সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সবচেয়ে উদ্যমী পরিকাঠামোগত সংযোগের কাজকর্ম আবর্তিত হচ্ছে ‘মিশন পূর্বোদয়’কে ঘিরে, যা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। একটি নিষ্ক্রিয় বাজার থেকে দেশকে একটি সক্রিয় ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত করার লক্ষ্যে স্থিত এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য স্বনির্ভর ভারতকে শক্তি জোগানো, যাতে এই দেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘ক্ষমতার গুণক’ বা ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য প্রাথমিক ভাবে নজর দেওয়া হয়েছে ও উন্নয়নের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে পূর্ব ভারতকে, যার অভ্যন্তরে ভারতকে বৃহত্তর বহুপাক্ষিক মঞ্চগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গভীরতর যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই বিষয়টির সূচনা হয়েছিল অপরিশোধিত ইস্পাতকে মূল্যযুক্ত ইস্পাতে রূপান্তরিত করার জন্য ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে একটি সমন্বিত স্টিল হাব তৈরির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে। কিন্তু আদতে বিষয়টি তার থেকেও অনেক বড়, এবং এর লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়া ও তারও বাইরে সামগ্রিক আঞ্চলিক সংহতি তৈরি করা।
ভৌগোলিক তাৎপর্য: কেন নেপাল
পূর্ব ভারতীয় সংযোগের সূত্র ও অক্ষ যেমন বঙ্গোপসাগরীয় উপ-অঞ্চলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত, তেমনই বহুপাক্ষিক সংযোগের মঞ্চ হিসেবে বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেকটোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)–এর উপস্থিতির কারণে তৈরি হওয়া সুযোগগুলির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ভারতীয় কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা যে পূর্বোদয়–এর মতো কাঠামো নিয়ে পুবের দিকে নজর স্থানান্তরিত করেছেন, তা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। কারণ এই ক্ষেত্রটি সম্ভাবনাময় ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর। ১৬০ কোটি মানুষ, ৩ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি যা বিশ্বের জিডিপি বা মোট আভ্যন্তর উৎপাদনের ৪ শতাংশ, এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৩.৭ শতাংশের অংশীদার হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌবাণিজ্য পথ, সব মিলিয়ে এই ক্ষেত্রটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গেই এই ক্ষেত্রটি এখানে অবস্থিত দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ সংযোগের জন্য আরও ভাল কাঠামোগত উপস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অবকাশ তৈরি করেছে। এই ক্ষেত্রটির কৌশলগত তাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত চেষ্টা করছে, বিশেষ করে কোভিড–১৯ অতিমারির প্রতিক্রিয়ায়, এখানে আরও কুশলী ভাবে যুক্ত হতে। এ ক্ষেত্রে ভারতের লক্ষ্য হল সংযোগের উন্নততর পদ্ধতির মাধ্যমে এখানকার বর্তমান পুঁজির অপ্রতুলতা ও বৃহৎ আন্তঃসীমান্ত প্রকল্পগুলির জন্য তৃতীয় দেশের অংশীদারদের উপর নির্ভর করার বাধ্যবাধকতার শূন্যতা পূরণ করা।
তা ছাড়াও এই বৃহত্তর মঞ্চের মধ্যে ভারত এমন একটি স্থান চিহ্নিত করেছে এবং নজরে রেখেছে, যা এই মুহূর্তে প্রাণশক্তিতে ভরপুর: তা হল ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল। এই অঞ্চলটির সংলগ্ন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আরও বেশি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ আছে। বঙ্গোপসাগরীয় উপ-অঞ্চলে ছাপ ফেলার সূচনাবিন্দু হিসেবে ভারত উত্তর-পূর্বের সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করতে সক্রিয় হয়েছে, কারণ এটি দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলের ৮ শতাংশ এবং এর সংলগ্ন আন্তর্জাতিক সীমান্ত ৫,৩০০ কিলোমিটার, যা আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের সহায়ক। ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঘরের সেই সম্পদগুলো সদ্ব্যবহারের যেগুলোর পূর্ণ সম্ভাবনা এখনও অবধি বাস্তবায়িত হয়নি, যেমন উন্নত ও আধুনিকীকৃত আন্তঃসীমান্ত সরবরাহ শৃঙ্খল, আধুনিক পরিবহণ, ই-কমার্স যোগাযোগ এবং সীমান্ত কাঠামো। তবে, কার্যক্ষেত্রে এই অঞ্চলটিতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসে এখানকার ছোট-বড় বিদ্রোহ, অভিবাসন, পরিবেশগত চাপ ও অপরাধমূলক ঘটনা। এর ফলে এখানকার প্রকল্পগুলির স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্ব এবং স্থানীয় অংশীদারদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে কিছু বড় বাধা আছে, এবং সেই কারণে ভারতকে প্রত্যাশিত গতির চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ধীর গতিতে এগোতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নেপালের মতো ছোট দেশগুলোর বিষয়টি বার বার সামনে আসছে, এবং ভারতের জন্য অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব দাবি করছে। নেপাল যে শুধু এই মুহূর্তের জটিলতা মোকাবিলায় সহায়তা করছে তা নয়, সেই সঙ্গে উন্নয়নমূলক সহায়তা পেয়ে নিজেও জেতার চেষ্টা করছে, যাতে সম্প্রতি নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর সে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথ তৈরি করতে পারে। সাম্প্রতিক কালে ভারত ও নেপালের মধ্যে রেলপথ, রাস্তা ও সমন্বিত চেকপোস্টের ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
একদম সাম্প্রতিকতম নির্মাণের উদাহরণ হল জয়নগর-বিজলপুর-বর্দিবস রেল (৬৮.৭২ কিমি) প্রকল্পের অন্তর্গত ভারত ও নেপালের মধ্যে জয়নগর-কুর্থা আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগ (৩৯.৪০ কিমি)। এর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা দিয়েছে ভারত, এবং তার পরিমাণ প্রায় ৫৫০ কোটি। জয়নগর ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে, এবং এই পথে জনকপুরও রয়েছে, যা নেপালের জন্য তীর্থযাত্রী সমাগমের একটি বিশিষ্ট স্থান। কাজেই এর ফলে এই অঞ্চলে ধর্মীয় পর্যটন নেটওয়র্কও শক্তিশালী হয়েছে। এর সূত্র ধরে দুই দেশ আরও আন্তঃসীমান্ত রেল–নেটওয়র্কের জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক করছে। এর মধ্যে সর্বশেষ হল পঞ্চম যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং সপ্তম প্রোজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকগুলি, যেগুলি ২০২১–এর ৬–৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রক্সৌল ও কাঠমান্ডুর মধ্যে প্রস্তাবিত ব্রড-গেজ রেলপথ, ও ভারত সরকারের অনুদান–সহায়তায় নির্মীয়মান ভারত ও নেপালের মধ্যে যোগবাণী-বিরাটনগর ব্রডগেজ রেলপথের জন্য একটি সমঝোতা–পত্রও (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
একই ভাবে, সাউথ এশিয়া সাব–রিজিওনাল ইকনমিক কোঅপারেশন রোড কানেক্টিভিটি ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম–এর আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সহায়তায় দুই দেশ একই সঙ্গে মেচি নদীর উপর সেতু ও তার অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণে কাজ করছে। ছয় লেনের ৬৭৫ মিটার দীর্ঘ সেতু ও ১৫ মিটার যানবাহন আন্ডারপাস নেপাল ও ভারতের দিককার সীমান্তকে যুক্ত করার পাশাপাশি নেপালের কাকরভিট্টা ও ভারতে এশিয়ান হাইওয়ের প্রস্তাবিত পানিটাঙ্কি বাইপাসকে সংযুক্ত করে (এএইচ ০২)। নেপালে অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য ৫৪৭ মিটার। এই প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে (এনবি-এনইআর) প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা সম্প্রসারিত হবে। একই সঙ্গে এটি উত্তরবঙ্গ–সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি দেশের (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মায়ানমার ও নেপাল) জাতীয় মহাসড়ককে উন্নত ও সংযুক্ত করতে সহায়তা করবে।
একই সঙ্গে বিভিন্ন নতুন সমন্বিত চেকপোস্টের উন্নয়নে দুই সরকার মনোযোগী হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে ভারত ও নেপালের মধ্যে প্রস্তাবিত শেষতমটি তৈরি হবে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার পানিটাঙ্কিতে, যে জেলাটি উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান জেলাগুলির মধ্যে একটি। এটি হবে রক্সৌল -বীরগঞ্জ, যোগবাণী-বিরাটনগর, সুনাউলি ও রূপাইডিহাতে এখনকার চেকপোস্টগুলির অতিরিক্ত একটি। এই সমন্বিত চেকপোস্টগুলি শুধু মানুষের আন্তঃসীমান্ত যাতায়াত আরও সহজ করতে সাহায্য করবে না, সেই সঙ্গেই বাণিজ্যিক যানবাহনগুলির দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থাও হবে। এর ফলে আশপাশের এলাকার সঙ্গে বাণিজ্য ও যোগাযোগ আরও ভাল ভাবে গড়ে উঠবে।
উপসংহার
এই অঞ্চলে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)–এ নেপালের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার হয়ে ওঠার ঘটনাই যে এখন ভারতের এই সব কাঠামোগত ব্যবস্থা নেওয়ার অন্যতম কারণ, তাতে সংশয় নেই। বেশ কিছু নীতি নির্ধারক এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মতে, চিনের সঙ্গে এক মরিয়া অন্ধ লড়াই চালানো এবং ফলস্বরূপ সম্ভাব্য নানা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে এখন সংযোগ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির নির্বিবাদী মাত্রার দিকেই মনোনিবেশ করা উচিত। এটা অজানা নয় যে চিন ২০১৯ সালে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেপাল সফরের সময় থেকেই ট্রান্স হিমালয়ান- মাল্টিডাইমেনশনাল কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্কের মতো বেশ কয়েকটি সংযোগ প্রকল্পে নেপালে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে কাঠমান্ডু-কেরুং আন্তঃসীমান্ত রেলপথের উপর। এখন, ভারতীয় পূর্বোদয়কে পূর্বের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরা হতে পারে। এটির বিশেষ উপযোগিতা থাকছে হিমালয়ের দেশ নেপালের ক্ষেত্রে, যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত আছে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পূর্বে ভারতের নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ, যা চিনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিদেশনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক গ্রন্থি। কারণ চিন ইতিমধ্যেই এখানে পা রেখেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.