Published on Jan 26, 2024 Updated 0 Hours ago
শি-র মার্কিন সফর ঘিরে একগুচ্ছ প্রশ্ন

ই নিবন্ধটি চায়না ক্রনিকলস সিরিজ-এ১৫৪তম।


চিনা নেতৃত্বের অসম্পূর্ণতা যা-ই হোক না কেন, তারা যে প্রেক্ষিতটি খুব সফল ভাবে তুলে ধরেছে, তা হল ন্যূনতম প্রত্যাশার সময়েই চমকের সৃষ্টি করা। ১৯৫৫ সালে চেয়ারম্যান মাও জে দং গোপনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলেন, যখন চিমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের সমর্থন না করে লড়াইয়ে উত্তর ভিয়েতনামী প্রশাসনকে সমর্থন করেছিল। ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়্যারের ঘটনার পর যখন সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল এই যে, চিনে অর্থনৈতিক সংস্কারের ভিত্তি তৈরি হয়েছে, তখন দেং জিয়াও পিং তাঁদক্ষিণ সফর’ করার মাধ্যমে সেই বিশ্বাসেই আঘাত হেনেছিলেন, যা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই চিনের আলোয় ফিরে আসার ধারণাকে খর্ব করেছিল। এই একই প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (এপিইসি) শীর্ষ সম্মেলনের জন্য চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মার্কিন সফরের কথা, যা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তীব্র জল্পনা-কল্পনা চলছিল।

অতিমারির পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি শি-র প্রথম সফর এবং বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দক্ষিণ চিন সাগর তাইওয়ানের মধ্যে চাপানউতোরের মধ্যেই এই সফর ঘটেছে। ১৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং শি-র মধ্যে শীর্ষ বৈঠকটি মার্কিন প্রশাসন দ্বারা চিনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের গার্ডরেল বা সুরক্ষাবলয়’ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ঘটে, যাতে দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংঘর্ষে পরিণত না হয়। বিশ্বাস করা হয়েছিল যে, এই বৈঠক দেশে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদেশে চিনের আগ্রাসনকে প্রশমিত করবে এবং একটি বিচ্ছিন্ন চিনের পরিবর্তে একটি সম্পৃক্ত চিন জটিল আন্তর্জাতিক বিরোধগুলি সমাধানে সহায়তা করবে।

বেজিং সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছে এবং অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা হ্রাস করার চেষ্টা করছে। সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অভূতপূর্ব তৃতীয় মেয়াদ অর্জনের জন্য নিজের রাজনৈতিক মূলধনকে বাজি রেখে শি-র ধারাবাহিকতা ২০৪৯ সালের মধ্যে একটি শক্তিশালী সমৃদ্ধ চিগড়ে তোলার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

 

বেজিং সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছে এবং অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা হ্রাস করার চেষ্টা করছে।

 

বাইডেনের যুগে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ‘ডি-রিস্কিং’ বা ‘ঝুঁকিমুক্তিকরণ’-এর উপর, যাকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান স্থিতিস্থাপক সরবরাহ শৃঙ্খল’ নির্মাণ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি হল, সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির উপর রফতানি বিধিনিষেধ এবং চিনের উন্নত প্রযুক্তি খাতে বহিরাগত বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা

যাই হোক, পশ্চিমের ঝুঁকিমুক্ত প্রচারাভিযানের চিনা মূল্যায়ন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে তুলে ধরা হয়েছে চিনের সেন্ট্রাল ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশনের বক্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে বলা হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি কঠিন পরিস্থিতি বিদ্যমান এবং পার্টি-রাষ্ট্রকে অবশ্যই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। চায়না ইনস্টিটিউট অ কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের লি ওয়েই বলেছেন যে, এর অর্থ হল চিএকতরফা বাণিজ্য সুরক্ষা’র তরফে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

চিনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের একটি ভাষ্যে চিন-মার্কিন সমীকরণের প্রতিযোগিতার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছে, যদি  সম্পর্কটিতে প্রতিযোগিতা প্রাধান্য পায়, তা হলে তা সংঘর্ষ ঠান্ডা লড়াইয়ে পর্যবসিত হওয়া অনিবার্য। ভাষ্যটিতে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, মার্কিন ধারণার - যা চিনকে একটি পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জ এবং সবচেয়ে গুরুতর প্রতিযোগী বলে মনে করে - ফলস্বরূপ সম্পর্কের এই প্রতিযোগিতাটিকে একটি ‘মতাদর্শগত আঙ্গিক’-এ দেখা উচিত। অর্থাৎ ভাষ্যটিতে বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারীদের প্রতিহত করার কাঠামোর কথা উল্লেখ করা হয়েছেএর পরিবর্তে, জিনহুয়া-র একটি নিবন্ধে যুক্তি দর্শানো হয়েছে, যে ভাবে উভয় অর্থনীতি জটিল ভাবে একে অন্যের সঙ্গে জড়িত, তাতে তারা একে অপরের উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যার পরিণতি বহন করতে পারে না। বরং এর পরিবর্তে, চিন প্রস্তাব করেছে যে বিশ্বের বিশালত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, ‘(একে অপরের)  উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সমৃদ্ধি’র জন্য উভয়ের জন্যই জায়গা করে দেওয়া বিচক্ষণতার কাজ হবে। মার্কিন শ্রোতাদের কাছে শি-র বার্তাটি এ হেন অনুভূতির অনুরণন ঘটায়। কারণ শি বলেছিলেন যে, চিনের উত্থান অভ্যন্তরীণ ভাবে শান্তিপূর্ণ এবং চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ বা প্রতিস্থাপন করার ইচ্ছা রাখে না। শি আরও জোর দিয়ে বলেন যে, চিন কোনও সংঘাত শুরু করেনি বা অন্য দেশের ভূখণ্ড দখল করেনি। তবে চিন বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে সর্বাধিক লাভবান হয়েছে এবং সেই ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করতে তারা প্রস্তুত। এ বার শি-র বক্তব্যকে ব্রিকস সম্মেলনের সময় চিনের কমিউনিস্ট  পার্টির দলীয় সংবাদপত্রের আখ্যানের সঙ্গে তুলনা করা যাক যেখানে বলা হয়েছে, এই একই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা অতীতের নৈরাজ্যসম, যা কিনা গ্লোবাল সাউথের বেশির ভাগ ক্ষতি এবং অসাম্যের জন্য দায়ী। সংবাদপত্রে দাবি করা হয়েছে যে, চিনের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ এবং ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি আরও বেশি সমতাবাদী ছিল। অর্থাৎ চিএমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রচার করছে, যা যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সঙ্গত। কয়েক মাস আগে শি একটি প্রতিদ্বন্দ্বী আন্তর্জাতিক কাঠামোকে সমন্বিত করার জন্য যথেষ্ট চাপ দিয়েছিলেন যার অর্থ হল চিনের সঙ্গে যুক্ত ব্রিকস এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) মতো বহুপাক্ষিক ব্লকগুলিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করা এবং নয়াদিল্লিতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এড়িয়ে যাওয়া। বিদেশে প্রভাব বিস্তারের এই নতুন আত্মবিশ্বাস কমিউনিস্ট পার্টির প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথিত শ্রেষ্ঠত্ব থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয়।

 

ভারতকে তাই এ বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে যে, তার কোয়াড অংশীদাররা চিনের উপর কতটা বাজি ধরছে।

 

চিন যদি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে এতটাই বেশি লাভ করে থাকে, তা হলে শি-র দাবি কি এই ইঙ্গিত দেয় যে তাঁর দেশ এখনও সেই ব্যবস্থার উপরেই নির্ভরশীল? নিজের স্বীকারোক্তিতে শি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের কথা উল্লেখ করেন - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি, পশ্চিমী প্রযুক্তি এবং মূলধন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে চিনের উত্থানকে চালিত করেছিল। এই আকস্মিক উচ্চারণের অর্থ কি এই যে, শি বিশ্বনেতৃত্বের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুল করেছিলেন? কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্ব কি আক্ষরিক অর্থে শি-র এই নরম মনোভাব গ্রহণ করতে পারে? এর বিপরীতে, টি কি আরও সময় নেওয়ার ছল, যাতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সামনে নিজের পছন্দমতো সময়ে আরও কার্যকর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার জন্য চিন তার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ পায়? দ্বিতীয়ত, শি মার্কিন মাটিতে শান্তির বাগাড়ম্বর করলেও, চিনা উপকূলরক্ষীরা দক্ষিণ চিন সাগরের সৈকতে আটকে পড়া একটি জাহাজ পুনঃপূরণের জন্য পাঠানো ফিলিপিনো জাহাজগুলিকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, চিন দক্ষিণ চিন সাগরে নিজেদের স্বকীয়তা পুনরুদ্ধার করেছে এবং নানাবিধ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও তার সামরিকীকরণ করেছে। চিনেআগ্রাসী মনোভাব সম্ভবত মার্কিন শক্তিকে পরীক্ষার মুখে ফেলবে, যেটি ইতিমধ্যে রুশ-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এবং ইরায়েল-হামাস যুদ্ধে জর্জরিত। সে ক্ষেত্রে, চিনে(একে অপরের) উন্নয়নকে অগ্রাধিকার রক্ষা’র প্রস্তাব দেওয়া এবং উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থের উপর জোর দেওয়া উচিত কি এই তাৎপর্যই বহন করে যে, এশিয়াকে চিনা প্রভাবের বলয় হিসেবে মেনে নিয়ে জমি ছেড়ে দিলে চিন বিশ্বের অন্যত্র মার্কিন স্বার্থকে সম্মান করবে? সবশেষে এবং ভারতের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, চিন যখন বলে যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল - যা আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করেছে - ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে’, তার আসল অর্থ কী? বাইডেন-শি শীর্ষ বৈঠকটি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের বেজিং সফরের আগে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কে প্রলেপ দেওয়ার জন্য হয়েছিল। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাও শি-সঙ্গে দেখা করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বাণিজ্য বিষয়ে নতুন আলোচনার ঘোষণা করেছেন। চিন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া ত্রিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা চলছে। ভারতকে তাই এ বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে যে, তার কোয়াড অংশীদাররা চিনের উপর কতটা বাজি ধরছে।


কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.