অনেক লবি করা ও চাপ দেওয়ার পর ২১ সেপ্টেম্বর নেপাল সরকার নেপাল–ভারত সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কোভিড–১৯ যাতে ছড়িয়ে না–পড়ে সেই জন্য এই সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছিল ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর সেই অনুযায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রক্সৌল–বীরগঞ্জ বর্ডার পয়েন্টের গেটের তালা খুলে ১ অক্টোবর পর্যটক ছাড়াও ভারতীয় নাগরিকদেরও তাঁদের ভারতীয় নাম্বার প্লেটের গাড়ি সহ নেপালের ভূখণ্ডে ঢোকার অনুমতি দেন। সীমান্ত বন্ধ থাকার সময় শুধু ভারতীয় নাম্বার প্লেটের সেই সব মালবাহী ট্রাককেই ঢুকতে দেওয়া হত যেগুলো অত্যাবশ্যক পণ্য নিয়ে যেত।
সীমান্ত খোলা নিয়ে নেপাল সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিদান হিসেবে ভারত সরকার, যারা ২০২০ সালের মার্চ মাসে একই কারণে সীমান্ত বন্ধ করেছিল, তারাও তা খুলে দিল। কিন্তু ভারতীয় কাস্টমস/সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে সীমান্ত খোলা নিয়ে সরকারি সার্কুলার না–আসায় কাস্টমস পয়েন্ট দিয়ে মানুষ বা বেসরকারি গাড়ি এখনও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
কোভিড–১৯ থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য স্থানীয় সীমান্ত কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছেন নেপালের বা ভারতীয় নাগরিকদের স্থলপথে নেপালে ঢোকার সময় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করা কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট (আরটি–পিসিআর, জিন এক্সপার্ট, ট্রু নাট বা হু অনুমোদিত কোনও পরীক্ষার) দেখাতে হবে।
সীমান্ত খোলা নিয়ে নেপাল সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিদান হিসেবে ভারত সরকার, যারা ২০২০ সালের মার্চ মাসে একই কারণে সীমান্ত বন্ধ করেছিল, তারাও তা খুলে দিল।
সীমান্ত বন্ধ থাকার প্রতিক্রিয়া
নেপাল–ভারত সীমান্ত বন্ধ থাকার ফলে সাধারণ ভাবে নেপালি ও ভারতীয় মানুষ, এবং বিশেষ ভাবে সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, প্রচুর সমস্যায় ভুগেছেন। কারণ সীমান্ত পার হতে তাঁদের প্রচুর ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। এর আগে কখনও দু’দেশের ১৭৫৩ কিমি দীর্ঘ সীমান্ত বন্ধ হয়নি।
স্মরণাতীত কাল থেকে নেপাল ও ভারত মুক্ত সীমান্ত ব্যবস্থা অনুসরণ করে এসেছে। এক দেশের নাগরিক অনায়াসে সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে যেতে পারতেন, এবং তার জন্য ভিসা, পাসপোর্ট বা এমনকি পরিচয়পত্রের মতো কোনও আইনি নথি লাগত না। এর কারণ ১৯৫০ সালের দু’দেশের শান্তি ও মিত্রতা চুক্তি, যার দৌলতে এক দেশের নাগরিক অন্য দেশের ভূখণ্ডেও ‘ন্যাশনাল’ হওয়ার মর্যাদা পান। কাজেই প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতেন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক এবং ব্যবসা–বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজে।
স্বাভাবিক ভাবেই নেপাল ও ভারতের মানুষ ভারত–নেপাল সীমান্ত ফের খুলে যাওয়ায় উল্লসিত। খবর এসেছে সীমান্তের কাছাকাছি থাকা দু’দেশের মানুষ এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে তাঁরা মিষ্টি বিনিময় করেছিলেন।
ভারতীয় পর্যটকদের প্রথম দলটি রক্সৌল–বীরগঞ্জ দিয়ে ১ অক্টোবর সীমান্ত পেরনোর পর নেপালের পর্যটন সংস্থাগুলির কর্তারা তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। প্রত্যাশা তুঙ্গে যে এবার নেপালে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা বিশেষ ভাবে বাড়বে।
বীরগঞ্জের হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম এন্টারপ্রেনিঅরস অ্যাসোসিয়েশন–এর সভাপতি হরি পান্টা নেপালের পর্যটন শিল্পের উন্নতিতে ভারতের পর্যটকদের বিরাট অবদানের কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন। ২০১৯ সালে স্থল ও আকাশপথে নেপালে যাওয়া মোট বিদেশি পর্যটকদের (১১ লক্ষ ৭০ হাজার) মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল ২০৯,৬১১। তবে ধরে নেওয়া হয় নেপালে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা আসলে আরও অনেক বেশি, কারণ অনেকের যাওয়াটা নথিভুক্ত হয় না।
পর্যটন থেকে নেপালের মোট আভ্যন্তর উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ শতাংশ আসে, আর সাড়ে দশ লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থানও হয়। কাজেই যখন নেপাল–ভারত সীমান্ত বন্ধ ছিল, তখন নেপালের পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তা ছাড়া সীমান্তের কাছাকাছি স্থানীয় বাজারগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ সেগুলো আন্তঃসীমান্ত যাতায়াতের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল।
বহু লক্ষ নেপালি, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের, যে হেতু কাজ করেন ভারতে, তাই করোনাভাইরাসের সময় তাঁদের অবস্থা সব থেকে শোচনীয় হয়েছিল। সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ভারতে বা নেপালে আটকা পড়ে যান। সেই নৈরাজ্যের সময় সীমান্ত পেরনোর সুযোগ না–পাওয়ায় অনেকের মৃত্যুও হয়।
এই দুর্দশার মধ্যে আবার কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী পারসা জেলায় ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’–এর কাছে পিলার ৪৩৫/১ থেকে ৪৩৯/৪ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সীমান্তে একতরফা ভাবে কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে দেন। এঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দু’দেশের মানুষের সুসম্পর্ক নষ্ট করা। এর ফলে সীমান্ত এলাকার যে সব মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক কারণে সীমান্ত পেরনোর প্রয়োজন হয় তাঁরা ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়েন।
নেপাল ও ভারতের অনেক মানু্ষ অপ্রচলিত পথে সীমান্ত পেরনোর চেষ্টা করেন, এবং তার ফলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
এখন কিন্তু নেপাল ও ভারতের মানুষ ক্রমশ বেশি করে বুঝতে পারছেন দুই সরকারের সীমান্ত সিল করার সিদ্ধান্ত শুধু অবাস্তবই ছিল না, তা মূল উদ্দেশ্যটাকেই ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। যদিও তা করোনাভাইরাস কেসের সংখ্যা বেঁধে রাখতে পেরেছিল, কিন্তু কাজের সুযোগ খুঁজতে বা চিকিৎসা করাতে বা অন্যান্য কারণে যাঁদের এপার ওপার করতে হয়, তাঁদের দুর্দশা খুবই বেড়ে গিয়েছিল।
নেপাল ও ভারতের অনেক মানু্ষ অপ্রচলিত পথে সীমান্ত পেরনোর চেষ্টা করেন, এবং তার ফলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তা ছাড়া নেপাল–ভারত সীমান্তে অবৈধ বাণিজ্যও অনেক বেড়ে যায়, আর তার ফলে সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হয়। কাজেই নেপাল–ভারত সীমান্ত দিয়ে মানু্ষ ও গাড়ির যাতায়াত বন্ধ করার অযৌক্তিকতার কথা মাথায় রেখে বলা যায় যে দু’দেশের সরকারের উচিত ছিল রক্সৌল–বীরগঞ্জসহ প্রধান বর্ডার পয়েন্টগুলোতে করোনাভাইরাস কেস যাচাইয়ের জন্য হেল্থ ডেস্ক চালু করা, এবং যাঁদের নেগেটিভ রিপোর্ট ছিল তাঁদের যাতায়াত করতে দেওয়া।
নেপাল ও ভারতের মধ্যে আর্থ–সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে দু’দেশের মধ্যে বেসরকারি গাড়ির আন্তঃসীমান্ত চলাচলের ব্যবস্থাটি আর একবার খতিয়ে দেখা জরুরি। নেপাল কর্তৃপক্ষ কাস্টমস পয়েন্টগুলিতে ভারতীয় বেসরকারি গাড়িকে নেপালে ঢুকতে দেওয়ার জন্য দিনপ্রতি বর্ডার পয়েন্টেই একটা চার্জ নেন। অন্য দিকে নেপালের মানুষ নেপালের নাম্বারের গাড়ি নিয়ে ভারতে আসতে চাইলে তাঁদের কাঠমান্ডুর ভারতীয় দূতাবাস বা বীরগঞ্জের কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস থেকে আগাম অনুমতি নিতে হয়। ভারতীয়রা তাঁদের দেশের গাড়ি নিয়ে নেপালে ঢুকতে চাইলে তাঁদের কিন্তু দিল্লির নেপালি দূতাবাস থেকে এমন কোনও আগাম অনুমতি নিতে হয় না। সীমান্ত পারাপারে এই ধরনের বৈষম্য অবশ্যই ১৯৫০–এর ভারত–নেপাল শান্তি ও মিত্রতা চুক্তির মূল মনোভাবের বিরোধী। সীমান্ত আবার খুলে যাওয়া থেকে সর্বাধিক ফয়দা তুলতে, এবং দু’দেশের মানুষের সনাতন বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করতে যা সর্বাধিক প্রয়োজন তা হল নেপাল ও ভারতের মধ্যে মানুষের যাতায়াত ছাড়াও গাড়ির চলাচলও অবাধ করা।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.