Published on Aug 01, 2023 Updated 0 Hours ago

আন্তর্জাতিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং ভূ-রাজনৈতিক চাপ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা্র সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারকে রূপ দান করছে

সামরিক বাহিনীতে দায়িত্বশীল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সর ব্যবহার: আকাশ কুসুম কল্পনা না কি স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষা?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যে দুরন্ত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, তা আমাদের জীবন, রাজনীতি, সম্প্রদায় এবং কাজের উপর এআই-এর রূপান্তরমূলক প্রভাবের তাত্ত্বিক অনুমানকে একটি স্পষ্ট বাস্তবতায় পরিণত করেছে। এআই-এর প্রভাবগুলি আর দূরবর্তী সম্ভাবনা নয়, বরং একটি বাস্তব ও দ্রুত উদ্ভাসিত ঘটনা, যা আমাদের জরুরি মনোযোগের দাবি রাখে।

প্রথমত, দায়িত্বশীল এআই বলতে আমরা কী বুঝি, তার একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এর একাধিক সংজ্ঞা বিদ্যমান থাকলেও দায়িত্বশীল বা দায়বদ্ধ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ রেসপন্সিবল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (আরএআই) হল এআই ব্যবস্থারই বিকাশ, পরীক্ষা এবং স্থাপনের এমন এক পদ্ধতি, যা নৈতিকতা ও আইনি মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে এআই-কে কল্যাণের উদ্দেশ্যে একটি শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়।

সামরিক বাহিনীতে এআই-এর ব্যবহার কোনও ভাবেই নতুন নয়। কিন্তু এআই ক্ষমতার দ্রুত সম্প্রসারিত দিগন্ত এমন অভূতপূর্ব সুযোগের  পরিসর উন্মোচন করেছে, যা আধুনিক যুদ্ধের পটভূমিকে নতুন আকার দান করছে এবং এর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের ধারণার পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করছে। দেশগুলি তাদের বুদ্ধিমত্তা, নজরদারি এবং পুনর্জাগরণ অর্থাৎ ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেলেন্স অ্যান্ড রিকনাসাঁস (আইএসআর), সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ওয়ার-গেমিং, লজিস্টিকস, কর্মী ব্যবস্থাপনা ও অস্ত্রশস্ত্রে এআই, রোবোটিক্স ও অন্য উদীয়মান প্রযুক্তিগুলিকে সমন্বিত করার জন্য কৌশল প্রণয়নের পথে হাঁটছে।

সারণি ১: নির্বাচিত এআই প্রতিরক্ষা কৌশল, শ্বেত পত্র এবং প্রতিবেদন

দেশ কৌশল/প্রতিবেদন বছর
ইউনাইটেড স্টেটস (ইউএস) ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স এআই স্ট্র্যাটেজি ২০১৮
ভারত মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স এআই টাস্কফোর্স রিপোর্ট ২০১৮/২০১৯ সালে অনুমোদিত
চিন ডিফেন্স হোয়াইট পেপার ২০১৯
ফ্রান্স এআই ইন সাপোর্ট অব ডিফেন্স ২০১৯
ইউনাইটেড কিংডম (ইউকে) ডিফেন্স এআই স্ট্র্যাটেজি ২০২২
ইজরায়েল এআই স্ট্র্যাটেজি ফর দি আর্মড ফোর্সেস ২০২২

ভারতে মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স এআই টাস্কফোর্স ২০১৮ সালে গঠিত হয়েছিল এবং ওই একই বছরে তার প্রতিবেদন (যা সর্বজনীন ভাবে উপলব্ধ নয়) উপস্থাপন করেছিল। ২০১৯ সালে মন্ত্রক ডিফেন্স এআই কাউন্সিল (ডিএআইসি) এবং সেই সঙ্গে ডিফেন্স এআই প্রজেক্ট এজেন্সি (ডিএআইপিএ) গঠনের কথা ঘোষণা করে। এটি ডিফেন্স ইন্ডিয়া স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ শুরু করে, যা প্রোটোটাইপিং এবং বাণিজ্যিকীকরণ সমাধানে স্টার্টআপ ও এমএসএমই-কে সমর্থন করে এবং ডিফেন্স পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং-এর (পিএসইউ) জন্য একটি পথনির্দেশিকা প্রদান করে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা পিএসইউ-এর জন্য পথনির্দেশিকায় চিহ্নিত মোট ৭০টির মধ্যে ৪০টি এআই প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে।

এর একাধিক সংজ্ঞা বিদ্যমান থাকলেও দায়িত্বশীল বা দায়বদ্ধ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ রেসপন্সিবল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (আরএআই) হল এআই ব্যবস্থারই বিকাশ, পরীক্ষা এবং স্থাপনের এমন এক পদ্ধতি, যা নৈতিকতা ও আইনি মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে এআই-কে কল্যাণের উদ্দেশ্যে একটি শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়।

সামরিক পরিসরের প্রসঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলির কঠোর তদারকির প্রয়োজন কেন বাধ্যতামূলক, তার নেপথ্যে যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। অস্ত্র ব্যবস্থায় এআই-এর কিছু ব্যবহার যন্ত্রের হাতে জীবন ও মৃত্যুর মতো সিদ্ধান্ত অর্পণ করতে পারে। একই ভাবে, সামরিক বাহিনীতে এআই-এর ব্যবহার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বা ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটেরিয়ান ল-এর (আইএইচএল) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেমন আনুপাতিকতা, বৈষম্য এবং দায়বদ্ধতার নীতি। তর্কাতীত ভাবে সামরিক অভিযানে বল প্রয়োগের আনুপাতিকতা নির্ধারণের জন্য মানবিক বিচার প্রয়োজন এবং এটি শুধু মাত্র এআই ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল নয়।

সামরিক পরিসরে এআই-এর ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। কৌশলগত স্থিতিশীলতার উপর উদ্বেগজনক প্রভাব-সহ এটিকে ইতিমধ্যেই একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। সামরিক পরিসরে দায়িত্বের সঙ্গে এআই-এর অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আর একটি চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক বিচ্যুতির সঙ্গে সম্পর্কিত, এর ব্যবহারের সুযোগ ও সম্ভাব্য প্রভাবের উপর বিশ্বব্যাপী ঐকমত্যের অভাবও বর্তমান। সামরিক বাহিনীতে এআই ব্যবহারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং সর্বজনীন ভাবে স্বীকৃত কোনও পন্থা বা নিয়ম নেই। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন সামরিক এআই-তে উচ্চ স্তরের বিনিয়োগের কারণে সামরিক বাহিনী এআই-এর ভবিষ্যৎ সামরিক ব্যবহার অনুধাবন করার উপায় তৈরি করছে এবং সেই কারণে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রয়োজনীয়তাগুলি সামরিক এআই-এর নানাবিধ আখ্যানকে চালিত করে।

নিছক ন্যূনতমের ঊর্ধ্বে উঠে নৈতিকতার ভাবনা পিছনে চলে যায়, বিশেষ করে যদি প্রতিরক্ষা কৌশলে এক জনের এআই ব্যবহারের যৌক্তিকতা হয় প্রাসঙ্গিকতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত হওয়া এবং অপ্রযুক্তিগত সমাধানহীন সক্ষমতার ব্যবধান শনাক্ত করা। ড্রোনগুলি শক্তি গুণক হলেও তারা কি সীমান্ত সংঘাতে চ্যালেঞ্জের পরিমাণ হ্রাস করে বা অসাবধানতাবশত তা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ায়? যে সব দেশের সামরিক সম্পদের উপর প্রাথমিক টান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত, মানবহীন ব্যবস্থার উপস্থিতি কি স্থিতিশীল শান্তির বিনির্মাণকে ত্বরান্বিত করে না হ্রাস ঘটায়? সামরিক নেতৃত্ব কী ভাবে মাটিতে সামরিক কর্মীদের মোতায়েনের অবস্থার উন্নতি করতে এআই-কে ব্যবহার করতে পারে?

সামরিক পরিসরে এআই-এর ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।

ইউএন জিজিই অন লেথাল অটোনোমাস উইপনস সিস্টেমস বা লজ-এ (এলএডব্লিউএস) সামরিক এআই-এর ভূ-রাজনীতি স্ফটিকের ন্যায় স্পষ্ট, যেখানে ২০১৯ সালে গৃহীত ১১টি গাইডিং নীতির পর যৎসামান্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে, ঐকমত্যভিত্তিক প্রক্রিয়ার ফলাফল সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে পরিণত হয়, যেহেতু রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তির অগ্রগতি একটি সংযোজন সাধনীর অভাবে থমকে গিয়েছে। অন্য সদস্য দেশগুলির মধ্যেও স্পষ্ট লক্ষ্যের অভাব বিদ্যমান। যদিও কেউ কেউ লজ-এর ( উন্নয়ন ও স্থাপনার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে এবং অন্যরা শুধু মাত্র লজ-এর (যেমন চিন) ব্যবহারের বিরোধিতা করে। প্রকৃত পক্ষে কিছু দেশ এই প্রশ্নও তুলেছে যে, কনভেনশন অন সার্টেন কনভেনশনাল উইপন্স (সিসিডব্লিউ) এই আলোচনার জন্য আদৌ উপযুক্ত স্থান ছিল কি না।

‘আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ তখনই সম্ভব, যখন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ বিদ্যমান।’ ইউএন গ্রুপ অব গভর্নমেন্টাল এক্সপার্টস-কে (জিজিই) বাদ দিয়ে গত বছরে সেই সব ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন হয়েছে যেখানে দেশগুলির ছোট দলগুলি তাদের নিজস্ব কল টু অ্যাকশন বা প্রস্তাবনা বাস্তবানের জন্য একত্র হয়েছিল: এআই এবং স্বায়ত্তশাসনের দায়িত্বশীল সামরিক ব্যবহারের বিষয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ঘোষণা এবং মিলিটারি আরইএআইএম-এর দায়িত্বশীল এআই কল টু অ্যাকশন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে বৃহত্তর এআই সাক্ষরতা, ব্যবস্থার নিরীক্ষণযোগ্যতা এবং ব্যর্থতার নানা দিক-সহ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য দাবির ঊর্ধ্বে নতুন নিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে খুব বেশি মূল্য সংযোজন করা হয়নি। যাই হোক, এগুলি সূচনাবিন্দু হিসাবে কাজ করতে পারে যদি সকল পক্ষ সঙ্কেতের ঊর্ধ্বে উঠতে সম্মত হয়।

উপসংহার

অভিনব প্রযুক্তিগুলি পরিচালনা করার জন্য পন্থা ও নিয়ম প্রণয়নের দীর্ঘ যাত্রা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই প্রবণতাটি অস্ত্রের প্রতিযোগিতা এবং ভূ-রাজনৈতিক চাপের কারণে সামরিক এআই-এর আখ্যানকে আরও খারাপ করে তুলেছে। এটি আশ্চর্যজনকও। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ব্রিটেনের দায়িত্বশীল এআই পদ্ধতির শ্বেত পত্র বিধিনিষেধমূলক পরিবেশের পরিবর্তে সক্ষমতার উপর জোর দেয় এবং দায়িত্বশীল ও নৈতিক ব্যবহারের জন্য উদ্দেশ্যমূলক নীতির পরিবর্তে সামরিক এআই-এর উদ্দেশ্যে জনসাধারণের সম্মতিকে আরও বেশি যুক্তিযুক্ত করে তোলে। ভারতেও নীতিপত্রগুলি প্রায়শই সামরিক এআই-এর যুক্তিকে চিনের সঙ্গে ‘তাল মিলিয়ে’ চলার পথে হেঁটেছে বলে মনে করা হয়। বৃহত্তর কৌশলগত প্রেক্ষাপট অপরিহার্য হলেও তাদের উপর প্রযুক্তিগত সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সেনাবাহিনীতে বাস্তব অপ্রযুক্তিগত সমাধানের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।

কিছু দেশ এই প্রশ্নও তুলেছে যে, কনভেনশন অন সার্টেন কনভেনশনাল উইপন্স (সিসিডব্লিউ) এই আলোচনার জন্য আদৌ উপযুক্ত স্থান ছিল কি না।

ন্যাশনাল মিলিটারি এআই কৌশল এবং নীতিগুলিকে অবশ্যই স্থানীয় প্রেক্ষিত এবং বহু অংশীদারদের মতদান দ্বারা রূপায়িত করা জরুরি। কারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিবেশ এবং নাগরিকদের আস্থার স্তর সবই দেশভেদে পরিবর্তনশীল। ‘আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা অর্জনশীল লক্ষ্য সংক্রান্ত আশার বদলে অস্ত্রব্যবস্থা প্রক্রিয়ার উপর অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার দরুন সামরিক শাখাগুলি প্রায়শই তাদের উপলব্ধ বিকল্পগুলিকে সংকীর্ণ করে তোলে।’ এটি কী ভাবে বৃহত্তর কৌশল এবং লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সমন্বিত হবে তা, সম্পূর্ণ উপলব্ধি ছাড়াই আংশিক অধিগ্রহণের দিকে পরিচালিত করে। সামরিক বাহিনীরও প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান এড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ সহজ সমাধান বলে কিছু হয় না।


তৃষা রায় অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড টেকনোলজির ডেপুটি ডিরেক্টর।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.