Author : Grace Mutungu

Published on Dec 14, 2021 Updated 0 Hours ago

তালিবানদের প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি এক দশক ধরে চলছিল। সামরিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য তালিবানরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেনি। অন্য প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে আলাদা হয়ে ভারত তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে এবং শেষমেষ সে দেশ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেছে। অবশ্য আফগানিস্তানে স্থিতিশীল অবস্থার পুনর্বহালে ভারতের ন্যায্য স্বার্থ আছে এবং সে দেশের সব গোষ্ঠীর মধ্যেই ভারতের গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য।

আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকার পুনর্নির্ধারণ

ভূমিকা

২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টাদের (এন এস এ) স্তরে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে তৃতীয় আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল। ইরানের উদ্যোগে এই মঞ্চের প্রথম দুটি বৈঠক ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়। ইরান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টারা ভারতের এন এস এ অজিত ডোভালের আমন্ত্রণে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। অবশ্য এর মধ্যে দুটি অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের এন এস এ মোইদ ইউসুফ প্রকাশ্যে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, ‘বিনষ্টকারী দেশ (ভারত) কখনও শান্তি স্থাপন করতে পারে না।’ আর চিনা কর্তৃপক্ষ ‘সময়ের অসুবিধে’র কথা দর্শিয়ে অনুপস্থিত থেকেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রত্যাখ্যান প্রত্যাশিতই ছিল। চিনের অনুপস্থিতি এই ইঙ্গিতই দিয়েছে যে, চিনের আফগানিস্তান নীতি আসলে পাকিস্তান দ্বারাই পরিচালিত ও নির্ধারিত হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি টমাস ওয়েস্ট আফগানিস্তান সংক্রান্ত চলতি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দিল্লিতে এসেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপের শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে আফগানিস্তানের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

এন এস এ-দের এই অধিবেশনের পরে প্রকাশিত ‘দিল্লি ঘোষণাপত্র’[১] প্রত্যাশামাফিকই হয়েছে। ভারত কুন্দুজ, কান্দাহার এবং কাবুলে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ‘নিন্দা’ করেছে এবং পাশাপাশি ‘আফগানিস্তানকে কখনওই বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর না হয়ে উঠতে দেওয়ার’ যৌথ প্রতিশ্রুতির অংশীদার হয়েছে। বিবৃতিতে ‘একটি খোলামেলা এবং প্রকৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার’ গঠন এবং ‘নারী, শিশু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার’ সুরক্ষিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বিবৃতিতে ফের বলা হয়েছে, এই ত্রাণ ‘অবাধ, সরাসরি এবং সুনিশ্চিত বণ্টন’-এর মাধ্যমে ‘অবৈষম্যমূলক ভাবে’ সারা দেশে পৌঁছে দিতে হবে। ঘোষণাপত্রটিতে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ও মাদক পাচার রুখতে সম্মিলিত সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।

এই নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, বৈঠকের মূল বার্তাটি হল যদিও আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতের এই মুহূর্তে কোনও উপস্থিতি নেই (কাবুলের পতনের দু’দিন পরে ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট ভারত সে দেশে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং আধিকারিকদের প্রত্যাহার করে নেয়), তবুও সে দেশে ভারতের বৈধ রাজনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ বিদ্যমান — এটি ইরান, রাশিয়া এবং মধ্য এশীয় দেশগুলি মেনে নিয়েছে। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি টমাস ওয়েস্ট আফগানিস্তান সংক্রান্ত চলতি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দিল্লিতে এসেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপের শীর্ষ দেশগুলির সঙ্গে আফগানিস্তানের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

২০০১ পরবর্তী সময়ে ভারতের ভূমিকা

২০০১ সালে তালিবান শাসনের পতনের পর ভারত সে দেশে তার দূতাবাস পুনরায় খুলে দেয়। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে আফগানিস্তান ক্রমশ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ফলে সেখানে ভারতের উপস্থিতি হ্রাস পেতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে তালিবান কাবুলের দিকে এগোতেই ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইরান এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ ভাবে ভারত তালিবানবিরোধী ‘উত্তরের জোট’কে সমর্থন জানিয়েছিল। উত্তরের জোট পঞ্জশির উপত্যকা থেকে আহমেদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

ইরান এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ ভাবে ভারত তালিবানবিরোধী ‘উত্তরের জোট’কে সমর্থন জানিয়েছিল। উত্তরের জোট পঞ্জশির উপত্যকা থেকে আহমেদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আই সি ৮১৪ বিমান অপহরণ করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হলে তালিবানদের সঙ্গে ভারতের একটি দীর্ঘ আলোচনা শুরু হয়। এর ফলে ভারতে তালিবানদের প্রতি বিরূপ মনোভাব আরও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। ১৯৯০-এর দশক প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে।

তালিবান-পরবর্তী আফগানিস্তানে উত্তরের জোটের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকার সময় ভারত সে দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনা পায়। যদিও প্রথাগত ভাবে ভারত দাতা দেশগুলির অন্যতম নয়, তবুও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ভারত আঞ্চলিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অংশীদার হয়ে ওঠে। গত দুই দশকে ভারত সে দেশে মানবিক ত্রাণ সহায়তা, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ নজর দিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শাসন ক্ষমতা পুনর্গঠনের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছে। দশ লক্ষ টন গম সরবরাহ, হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ, দেশ জুড়ে অন্তত ছ’টি মেডিক্যাল ক্যাম্প চালানো যেখানে প্রস্থেটিক এবং ছোটখাট অস্ত্রোপচারের মতো একাধিক জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পে ভারত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। উজবেকিস্তান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সড়ক সংযোগ, একটি বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, একটি মেশিন টুল ওয়ার্কশপ, টেলিভিশন আপলিংক এবং ডাউনলিংক সিস্টেম, একটি নতুন পার্লামেন্ট ভবন এবং স্থানীয় কৃষিজাত উৎপাদন মজুতের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ইউনিট তৈরি ইত্যাদি প্রকল্পগুলিও এর মধ্যে অন্যতম।

এক হাজারেরও বেশি আফগান শিক্ষার্থী প্রতি বছর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়েছে, প্রায় সমান সংখ্যক পড়ুয়া স্বল্পমেয়াদি পেশাদার কোর্সে (যেমন তথ্য প্রযুক্তি, ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যাকাউন্টিং) এবং মৌলিক দক্ষতা অর্জনকারী কোর্সে (রেফ্রিজারেশন, বৈদ্যুতিক মেরামত, জলের লাইনের কাজ, কাঠের কাজ ইত্যাদি) ক্ষেত্রে অংশ নেয়। পাশাপাশি আফগান সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে ভারত যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিল। ৬০,০০০-এরও বেশি আফগান ভারতে তাঁদের শিক্ষা শেষ করে নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে ব্রতী হয়েছেন। স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য ভারত ৪০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে, যেগুলির প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা এবং জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা। নারী-উদ্যোগগুলির দক্ষতা বর্ধন ও সেগুলি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।[২]

ধীরে ধীরে আফগান সেনাবাহিনীর প্রসার ঘটলে তারা ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির সদব্যবহার শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত আফগান বাহিনীকে তিনটি হেলিকপ্টারও সরবরাহ করেছে।

চারপাশে ভূখণ্ডবেষ্টিত হওয়ার কারণে এবং একমাত্র করাচি বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে যোগাযোগ রাখতে পারার দরুন আফগানিস্তান পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল ছিল। ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে একটি বিকল্প তৈরি করার প্রকল্প গ্রহণ করে এবং ইরানের সীমান্ত শহর জাহিদানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য আফগানিস্তানে ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হাইওয়ে নির্মাণ করেছে। এটি ছিল দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আন্তঃসংযোগকারী হিসেবে আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকাকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি অংশ। চাবাহার এই আঞ্চলিক সংযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক সহযোগিতার দক্ষিণ এশীয় সংগঠনে (সার্ক) আফগানিস্তানের সদস্যপদ পাওয়া নিয়েও ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

২০১১ সালে ভারত প্রথম দেশ হয়ে ওঠে যার সঙ্গে আফগানিস্তান একটি কৌশলগত অংশীদারি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার (ন্যাটো)সংবেদনশীলতার কারণে অঞ্চলটিতে সুরক্ষাক্ষেত্রে ভারতীয় ভূমিকা অবশ্য নগণ্য ছিল। কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ এবং পণ্য সরবরাহের জন্য তারা পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল ছিল। ধীরে ধীরে আফগান সেনাবাহিনীর প্রসার ঘটলে তারা ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির সদব্যবহার শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত আফগান বাহিনীকে তিনটি হেলিকপ্টারও সরবরাহ করেছে।

আফগানিস্তানে ভারতের উন্নয়নমূলক ভূমিকার কথা আফগান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা সমাদৃত হয়েছে। এ বিষয়ে একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান যারা আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা এবং উপস্থিতি সীমিত করার জন্য তীব্র চেষ্টা চালিয়েছিল। তালিবানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে প্রায়শই নিশানা করা হয়েছে। সড়ক প্রকল্পে কর্মরত ভারতীয়দের অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছে। যে সমস্ত অতিথি নিবাসে ভারতীয়রা থাকতেন সেগুলিকে প্রায়শই নিশানা করা হয় এবং ২০০৮ সালে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়৷ প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে (বিশেষ আধিকারিক অর্থাৎ রাষ্ট্রদূতের সহযোগী) এবং একজন প্রবীণ কূটনীতিক-সহ চার ভারতীয় নিহত হন, বোমা হামলায় ৫০ জনেরও বেশি আফগানের প্রাণ গেছে। এই ঘটনায় গোয়েন্দারা হাক্কানি গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন যাদের পরবর্তী কালে অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন মার্কিন সেনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির কাছে ‘আই এস আই-এর (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) একটি সক্রিয় শাখা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[৩]

তালিবানের প্রত্যাবর্তন

২০০১ সালে কেউই এ কথা ভাবতে পারেননি যে, আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি দুই দশকেরও বেশি সময় স্থায়ী হবে অথবা তাদের প্রস্থানও এতটাই অসম্মানজনক হবে। কাবুল থেকে সি-১৭ গ্লোবমাস্টার বিমানে চেপে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে চলন্ত বিমান থেকে আফগানদের পড়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্য ১৯৭৫ সালে সায়গন থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। এটি আরও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কারণ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রবেশ করে এবং প্রাথমিক ভাবে তালিবান ছাড়া আফগানরা সবাই তাদের স্বাগত জানায়। তা হলে ঠিক কী কারণে পরিস্থিতি এতটা বদলে গেল?

বর্তমানে তালিবানরা রাজনৈতিক ভাবে পরিচিত, বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে বহুপাক্ষিক অধিবেশনের দুনিয়ায় এক দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং একটি প্রমাণিত সামরিক শক্তি যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে সফল হয়েছে।

২০০১ সালের ডিসেম্বরে তালিবানরা হামিদ কারজাইয়ের — যাঁকে এই রূপান্তরের প্রধান মুখ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল — কাছে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়ে একজন দূত পাঠায়। বিনিময়ে তালিবানদের আফগানিস্তানে শান্তিতে বসবাস করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তালিবানদের অস্তিত্ব নির্মূল হয়েছে, এ কথা ভেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে। এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ছিল, তখন অন্য দিকে তালিবানরা পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয়ে পুনরায় সংগঠন গড়ে তুলছিল — তাদের সদস্যদের পুনর্গঠন এবং ইসলামিক দাতব্য সংস্থাগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছিল। ২০০৬ সাল নাগাদ সরকারি দুর্বলতা এবং দানা বাঁধতে থাকা স্থানীয় অসন্তোষকে ব্যবহার করে ক্রমবর্ধমান আত্মঘাতী হামলা এবং উন্নত বিস্ফোরক প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার বার এ কথায় জোর দিয়েছিল যে, তারা নতুন দেশ নির্মাণে আগ্রহী নয়, তা সত্ত্বেও তারা একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন পরিচালনা, নতুন বিচারব্যবস্থা গঠন, নতুন পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপগুলি নেওয়ার মাধ্যমে এক কথায় একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলে। মার্কিন মডেলের অনুকরণে গঠিত এই নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি কংগ্রেস, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। দুর্নীতি বাড়তে থাকে এবং শাসন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশ বিভাগের দায়িত্বে জার্মানি, বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার দায়িত্বে ইতালি এবং মাদকপাচার চক্র রোখার দায়িত্বে ইংল্যান্ডের উঠে আসার ফলে অর্থ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে — হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরেও বর্তমানে বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি অবৈধ আফিম উৎপাদন করে আফগানিস্তান। এর মূল কারণটি হল, প্রকল্পগুলির অর্থসংস্থান করা হয় যাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতে, সেই উচ্চ বেতনের বিদেশি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে আফগানিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির কোনও যোগাযোগ ছিল না।

মার্কিন মডেলের অনুকরণে গঠিত এই নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি কংগ্রেস, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজকে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

বারাক ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে, ইরাকের যুদ্ধকে ‘খারাপ যুদ্ধ’ এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধকে ‘প্রয়োজনীয় যুদ্ধ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের বিদ্রোহ দমনে একটি জোরদার সামরিক অভিযানের ঘোষণা করেন এবং এ-ও বলেন যে, সেই সময় থেকে ১৮ মাস পরে সামরিক শক্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এ হেন ঘোষণা হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে। তালিবানদের কথায় ‘ঘড়ি আপনাদের (মার্কিন), সময় আমাদের (তালিবান)।’ সামরিক আধিকারিকরা ভাল ভাবেই জানতেন যে, এত কম সময়ে এমন বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব নয় যেখানে বিদ্রোহীরা চাপের মুখে নিরাপদ আশ্রয়ে গা ঢাকা দিতে পারে। কিন্তু এই বাস্তবটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। ১৯৮০-র দশকে, মুজাহিদরা সোভিয়েতদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে সক্ষম হয়েছিল, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে তালিবানদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে ধ্বংস করা এবং তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে নষ্ট করা সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই শিক্ষা ভুলে গেলেও তালিবান এবং আই এস আই তা মনে রেখেছিল।

পট পরিবর্তনের জন্য সময় ছিল উপযুক্ত। একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন থেকে তালিবানদের প্রথমে বিদ্রোহীর তকমা দেওয়া হয় এবং বর্তমানে তারা একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে এসেছে। ২০১৩ সালে দোহা কার্যালয় উদ্বোধন করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই আইনিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। দোহা, ইস্তানবুল, মস্কো এবং ইসলামাবাদে একাধিক শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াটিতে স্বীকৃতির শেষ শিলমোহর পড়ে যখন ২০১৮ সালে আমেরিকা তালিবানদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের দোহা চুক্তি[৪] স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়। তালিবানরা এক ধোঁয়াটে প্রতিশ্রুতি দেয় যে আল কায়দা এবং অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তারা তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং বিভিন্ন আফগান সম্প্রদায়গুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে এক শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা করবে। তালিবানদের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে রাজি হয়। কাবুল সরকারকে তাদের হেফাজতে থাকা ৫,০০০ তালিবান যোদ্ধাকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি করিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির সর্বনাশ করে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পরেও তালিবানরা তাদের সামরিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখে এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও সীমান্ত চেকপোস্টগুলির দখল নিয়ে নেয়। বিভিন্ন আফগান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা অচলাবস্থায় রয়েছে এবং কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির কাবুল ছেড়ে পলায়ন কাবুলের শান্তিপূর্ণ পতনকে সুনিশ্চিত করে। সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটালেও তা আফগানদের জন্য অনিশ্চয়তা এবং হিংসার আরও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তালিবানদের সমর্থকরা এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন জোগাতে সক্ষম হয়েছেন যখন কাবুল প্রশাসনের সমর্থকরা ধৈর্য হারান এবং হাল ছেড়ে দেন। কাবুলে তালিবানদের প্রবেশের দু’দিন পর ভারত আফগানিস্তানে তার দূতাবাস বন্ধ করে এবং সব আধিকারিককে দেশে ফিরিয়ে আনে। ফলে তালিবান, হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং আইএসআই-এর জন্য আফগানিস্তানের ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়ে যায়।

একটি আঞ্চলিক পুনর্সূচনা

দোহা চুক্তিকে শান্তি চুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার সময়ে একটি ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে তালিবান একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক সত্তায় পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও এর পক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ক্ষমতায় আসার পরে তাদের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল ইসলামিক রিপাবলিকের পরিবর্তে ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানকে ফিরিয়ে আনা এবং পুরনো পতাকা পুনর্বহাল করা। যদিও এ ক্ষেত্রে কিছু ফারাক আছে। ১৯৯০-এর দশকের তালিবান ছিল রাজনৈতিক পরিচয়হীন, সামরিক ভাবে অপরীক্ষিত একটি শক্তি যাদের একমাত্র নেতা ছিলেন মোল্লা ওমর। বর্তমানে তালিবানরা রাজনৈতিক ভাবে পরিচিত, বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে বহুপাক্ষিক অধিবেশনের দুনিয়ায় এক দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং একটি প্রমাণিত সামরিক শক্তি যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে সফল হয়েছে। যদিও তারা এখনও ততটা ঐক্যবদ্ধ নয়। আমির উল মুমিনিন মোল্লা হাইবাতুল্লাহ ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর কান্দাহারের একটি মাদ্রাসায় একবারই হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ছবি বা ভিডিও তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোল্লা বরাদরের নেতৃত্বাধীন, তালিবানের প্রকাশ্য মুখ হয়ে ওঠা দোহা গ্রুপের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে এবং বরাদরকে দুজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর একজন হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে হাক্কানিদের বাগবিতণ্ডার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। হাক্কানিরা আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক এবং গোয়েন্দা বিভাগের পাশাপাশি সমগ্র পূর্বাঞ্চলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। কয়েকজন প্রবীণ কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতাকে মন্ত্রিপদে বহাল করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক কমান্ডারদের ভাগ্যে ক্ষমতার শিকে ছেঁড়েনি। ফলে তাঁদের ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠা অনুগামী সেনাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে । এমনটাও শোনা যাচ্ছে যে, আদর্শগত ভাবে চালিত কিছু সেনা-কর্মী ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আই এস-কে)-এর দিকে ঝুঁকছে।

পাশাপাশি আল কায়েদা, উইঘুর (পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট), উজবেক (উজবেকিস্তানের ইসলামিক আন্দোলন), তাজিক (খতিবা ইমাম আল বুখারি) এবং পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালিবান (টি টি পি), লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ, জামাত উল আহরার, লস্কর-ই-ইসলাম এবং লস্কর-ই-জাংভির মতো গোষ্ঠীগুলিও রয়েছে। কুন্দুজ, কান্দাহার এবং কাবুলে শিয়াদের বিরুদ্ধে পূর্বে বোমা হামলার জন্য আইএস-কে এবং তালিবানদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। যদিও তালিবানরা পাকিস্তান, চিন এবং রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা আফগানিস্তানের মাটি থেকে আর কোনও আক্রমণ চালাতে দেবে না, কিন্তু বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি এত সহজে শান্তিপূর্ণ অবসর গ্রহণে নারাজ। মতাদর্শের দিক থেকে সমস্ত দলই সালাফি-জিহাদি মতাদর্শের অংশীদার। শিয়াদের উপর হওয়া যে কোনও অত্যাচারের উপরেই ইরান নজর রাখছে যেমনটা ১৯৯০-এর দশকে হয়েছিল।

প্রথম মন্ত্রিসভার তালিকা ঘোষণার প্রাক্কালে বিভিন্ন উপদলের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মতপার্থক্য নিরসনের জন্য আই এস আই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ যখন যথেষ্ট ঢাক পিটিয়েই কাবুল সফরে যান, তখনই আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের জয়যাত্রা স্পষ্ট হয়েছিল।

তালিবান মতাদর্শ হয়তো বদলায়নি, কিন্তু আফগানিস্তান অবশ্যই গত ২০ বছরে অনেকটাই পাল্টেছে। সে দেশের জনসংখ্যা ২০০১ সালে ২ কোটি ১০ লক্ষ থেকে বেড়ে ৩ কোটি ৮০ লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি অপেক্ষাকৃত নবীন দেশ, যার জনসংখ্যার গড় বয়স আঠেরো বছর ছ’মাস। দেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ৩০ বছরের কমবয়সি এবং তারা সকলেই একটি রক্ষণশীল অথচ মুক্ত সমাজে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এবং একটি জোড়াতালি দেওয়া ইন্টারনেট পরিষেবা পেয়ে বেড়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪৬ লক্ষ থেকে বেড়ে ৯০ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। কাবুলে এই বৃদ্ধি সর্বাধিক। ১৯৯০-এর দশকের ৭ লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট কাবুল বর্তমানে তিরিশ লক্ষ আফগানের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে যা ক্রমাগত শহুরে পরিকাঠামোর উপরে চাপ বৃদ্ধি করছে। এই অবস্থা প্রশাসনের সামনে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে সেগুলি ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। বেতন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব ব্যবস্থা নেই। বিদেশে সঞ্চিত অর্থভান্ডার এখনও আটকে রাখা হয়েছে এবং ঘোষিত সব মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। শীত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলি আসন্ন উদ্বাস্তু আগমন প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।

আফগানিস্তানে ঘটে চলা হিংসা এবং অস্থিরতার জন্য মার্কিন সেনার উপস্থিতিকে দায়ী করে সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে রাশিয়া, চিন, ইরান এবং পাকিস্তান গত পাঁচ বছর ধরে সরব হয়েছিল। এখন মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার ফলে এই অঞ্চলে একটি অত্যন্ত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা আফগানিস্তানকে অরাজকতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

প্রথম মন্ত্রিসভার তালিকা ঘোষণার প্রাক্কালে বিভিন্ন উপদলের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মতপার্থক্য নিরসনের জন্য আই এস আই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ যখন যথেষ্ট ঢাক পিটিয়েই কাবুল সফরে যান, তখনই আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের জয়যাত্রা স্পষ্ট হয়েছিল। হাক্কানিরা এখন পাকিস্তান এবং টিটিপির মধ্যে একটি শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করছে। টিটিপি দাবি করছে যে, তারা তাদের অধিকৃত অঞ্চলে তাদের শরিয়তি ব্যাখ্যা অনুসারে শাসন চালাবে, যা পাকিস্তানের পক্ষে মেনে নেওয়া দুষ্কর। যেমনটা প্রবাদে বলা হয় — কোনও কিছু চাওয়ার আগে ভেবেচিন্তে চাওয়াই শ্রেয়, ভবিষ্যতে তা আপনারই বিপদের কারণ হতে পারে।

উপসংহার

তালিবানরা ক্রমশ বুঝতে পারছে যে, প্রশাসন চালানোর চেয়ে বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়া সহজতর। এখন তারা একাধিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। যেমন-দলীয় সদস্যদের মধ্যে দলাদলি ও অন্তর্কলহ, পুঁজির অভাব, প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতা, ভয়ঙ্কর আইএস-কে-র মোকাবিলা করা, দেশ জুড়ে চলতে থাকা মানবিক সংকটের সম্মুখীন হওয়া, সম্ভাব্য প্রতিরোধের উত্থান এবং ক্রমশ অশান্ত হয়ে ওঠা প্রতিবেশ। আমন্ত্রণ না পাওয়া সত্ত্বেও তারা দিল্লি ঘোষণাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি বার বার আফগানিস্তানে ভারতীয় দূতাবাস চালু করা হলে তাকে স্বাগত জানানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। যদিও ভারত সরকার হাক্কানি এবং আইএসআই-এর প্রভাবের কথা মাথায় রেখে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। তা সত্ত্বেও ভারত এই অঞ্চলের অংশ (পশ্চিম যা নয়) এবং তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না। ভারত ইতিমধ্যেই মানবিকতার ডাকে সাড়া দিয়ে আফগানিস্তানে ৫০,০০০ মেট্রিক টন গম এবং জরুরি চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে দুই দেশের মধ্যে পন্থাপদ্ধতি চূড়ান্ত হলে পাকিস্তান নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে জিনিস রফতানির সুযোগ করে দেবে বলে জানিয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন একমাত্র দোহা বা এমন বহুপাক্ষিক মঞ্চগুলির মাধ্যমেই সম্ভব যেখানে পাকিস্তান ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতীয় উপস্থিতি নাকচ করতে পারবে না।


[১] দিল্লি ডিক্লারেশন অন আফগানিস্তান, মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল আফেয়ার্স, ২০ নভেম্বর, ২০২১

[২] ইন্ডিয়া অ্যান্ড আফগানিস্তান: আ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ, পাবলিকেশন বাই মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল আফেয়ার্স, ২০০৯; অ্যান্ড ইন্ডিয়া-আফগানিস্তান: আ হিস্টোরিক অ্যান্ড টাইম টেস্টেড ফ্রেন্ডশিপ, ২০১৯

[৩] এলিজাবেথ বুমিলার এবং জেন পেরলেজ, ‘পাকিস্তানস স্পাই এজেন্সি ইস টায়েড টু অ্যাটাক অন ইউ এস এম্ব্যাসি’, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১১

[৪] ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্ট্মেন্ট অব স্টেট, ‘জয়েন্ট ডিক্লারেশন বিটুইন দি ইসলামিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান অ্যান্ড দি ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা ফর ব্রিংগিং পিস টু আফগানিস্তান’

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.