সেই ৯/১১ থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তার প্রায় ২০ বছর এবং তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জমানা পার হয়ে জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নিলেন, এবং সেই সিদ্ধান্তের সমর্থনে যুক্তি দিলেন যে তিনি তাঁর পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঠিক–করা সময়সীমা অনুসরণ করেছেন। এই বোঝাপড়া আফগানিস্তানের অসামরিক সরকারকে সহায়তার মধ্যে ঠেলে দিল। ট্রাম্প এবং আফগানিস্তানে তাঁর বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ বৈধতা দিয়েছিলেন সেই তালিবানকেই, যারা আল কায়দাকে নিরাপদ বিচরণভূমি দিয়েছিল, আর তাদের তা ওসামা বিন লাদেন তালিবান শেষ বার ক্ষমতায় থাকার সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিলেন।
এখন পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে এই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ট্রাম্প সেই সময় তালিবানকে প্রথম আমন্ত্রণ জানান (এবং পরে পিছিয়ে যান) ক্যাম্প ডেভিডে। তারপর তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাতারের রাজধানী দোহায় আবার সেই প্রক্রিয়া শুরু করেন। তবে তার মধ্যে আফগানিস্তানে ‘শান্তি চুক্তি’ করার থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল দীর্ঘ দুই–দশক–ধরে চলা এমন এক যুদ্ধ থেকে মার্কিন সেনাদের বার করে আনা যা জেতা আমেরিকার পক্ষে কষ্টকর। এখন বাইডেন যুক্তি দিচ্ছেন যে তাঁর পক্ষে দোহা চুক্তি থেকে সরে আসার অর্থ দাঁড়াত তাঁর পর এক পঞ্চম মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে সেই ২০০১ সাল থেকে চলা যুদ্ধের দায় তুলে দেওয়া এবং মার্কিন সেনাদের দীর্ঘদিন ধরে চলা সেই যুদ্ধের তৃতীয় দশকে ঠেলে দেওয়া। বাইডেন বলছেন এইটা কোনও সময় তাঁর প্রশাসনের কাছে কোনও বিকল্প হিসেবে গণ্য হয়নি। প্রেসিডেন্ট দাবি করছেন তিনি এখন তালিবানদের সঙ্গে দর–কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ‘কূটনীতি, আন্তর্জাতিক প্রভাব, এবং মানবিক সাহায্যকে ব্যবহার করবেন’। তাঁর প্রশাসন মার্কিন ব্যাঙ্কে রাখা আফগান সরকারের সঞ্চিত টাকা ফ্রিজ করে দিচ্ছে, যার ফলে নতুন তালিবান জমানা শত শত কোটি মার্কিন ডলার থেকে বঞ্চিত হবে।
কেউ কল্পনাও করেনি এরকম অভাবনীয় গতিতে তালিবান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সরাসরি পৌঁছে যাবে রাজধানী কাবুলে, এবং আফগানিস্তানে নেমে আসবে নৈরাজ্যের ছায়া। দু’দশক আগে এই গোষ্ঠীর পাশবিক অত্যাচারের কথা, বিশেষ করে মহিলাদের এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর, মাথায় রাখলে গত কুড়ি বছরে নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে লিপ্ত সাধারণ আফগানদের এখন কী হবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হবেই। কিন্তু যখন কাবুল বিমানবন্দরের ছবিতে মানুষের দেশ ছাড়ার মরিয়া মনোভাব স্পষ্ট, তখনও বাইডেন অটল। তিনি বললেন, ‘কুড়ি বছর পরে আমি কঠিন ধাক্কা খেয়ে খেয়ে বুঝতে পেরেছি যে মার্কিন সেনা ফিরিয়ে আনার ভাল সময় কখনওই আসবে না।’ তিনি যুক্তি দিলেন যে আফগানরা, তাদের সরকার বা সেনাবাহিনী, তালিবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করার কোনও চেষ্টাই করেনি।
কেউ কল্পনাও করেনি এরকম অভাবনীয় গতিতে তালিবান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সরাসরি পৌঁছে যাবে রাজধানী কাবুলে, এবং আফগানিস্তানে নেমে আসবে নৈরাজ্যের ছায়া। দু’দশক আগে এই গোষ্ঠীর পাশবিক অত্যাচারের কথা, বিশেষ করে মহিলাদের এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর, মাথায় রাখলে গত কুড়ি বছরে নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে লিপ্ত সাধারণ আফগানদের এখন কী হবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হবেই।
হোয়াইট হাউসে ঠান্ডা মাথায় যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাইডেনের অনেক সমর্থককেও বিস্মিত করেছে। এমন একজন প্রেসিডেন্ট যিনি নাকি সারা পৃথিবীতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ, তিনি আফগানিস্তানে ঠিক তার বিপরীত কাজ করলেন। কাবুল থেকে যখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় উদ্বেগের খবর আসছিল, তখন ওয়াশিংটনে বিদেশনীতি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সমালোচনাকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, আর ভরসা রাখা হল সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের যুদ্ধের সমাপ্তি ও মার্কিন সেনাদের ঘরে ফেরানোর জনমতের উপর, তা তার পরিণতি যাই হোক না কেন। দু’ দশক ধরে চলা এমন এক লড়াই যার কোনও অন্ত নেই, তার থেকে যে ক্লান্তি তৈরি হয়েছে সেইটাই বাইডেনের রাজনৈতিক পুঁজি।
আফগানিস্তানকে যা অতিপরিচিত জায়গায় ফিরিয়ে আনল সেই সংক্রান্ত সব ঘটনা, তার যুক্তি, এবং যাঁরা সেই কাজগুলো করেছিলেন তাঁরা কেন, কী করলেন, এই সবের ব্যাখ্যা দিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হবে। যে ভাবে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বর্ণনা অনেক সময়েই দেওয়া হয়ে থাকে, ঠিক সে ভাবেই সাম্রাজ্যের এই প্রবাদপ্রতিম গোরস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কফিন নামানো হল। এই সময় যে মানবিক সঙ্কটের চেহারা ফুটে উঠছে, তার মধ্যে একটাই প্রশ্ন থাকবে: আমেরিকা সরে যাওয়ার পরে এ বার কে আফগানিস্তানে তৈরি হওয়া আঞ্চলিক ও বিশ্বজনীন নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে?
এ বার ওয়াশিংটন ও বেজিংয়ের ক্ষমতার লড়াইয়ে একটা নতুন পর্বের পরীক্ষা হবে আফগানিস্তানে। চিন তালিবানের থেকে এই প্রতিশ্রুতি চেয়েছে যে তার সীমান্ত অঞ্চলে ওয়াকহান করিডর যেন জিনজিয়াং প্রদেশের উইগুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ইসলামি সমর্থন দেওয়ার জন্য ব্যবহার না–করা হয়। তার পরিবর্তে চিন তালিবান জমানাকে স্বীকৃতি দেবে এবং আফগানিস্তান অর্থনৈতিক সাহায্য পাবে। চিনারা তালিবানের মোল্লা বারাদারকে গত মাসে তিয়ানজিনে শীর্ষ বৈঠকে আহ্বান করার সম্মান দিয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে আমেরিকা কি তবে এই সিদ্ধান্ত নিল যে যেখানে এতগুলো শক্তি ব্যর্থ হয়েছে সেখানে এ বার চিন বুঝে নিক তারা কী করতে পারে?
আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চিন ও মার্কিন ত্রয়ীর অংশ হিসেবে বেজিং খুব দ্রুত এগিয়ে এসে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ‘নতুন’ তালিবানের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ গড়ে তুলতে আগ্রহী। আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিশেষ দূত জামির কাবুল বলেছেন, রাশিয়া পুরো ঘটনাটা সতর্ক চোখে দেখছে এবং সময় নিচ্ছে এটা বুঝতে যে ‘এই জমানা কী রকম ব্যবহার করবে’। তারপর যাদের মস্কো এখন অবধি নিষিদ্ধ করে রেখেছে সেই তালিবানি আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন। আর এই ত্রয়ীর বাইরে চতুর্থ যে শক্তি রয়েছে সেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ইতিমধ্যেই কাবুলে তালিবানের প্রবেশকে স্বাগত জানিয়েছেন এই বলে যে আফগানিস্তান মার্কিন ‘দাসত্ব’ থেকে মুক্তি পেল।
এর কোনওটাই ভারতের পক্ষে ভাল ঘটনা নয়। কারণ দেখা যাচ্ছে যতই পরিবর্তন হচ্ছে সব কিছু ততই একই থেকে যাচ্ছে। এখন হয়তো আফগানিস্তানে আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হল, কিন্তু তার ফলে যে নৈরাজ্য তৈরি হল তা পাকিস্তানের আইএসআই এবং তালিবানের যোগসাজসের ফলে তৈরি হওয়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিপদের প্রশ্নে ভারতকে আরও দুর্বল করে দিল। আর যাই হোক, ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে আইসি ৮১৪ বিমান ছিনতাইয়ের সময় তালিবানরা কী ভূমিকা নিয়েছিল তা তো ভোলা যাবে না। যেখানে তালিবানদের হেফাজতে বিমানটি রেখে দেওয়া হয়েছিল সেই কান্দাহার বিমানবন্দর থেকে তিন সন্ত্রাসবাদীকে (জইশ নেতা মাসুদ আজহার, লস্কর–এ–তৈবা’র ওমর শেখ এবং কাশ্মীরের মুস্তাক জারগার) গাড়িতে করে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছিল এমন জায়গায় যেখানে তালিবানদের রাজ, আর তারপর তাদের পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সীমান্তপারের পাকিস্তানে। সেই দৃশ্য ভারতীয়দের স্মৃতিতে এখনও দগদগে। এত বছর বাদে আমেরিকা সরে যাওয়ার পরে ভারতের সামনে তাই বিপদের ছবি আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
কুড়ি বছর আগে, ৯/১১–র কয়েক সপ্তাহ পরে, ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিং সিএনএন–কে বলেছিলেন, ‘১১ সেপ্টেম্বর যে ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হল, আমরা গত ২০ বছরের মতো সময় ধরে সেই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি । আমরা জানি কারা এই অঞ্চলে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, এর গভীরে কী আছে এবং কী ভাবে এর মোকাবিলা করা যায়।’ ৯/১১–র অভিঘাত যখন মার্কিন দেশকে রক্তাক্ত করে রেখেছে সেই সময়, ২০০১–এর অক্টোবরে, ওয়াশিংটন পাকিস্তানের আইএসআই ও আফগানিস্তানের তালিবানের থেকে উদ্ভূত জিহাদি বিপদের মোকাবিলায় আগ্রহী মিত্র হিসেবে এগিয়ে এল। আর ভারত তখন আফগানদের সাহায্য করছিল অন্য ভাবে—তাদের পার্লামেন্ট ভবন, হাইওয়ে, জলাধার, স্কুল ও হাসপাতাল তৈরি করে দিয়ে।
৯/১১–র অভিঘাত যখন মার্কিন দেশকে রক্তাক্ত করে রেখেছে সেই সময়, ২০০১–এর অক্টোবরে, ওয়াশিংটন পাকিস্তানের আইএসআই ও আফগানিস্তানের তালিবানের থেকে উদ্ভূত জিহাদি বিপদের মোকাবিলায় আগ্রহী মিত্র হিসেবে এগিয়ে এল। আর ভারত তখন আফগানদের সহায্য করছিল অন্য ভাবে—তাদের পার্লামেন্ট ভবন, হাইওয়ে, জলাধার, স্কুল ও হাসপাতাল তৈরি করে দিয়ে।
সেই সব কাজ, সব প্রয়াস এখন বিপন্নতার মুখোমুখি। আমরা যখন আফগানিস্তানে ঘটা মানবিকতার বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেনের সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জল্পনা করব, তখন একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। তা হল আমেরিকা চায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিরাপত্তাজনিত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আর সারাক্ষণ ওয়াশিংটনের দিকে তাকিয়ে না–থেকে মধ্য এশিয়ায় তাদের পশ্চাৎভূমির দায়িত্ব নিজেরাই নিক। ভারত এখন একটা মানবিক সঙ্কটের দিকে নজর রাখছে এবং তালিবান কী ভাবে ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় পর্বে নিজেদের তুলে ধরে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। চিন কিন্তু এই বৃহৎ খেলায় ইতিমধ্যেই সর্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়েছে। এখন দিল্লিকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে তারা তাদের অপছন্দের একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে কৌশলগত কারণে যোগাযোগ গড়ে তুলবে, না আমেরিকার তৈরি করা শূন্যতা ভরাট করার ভার বেজিংয়ের (বকলমে ইসলামাবাদের) উপর ছেড়ে না–দিয়ে নিজেরাই সরাসরি মাঠে নামবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.