduvath

Jaibal Naduvath

Jaibal is Vice President and Senior Fellow of the Observer Research Foundation (ORF), India’s premier think tank. His research focuses on issues of cross cultural ...

Read More +