২০২১ বর্ষ শেষে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ঢাকায় ৫০তম বিজয় দিবস উদযাপনে সম্মানিত অতিথি হওয়ার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে সে দেশ সফরে গিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের উপস্থিতি হল ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে (যা আগে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল) যে সমর্থন দিয়েছিল তার স্বীকৃতি স্বরূপ। এই অনুষ্ঠানটি দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন, যে হেতু পঞ্চাশ বছর আগে ভারতই বাংলাদেশকে একটি পৃথক ও স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন থেকেই কৌশলগত পরিস্থিতির সুবাদে দুই দেশই একে অন্যের বৈদেশিক নীতিতে অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং এই ভিত্তিগত সুসম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে। ভারতের কাছে বাংলাদেশ যে গুরুত্বপূর্ণ, রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের সফর সেই বিষয়টিকেই স্বীকৃতি দেয়, যে হেতু অতিমারি শুরু হওয়ার পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক সফর। সীমান্তের ও পারের তরফেও এই ব্যবহারের যথাযথ প্রতিদান দেওয়া হয়েছে। কারণ ভারতীয় রাষ্ট্রপতি, তাঁর পরিবার এবং একটি সরকারি প্রতিনিধিদলই শুধু মাত্র এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট বিদেশি অতিথি রূপে আমন্ত্রিত ছিলেন।
এই উপলক্ষের রেশ ধরে রাষ্ট্রপতির সফরসূচি এমন ভাবেই নির্ধারিত হয়েছিল যাতে তিনি ১৯৭১-এর যুদ্ধের স্মৃতিসৌধগুলিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারেন। সুতরাং জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের উদযাপনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বর তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি রোডে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। ন্যাশনাল পার্লামেন্টের সাউথ প্লাজায় অপর একটি অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি হামিদকে একটি টি-৫৫ ট্যাঙ্ক এবং একটি মিগ-২৯ ফাইটার জেট উপহার দেন যা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলি জাতীয় সংগ্রহশালায় প্রদর্শিত হবে। এর পাশাপাশি ভারতীয় যুদ্ধের প্রবীণ সৈন্যদের একটি প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। নিশ্চিত ভাবেই অতীতের সম্পর্ককে ফিরে দেখার এই উদ্যোগ — যেমনটা এই কূটনৈতিক সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল — আগামী দিনে আরও বৃহত্তর সমন্বয়ের সম্ভাবনা তৈরির এক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারতের ক্রমাগত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা এবং তার ‘প্রতিবেশী দেশকে প্রাধান্য’ দেওয়ার অন্যতম কারণ হল পূর্বে নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ পূর্ব সমুদ্রতটে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূল অঞ্চল। বর্তমানে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারও। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের উচ্চাশা পূরণ করার জন্য ভারত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বৃহত্তর সমন্বয় সাধনের দিকে ঝুঁকছে। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলে চিনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে অনুকূল সম্পর্ক বজায় রাখাও ভারতের জন্য খুব জরুরি। অন্য দিকে ভারত বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটালে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি তথা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে মজবুত করে তুলতে সাহায্য করবে। তদুপরি একটি ছোট দেশ হিসেবে ভৌগোলিক ভাবে দুটি এশীয় মহাশক্তি চিন এবং ভারতের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ার কারণে উভয়ের সঙ্গে সমতা রেখে চলা এবং নিজের নিরপেক্ষতা ও স্বায়ত্তশাসনকে বজায় রাখা বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল। স্বাভাবিক ভাবেই ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই এই অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী সফরের অধিকাংশ সময় জুড়েই নিজেদের অংশীদারিত্বকে মজবুত করার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে উভয় দেশই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একে অপরের নিকটতম কৌশলগত মিত্র এবং ২০২১ সালের মার্চ মাসে জারি করা একটি যৌথ বিবৃতিতে তারা সমগ্র অঞ্চলের প্রেক্ষিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আদর্শ হিসেবে নিজেদের অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরে।
এই সৌহার্দ্য গত বছরে বিশেষ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, যখন গোটা বিশ্ব কোভিড সংকট মোকাবিলায় লড়ছিল। বাংলাদেশ ভারতের ভ্যাকসিন মৈত্রী উদ্যোগের প্রথম এবং বৃহত্তম সুবিধাভোগী ছিল, যারা মোট প্রায় ২ কোটি ২৬ লক্ষ ভ্যাকসিন ডোজ (অনুদান, বাণিজ্যিক এবং কোভ্যাক্স সহ) পেয়েছে। একই ভাবে ভারতের প্রয়োজনের সময়, অতিমারির দ্বিতীয় প্রবাহের শীর্ষে বাংলাদেশ উৎপাদিত রেমডিসিভিরের প্রায় ১০,০০০ শিশি, ৩০,০০০ পিপিই কিট এবং অন্যান্য কোভিড সংক্রান্ত ওষুধ ও সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অতিমারি এই ভাবেই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে, তাদের পারস্পরিক নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছে। রাষ্ট্রপতির সফর এই পারস্পরিক সৌহার্দ্যেরই স্বীকৃতি স্বরূপ।
তবে এই সফরটি কেবল বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সৌহার্দ্য পুনর্নিশ্চিত করার জন্য নয়। এই সফরের আর একটি উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ঘটা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ফলে দুই দেশের মধ্যে কেটে যাওয়া তালকে মেরামত করে সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করা৷ অক্টোবর মাসে যখন বাঙালিরা তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন করছিল, তখন বাংলাদেশে প্যান্ডেল ও মূর্তির উপরে আক্রমণের অনেক ঘটনা সে দেশের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল। কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘির কাছে একটি দুর্গাপূজা প্যান্ডেলে পবিত্র কোরান গ্রন্থের অবমাননা করা হয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ উঠে এলে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালি ও কক্সবাজারের পেকুয়ায় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে যাতে তিন জনের মৃত্যু হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও উত্তেজিত জনতা ঢিল ছোঁড়ে। এর পরে নিরাপত্তা বাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং রাবার বুলেট ছুড়তে বাধ্য হয়। দেশব্যাপী হিন্দু সংগঠনগুলি এই ঘটনাটিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণ হিসেবে দেখেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের এ পারের বাঙালি হিন্দুদের দ্বারাও ঘটনাটিকে একই চোখে দেখা হয়েছে যা প্রতিবেশী দেশের প্রতি তিক্ততার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
যদিও দুই দেশের সরকারই তাদের পারস্পরিক সুসম্পর্ককে বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার ফলে ভারতের বিদেশমন্ত্রক ঘটনার প্রেক্ষিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে যে, “বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে পদক্ষেপ করেছে এবং আইন বলবৎকারী শাখাগুলির ব্যবহার করেছে।’ বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির সফরও প্রতীকী ভাবে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেছে। তাঁর সফরের তৃতীয় দিনে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের ঢাকার রমনায় সংস্কার করা কালী মন্দির উদ্বোধন করার কথা ছিল যেটি মুঘল যুগে নির্মিত হয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনা মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয় এবং এ ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন। রাষ্ট্রপতির সফর অবশ্যই এই উত্তেজনার পরিবেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে এবং বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টাকেও বৈধতা দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির সফর সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর নির্ধারিত আলাপ-আলোচনা সম্পর্কেও এখনও কিছু জানা যায়নি। যদিও এটি অবশ্যই আশা করা যায় যে, তিস্তার জল বণ্টন বিতর্ক এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের সমস্যার মতো উদ্বেগের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে এই সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে কোনও বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। সর্বোপরি এই সফরটি চরিত্রগত ভাবে আনুষ্ঠানিক। তবে এর নিজস্ব একটি তাৎপর্য রয়েছে। নিজ নিজ দেশে এবং সারা বিশ্ব জুড়ে ভারত এবং বাংলাদেশ তাদের স্ব স্ব দূতাবাসে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের পঞ্চাশতম বর্ষ উদযাপন করছে। এমতাবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরকে এই গুরুত্বপূর্ণ বছরটির জন্য এক উপযুক্ত আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি বলে গণ্য করা যেতে পারে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.