Author : Snehashish Mitra

Published on Mar 09, 2024 Updated 0 Hours ago

ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নগর সম্প্রসারণ প্রকল্প যখন দুর্বল পরিকল্পনার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, সেই সময় সল্টলেক শহরের পুনর্জন্ম ও শহর পরিকল্পনার একটি ভারতীয় মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে।

উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা: সল্টলেক টাউনশিপ থেকে শিক্ষা

গত কয়েক দশক ধরে গ্লোবাল সাউথের শহরগুলি জুড়ে নগর সম্প্রসারণ একটি সাধারণ ঘটনা, যেখানে পরিবেশগত ও সামাজিক ভূচিত্র পরিবর্তন করে শহরতলির অঞ্চলগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে শহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। যদিও এই পরিবর্তনে ব্যক্তিগত পুঁজির উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে, স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে ভারতে নগর সম্প্রসারণ প্রায় একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বাধীন ছিল। চণ্ডীগড়, দুর্গাপুর, নেভেলি, ভিলাই ও বোকারোর মতো শহরগুলি ভারী সরকারি বিনিয়োগ দ্বারা চিহ্নিত ছিল, এবং কিছু ক্ষেত্রে (যেমন ভিলাই) বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা (যেমন সাবেক ইউএসএসআর) একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই শহুরে গঠনগুলি বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ছিল  প্রশাসনিক উদ্দেশ্য, বড় আকারের উৎপাদন ইউনিটের বিকাশ, এবং চারটি মেট্রোপলিটন শহরের — কলকাতা, মুম্বই, নয়াদিল্লি ও চেন্নাই — উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করা।


আজ সল্টলেককে ভারতের বিচক্ষণভাবে পরিকল্পিত এবং ভবিষ্যতের শহুরে নগরগুলির মধ্যে একটি হিসাবে গণ্য করা হয়, যেখানে প্রশস্ত রাস্তা, বৃত্ত, বুলেভার্ড ও সবুজ আচ্ছাদন রয়েছে।

একটু ভিন্নভাবে, কলকাতা সংলগ্ন সল্টলেকের জনপদ (বিধাননগর নামেও পরিচিত) ১৯৫০–এর দশক থেকে পরিকল্পিত ও বিকশিত হয়েছিল পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া অবিভক্ত বাংলার এলাকাগুলি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের একটি অংশের পুনর্বাসনের জন্য। আজ সল্টলেককে  ভারতের বিচক্ষণভাবে পরিকল্পিত এবং ভবিষ্যতের শহুরে নগরগুলির মধ্যে একটি হিসাবে গণ্য করা হয়, যেখানে প্রশস্ত রাস্তা, বৃত্ত, বুলেভার্ড ও সবুজ আচ্ছাদন রয়েছে। ভারতের সাম্প্রতিক কিছু নগর সম্প্রসারণ ও গ্রিনফিল্ড সিটি প্রকল্প যখন পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রার পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে দুর্বলতার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, সেই সময় সল্টলেক শহরের পুনর্জন্ম ও শহর পরিকল্পনার একটি ভারতীয় মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে।

সল্টলেক তৈরি হওয়া

দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু ও অভিবাসী এসেছিলেন। এই জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কলকাতা এবং এর আশেপাশে বসতি স্থাপন করে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দ্বৈত উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতা সংলগ্ন একটি জনপদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন: ১) কলকাতার উপর বিদ্যমান ও আসন্ন জনসংখ্যার চাপ কমানো; ২) উদ্বাস্তুদের বসতি স্থাপন করা, বিশেষ করে
বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্য বসবাসের উপযোগী জায়গা তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়ে।

কলকাতার পূর্ব দিক সংলগ্ন কিছু জলাভূমি পুনরুদ্ধার করে নতুন টাউনশিপ সল্টলেক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই জলাভূমিগুলি
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির (ইকেডব্লিউ) অংশ ছিল। ইকেড্বলিউ–র অংশগুলি পুনরুদ্ধার করার ধারণাটি মূলত নেদারল্যান্ডসের জল পুনরুদ্ধার অনুশীলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সল্টলেকের জন্য মনোনীত জলাভূমির বেশিরভাগই কলকাতার তৎকালীন মেয়রের মালিকানাধীন ছিল, যিনি  এক টাকার প্রতীকী বিনিময়ে জমিটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।


সল্টলেকের জন্য মনোনীত জলাভূমির বেশিরভাগই কলকাতার তৎকালীন মেয়রের মালিকানাধীন ছিল, যিনি এক টাকার প্রতীকী বিনিময়ে জমিটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।

১৯৫৩ সালে একটি ডাচ ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম নেডেকো দ্বারা লবণাক্ত জলের হ্রদগুলি জরিপ করা হয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে সরকার সল্টলেক এলাকার উত্তরে জলাভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য ১৭৩.৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে নয়াবাদ, করিমপুর, হাদিয়া, জগতিপোতা, পরগাছিয়া, পাঁচপোতা, মুকুন্দপুর ও তেঁতুলবাড়ি মৌজা (একটি প্রশাসনিক–আঞ্চলিক ইউনিট) অন্তর্ভুক্ত ছিল। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার ইভান মিলুটিনোভিক ইনভেস্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (আইএমআইআইসি) ১৯৫৯ সালে নোনা জলের হ্রদগুলি পুনরুদ্ধারের জন্য দরপত্র জিতেছিল। সল্টলেকের লেআউট পরিকল্পনা ১৯৬৪ সালে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৬১ এবং ১৯৬৭–র মধ্যে আইএমআইআইসি, যারা কলকাতার হুগলি নদী থেকে পলি তোলার কাজও করছিল, সেখান থেকে খনন করা পলি ব্যবহার করে সল্টলেকের জলাভূমি পুনরুদ্ধার করে। পুনরুদ্ধার সম্পূর্ণ হলে, সল্টলেক টাউনশিপ তৈরির কাজ শুরু হয়।

সল্টলেকের পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যতের উপাদান

একটি পরিকল্পিত শহর হিসাবে সল্টলেকের একটি কাঠামোগত ব্লক প্যাটার্ন রয়েছে, যার প্রতিটি ব্লকে একটি সমানুপাতিক খোলা মাঠ, সবুজ আচ্ছাদন এবং কমিউনিটি মার্কেট রয়েছে, এবং এটি পাঁচটি সেক্টরে বিস্তৃত।
নিউইয়র্ক (ম্যানহাটন জেলা)বার্সেলোনার মতো ট্রান্সআটলান্টিকের কিছু শহরের অনুসরণে গ্রিড প্যাটার্ন–এ সল্টলেক একে অপরের সংলগ্ন আয়তক্ষেত্রাকার প্লটে বিভক্ত ছিল। একে অপরের সমান্তরাল ধমনী রাস্তা, ৯০ ডিগ্রিতে নিয়মিত ছেদ–সহ, তৈরি করা হয়েছিল। জমি ব্যবহারের ধরন নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, এবং আবাসিক প্লটগুলি বরাদ্দ জমির ৫০ শতাংশ ছিল। এই প্যাটার্নটি এখনও পর্যন্ত অনেকাংশে বজায় রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ আবাসিক ব্লকের কাছাকাছি একটি কমিউনিটি মার্কেট এবং কেন্দ্র রয়েছে, যা দৈনন্দিন মুদির দোকানের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের জন্য মানুষকে একত্র করে। খোলা জায়গা এবং খেলার মাঠের বিস্তৃত প্রাপ্যতা, সল্টলেককে ভারতের একটি অনন্য জনপদে পরিণত করেছে, যেখানে মানুষের, শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েরই, শারীরিক কার্যকলাপ ও বিনোদনের জন্য গণপরিসর ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। পৃথক আবাসন প্লট ছাড়াও, একাধিক হাউজিং কমপ্লেক্সও রাজ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। বেশ কয়েকটি রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগও জমি অধিগ্রহণ করেছে, এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য আবাসন কমপ্লেক্স তৈরি করেছে। এই ধরনের আবাসন উদ্যোগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীগুলিকে সল্টলেকে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম করে।


বেশিরভাগ আবাসিক ব্লকের কাছাকাছি একটি কমিউনিটি মার্কেট এবং কেন্দ্র রয়েছে, যা দৈনন্দিন মুদির দোকানের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের জন্য মানুষকে একত্র করে।

সল্টলেকের শহর পরিকল্পনাবিদ ডোব্রিভোজে তোসকোভিচের একটি মূল লক্ষ্য ছিল একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য টাউনশিপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করা। ২০০০–এর দশক পর্যন্ত কর্মসংস্থানের প্রধান স্থান হিসাবে সরকারি ভবন স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সল্টলেকের আইটি সেক্টরটি পূর্ব ভারতের বৃহত্তম আইটি হাব এবং বছরের পর বছর ধরে একটি রপ্তানি উৎস। ২০০০–এর দশক থেকে আইটি সেক্টরের বিকাশ সল্টলেকে একটি নতুন জীবন যোগ করেছে, যা শহরে ভোক্তাকেন্দ্রিক ব্যবসার বিকাশকে সহজতর করেছে।

সল্টলেকের রাস্তার জন্য ২৩ শতাংশ এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, যা পার্শ্ববর্তী কলকাতার ৭ শতাংশ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি। ফলস্বরূপ, ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ যুক্তিসঙ্গতভাবে বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক প্রবাহকে পরিচালনা করেছে, বিশেষ করে সল্টলেকে তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) হাবের বিকাশের পরে।
কলকাতার নতুন ইস্ট–ওয়েস্ট মেট্রো এখন মধ্য কলকাতার সঙ্গে সল্টলেককে সংযুক্ত করেছে, এবং শীঘ্রই এটি হাওড়া স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এই সংযোগ উদ্যোগটি বৃহত্তর কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকার অন্যান্য অংশের সঙ্গে সল্টলেকের যোগাযোগ সহজতর করেছে।



সল্টলেক: একটি শহুরে দৃষ্টান্ত

নগরায়ণের জন্য ভারতের সাম্প্রতিক প্রয়াসকে যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষার একটি মূল উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যাই হোক, যদি আমরা সারা দেশে নতুন শহুরে উন্নয়নের কথা বলি (গুরুগ্রাম, নিউটাউন কলকাতা, নয়ডা), সেগুলি মূলত
অযৌক্তিক পরিকল্পনা ও অপ্রতুল পরিকাঠামো (জল সরবরাহ, নিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সংযোগ, অব্যবহৃত খোলা জায়গা) দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ)–র মতো রাজ্যচালিত প্রতিষ্ঠানগুলি অনুপযুক্ত জায়গায় হাউজিং কলোনি তৈরি করেছে এবং ক্রেতা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে ১৮,০০০ কোটি টাকার অবিক্রিত ইনভেন্টরি হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই ধরনের ফলাফল বিগ ডেটা, প্রজেকশন মডেল এবং নগরকেন্দ্রিক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের যুগে ঘটছে। শহুরে বিষয়গুলির এই ধরনের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি, ভারতীয় শহরবাসীরা প্রায়শই অন্য কোথাও, বিশেষ করে পশ্চিমের উন্নত প্রশাসনযুক্ত শহরগুলি খুঁজতে প্রলুব্ধ হন; আর রাজনীতিবিদরা প্রায়ই ভারতীয় শহরগুলিকে পরবর্তী লন্ডন, সিঙ্গাপুর বা সাংহাই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। যাই হোক, এই জাতীয় পরিকল্পনাগুলি মূলত কোনও পদক্ষেপযোগ্য অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া নিছকই বাগাড়ম্বড় হয়ে থাকে, এবং শহরগুলিতে কিছু জায়গার সৌন্দর্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই প্রেক্ষাপটে সল্টলেকের মতো ভারতের কিছু সফল নগর পরিকল্পনার দিকে তাকানো অনেক বেশি অর্থবহ হবে। একটি বিশদ তথ্যভিত্তিক অধ্যয়ন আরও উন্নতির সুযোগগুলি্র উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি এর বাসযোগ্যতা গুণাবলির বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে। একটি সমাজ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ‘‌ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা’‌ দ্বারা সল্টলেক আর্কাইভস তৈরির উদ্যোগটি সল্টলেক সম্পর্কে বিস্তৃত গুণগত ও পরিমাণগত ডেটা (সংবাদপত্রের কভারেজ, বিধানসভার বিতর্ক, মানচিত্র, ইত্যাদি) জনসাধারণের দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সল্টলেক আর্কাইভ ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই নগরবাদের উপর গুরুত্ব–প্রদানকারী গবেষক ও নগর পরিকল্পনাবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হতে পারে। আরও উল্লেখযোগ্যভাবে, উদ্বাস্তুদের থাকার জন্য কলকাতা মহানগরীর আশপাশে শহুরে পরিসর তৈরি করার দৃষ্টিভঙ্গিটি, এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনার সুবিধার্থে সক্ষম সংস্থাগুলিকে কার্যভার অর্পণ করা — এই হল ভবিষ্যৎ লক্ষ্যগুলির সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির একটি সফল সংশ্লেষণ, যা ভারতে ও অন্যত্র আজকের নগর পরিকল্পনাবিদ এবং প্রশাসকদের জন্য একটি শক্তিশালী রেফারেন্স হতে পারে।



স্নেহাশিস মিত্র অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আরবান স্টাডিজের ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.