সিরিয়ার প্রাক্তন শাসক বাশার আল-আসাদ পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন এবং ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। ২০১৫ সালে যখন আসাদের বাহিনী প্রায় পতনের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন মস্কো হস্তক্ষেপ করে এবং সিরিয়ান ও ইরান-সমর্থিত বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ বিমান সহায়তা করার মাধ্যমে দেশটির উপর আসাদের দখলকে পুনঃসংহত করতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল বিদেশে রাশিয়ার প্রথম সামরিক হস্তক্ষেপ। যাই হোক, ২০২০ সাল থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে অন্যান্য উপদলের সঙ্গে নিজের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসাদের অনীহা, কোভিড-পরবর্তী সিরিয়ার অর্থনীতির ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া এবং ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে উত্তর সিরিয়ায় একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প দেশটির মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের জন্ম দেয়। ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া তার ইউক্রেনীয় প্রচারে মনোনিবেশ করায় এবং হিজবুল্লাহ গত বছর থেকে ইজরায়েলের মোকাবিলা করার বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়ার পরিস্থিতি তীব্রতর হয়েছিল, যা সরকারি বাহিনীর মনোবলকে আরও প্রভাবিত করেছিল। এই সমস্ত কারণের দরুনই আসাদের দখল ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে, যার ফলে তুর্কিয়ে-সমর্থিত হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) যথেষ্ট আঞ্চলিক গুরুত্ব লাভ করে এবং ক্রমান্বয়ে আলেপ্পো, হামা ও হোমস দখল করে নেয়। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনী দামাস্কাসও ঘিরে ফেলে। তার পর ৮ ডিসেম্বর আসাদ তাঁর ২৪ বছরের সুদীর্ঘ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মস্কোয় পালিয়ে যান। এই সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের দরুন রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে এবং মস্কো এই অঞ্চলে তার নিজের স্বার্থ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এ বার এইচটিএস-এর সঙ্গে হাত মেলাতে ব্রতী হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা
আসাদ সরকারের প্রতি রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি আসাদের ক্ষমতায় থাকার শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহতই ছিল এবং রাশিয়ান বাহিনী খমেইমিমে সন্ত্রাসবাদী অগ্রগতি ব্যর্থ করতে শাসক বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করেছে। যাই হোক, ৮ ডিসেম্বরের পরে মস্কোর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। মস্কোয় সিরিয়ার দূতাবাসে একটি নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিদ্রোহীদের একটি ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী’র পরিবর্তে ‘সশস্ত্র বিরোধী’ হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করেছে। সর্বোপরি, রুশ কর্মকর্তারা এইচটিএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছিলেন, যা দেশে রুশ সামরিক ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। আমিরাতি সংবাদপত্র দ্য ন্যাশনালের মতে, রাশিয়া ও নতুন সিরিয়ান প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে নতুন প্রশাসনের যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক রয়েছে। তাই আসাদের প্রত্যর্পণের জন্য রাশিয়ার কাছে কোনও উস্কানি বা দাবি জানানো হয়নি।
আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সিরিয়ায় মস্কোর কার্যক্রমেও পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বার্ষিক প্রত্যক্ষ সংযোগে বলেছেন যে, খমেইমিমে রুশ বিমান ঘাঁটি - যা আগে বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিতে হামলা চালানোর জন্য ব্যবহৃত হত – এ বার থেকে মানবিক সহায়তা সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। পুতিন আরও বলেছিলেন যে, আসাদ প্রশাসনের পতন ক্রেমলিনের জন্য পরাজয় ছিল না। কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের লক্ষ্য ছিল সিরিয়াকে একটি সন্ত্রাসবাদী আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করা। এর পাশাপাশি পুতিন সিরিয়ার ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ার জন্য ইজরায়েলের নিন্দাও করেন।
৮ ডিসেম্বর থেকে সিরিয়া সম্পর্কে ক্রেমলিনের অবস্থান আরও নমনীয় হয়ে উঠেছে এবং রাশিয়া দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এ হেন সকল গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও এ বার রাশিয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ এইচটিএস-এর আরও অংশীদার প্রয়োজন এবং নতুন সরকারকে মস্কোর সমর্থন তাদের আসলে আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদান করতে পারে। এইচটিএস-এর সমীকরণে মস্কো ওয়াশিংটনের তুলনায় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওয়াশিংটন উত্তর সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহী ও উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করে। সর্বোপরি রাশিয়ার সন্ত্রাসবাদী তালিকা থেকে এইচটিএস-এর সম্ভাব্য অপসারণ নতুন সরকারকে আরও আনুষ্ঠানিক মিথস্ক্রিয়া করার বৈধতা দেয়।
তদানীন্তন ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস-এর (ইউএসএসআর) পতনের পর মস্কোর প্রথম হস্তক্ষেপ রাশিয়ার জন্য শুধু মাত্র উপস্থিতি বৃদ্ধির সুযোগই প্রদান করেনি, বরং একই সঙ্গে এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক ভারসাম্যরক্ষাকারীর ভূমিকা প্রদান করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সফল করে তুলেছে।
সম্প্রতি, রাশিয়ার আপার হাউস বা উচ্চকক্ষ ফেডারেশন কাউন্সিল এমন এক প্রক্রিয়া অনুমোদন করেছে, যেখানে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞাকে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সংশোধিত আইনটি আদালতের সিদ্ধান্তের দ্বারা নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার শর্ত দিয়েছে এবং পরিবর্তে সেটি রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রসিকিউটর জেনারেল বা তার ডেপুটি জেনারেলের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গৃহীত হবে। ক্রেমলিন এ কথাও সুনির্দিষ্ট করেছে যে, এমনটা করার উদ্দেশ্য হল তালিবান ও রাশিয়ার মধ্যে আইনি সম্পৃক্ততা সুনিশ্চিত করা এবং সে ক্ষেত্রে এইচটিএস-এর কোনও উল্লেখ নেই। যাই হোক, সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি রাশিয়ার চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রধান রমজান কাদিরভের তরফে সন্ত্রাসবাদের তালিকা থেকে এইচটিএস-কে অপসারণ করার অনুরোধের প্রতি রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া থেকে মনে করা হচ্ছে যে, এইচটিএস প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ করতে পারলে রাশিয়া সম্ভবত দলটিকে সন্ত্রাসবাদী তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে।
পশ্চিম এশিয়ার এক প্রধান বাহ্যিক ভারসাম্যরক্ষাকারী
আসাদের অনুরোধে মস্কো ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইসলামিক স্টেট ও বাথ পার্টির বিরোধী বাহিনীকে ব্যর্থ করতে হস্তক্ষেপ করেছিল। মস্কো সিরিয়া ও ইরান-সমর্থিত স্থলবাহিনীকে বিমান সহায়তা প্রদান করে, যা গৃহযুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে এবং আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল। তদানীন্তন ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস-এর (ইউএসএসআর) পতনের পর মস্কোর প্রথম হস্তক্ষেপ রাশিয়ার জন্য শুধু মাত্র উপস্থিতি বৃদ্ধির সুযোগই প্রদান করেনি, বরং একই সঙ্গে এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক ভারসাম্যরক্ষাকারীর ভূমিকা প্রদান করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সফল করে তুলেছে। ২০১৭ সালে রাশিয়া ও সিরিয়া একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা রাশিয়াকে তারতুস নৌ ঘাঁটিতে মস্কোর ইজারা ৪৯ বছরের জন্য বাড়ানোর অনুমতি দেয় এবং তারা একই সময়কাল ব্যাপী খমেইমিম বিমানঘাঁটি ইজারা দেওয়ার বিষয়ে আর একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই ঘাঁটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক হাব ছিল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব দর্শাতে ব্যবহৃত হয়েছিল। কারণ সিরিয়া ছিল আফ্রিকায় মস্কোর প্রবেশদ্বার। উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে মস্কো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী। তুর্কিয়ে এবং ইরানের সঙ্গে আলোচনায় রাশিয়া যথেষ্ট সুবিধা অর্জন করেছে। রাশিয়া আস্তানা প্রক্রিয়ায় একটি আসনের বিনিময়ে আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল সিরিয়ায় সংঘাতের অবসান ঘটানো এবং তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্তে একটি বাফার জোন তৈরি করা।
এ কথা প্রত্যাশিত যে, সিরিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন এইচটিএস সরকার ও অন্য অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার মনোভাব নমনীয় করবে, যেমনটা তালিবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে।
পশ্চিম এশিয়ায় ইউক্রেন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
যাই হোক, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়ার উপর রাশিয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং বাণিজ্যপথের পুনর্বিন্যাসের জন্য তুর্কিয়ের উপর মস্কোর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। ইউক্রেন গ্যাস ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হতে চলেছে এবং তুর্কস্ট্রিম পাইপলাইনটি রাশিয়ান পাইপলাইন গ্যাস ইউরোপে স্থানান্তর করার একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা। আলোচনায় দর কষাকষির ক্ষেত্রে আঙ্কারা ভাল অবস্থানে রয়েছে, যা তুর্কিয়েকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। উপরন্তু, সিরিয়ায় রুশ সেনাদের উপস্থিতি হ্রাস পেয়েছে এবং সেই সেনাকে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে। ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ গত অক্টোবর মাস থেকে ইজরায়েলের মোকাবিলা করতে শুরু করেছে, যার ফলে বিদ্রোহী দলগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে তুর্কিয়ে এবং ইজরায়েলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ মস্কোর প্রভাব তুলনামূলক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তুর্কিয়ে ও ইজরায়েলের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক ২০১৫-পূর্ববর্তী সমীকরণে ফেরত যেতে পারে।
আগামিদিনের পথ?
রাশিয়া সিরিয়ায় তার নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে কিছুটা সমর্থ হলেও আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যে মস্কোর আপেক্ষিক শক্তির পতনকেই দর্শায়। সুতরাং, এমনটাও সম্ভব যে, স্বল্প মেয়াদে রাশিয়া অতীতের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে না। ফলে এ কথা প্রত্যাশিত যে, সিরিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন এইচটিএস সরকার ও অন্য অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার মনোভাব নমনীয় করবে, যেমনটা তালিবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। একই সঙ্গে এই গোষ্ঠীগুলিকে সন্ত্রাসবাদী তালিকা থেকেও অপসারণ করা হতে পারে এবং সংঘাত-পরবর্তী সঙ্কল্প প্রক্রিয়ায় রাশিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারে, যা সিরিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠন করবে। তবুও সব শেষে এ কথা বলা যায়, দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য কৌশল সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কী ভাবে বিকশিত হয়, তার উপরই নির্ভর করবে।
রাজোলি সিদ্ধার্থ জয়প্রকাশ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.