চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) এক দশকপূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে চিনা ভাইস প্রিমিয়ার হে লিফেং ইসলামাবাদে অবতরণ করার কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তান গত কয়েক বছর ধরে যে চিরস্থায়ী অতল গহ্বরের দিকে এগিয়ে চলেছে, সেই সংক্রান্ত আর একটি উদাহরণ প্রকাশ্যে উঠে আসে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ৪৫ জন নিহত এবং ২০০ জনেরও বেশি আহত হন।
আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাজাউরের উপজাতীয় এলাকায় ইসলামপন্থী জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম-ফজল (জেইউআই-এফ) এই সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। জেইউআই-এফ পাকিস্তানে ক্ষমতায় থাকা পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের অংশ এবং প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ সন্ত্রাসবাদীদের ‘অস্তিত্ব নির্মূল’ করার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর জোর দিয়েছেন। কারণ এই সন্ত্রাসবাদীরা ‘ইসলাম, কোরান এবং পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে।’
পাকিস্তান তালিবান অথবা টিটিপি নভেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতি শেষ করার পর দেশব্যাপী ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে এবং সর্বশেষ হামলার পরে তারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে যে, তাদের লক্ষ্য হল ইসলামপন্থীদের একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া। আফগান তালিবানও বোমা হামলার তীব্র সমালোচনা করেছে। পাকিস্তানের ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএসকেপি) অবশেষে এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়ে বলেছে, এটি ‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্যমান যুদ্ধের’ই এক অংশ। আইএসকেপি এই অঞ্চলে বেশ সক্রিয় ছিল এবং অতীতেও তারা জেইউআই-এফ-এর আধিকারিকদের উপর হামলা চালিয়েছে।
সামরিকই হোক বা প্রশাসনিক… পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই এ হেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম বলে মনে হচ্ছে না।
পাকিস্তানের জন্য একাধিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বেড়েই চলেছে এবং সর্বশেষ হামলাটি ২০১৪ সালের পর থেকে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে ঘটা নিকৃষ্টতম হামলার অন্যতম। এই ঘটনা এ কথাই দর্শায়, যে দেশটি অতীতে রাষ্ট্রীয় নীতির একটি হাতিয়ার হিসাবে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করে এসেছে, সেই দেশই আজ ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। সামরিকই হোক বা প্রশাসনিক… পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই এ হেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম বলে মনে হচ্ছে না।
এমন এক সময়ে যখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই অনিশ্চিত, তখন এই রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা বিশেষ ভাবে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। চিন পাকিস্তানকে তার ঋণের বোঝা মোকাবিলায় সাহায্য করলেও তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান চিন-পাকিস্তান অংশীদারিত্বের জন্য মোটেও ভাল নয়। সিপিইসি-র এক দশকপূর্তি উদ্যাপনে দেওয়া বার্তায় চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট যে ভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন, চিন সব সময় পাকিস্তানের পাশে থাকবে।’ তিনি অবশ্য এ কথাও বলেন যে, প্রকল্পটি ‘যে কোনও পরিস্থিতিতেই চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন’ এবং সিপিইসি ‘নতুন যুগে এক অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য ঘনিষ্ঠতর চিন-পাকিস্তান সম্প্রদায় গড়ে তোলার নেপথ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।’ বেশ কিছু দিন ধরেই এ কথা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ সিপিইসির গতির উপরেও প্রভাব ফেলছে। বাস্তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে যৎসামান্যই অগ্রগতি লক্ষ করা গিয়েছে।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সিপিইসি-র তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তারা চিনা নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। দায়িত্ব এড়াতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্য আফগানিস্তান এবং তার তালিবান সরকারকে দায়ী করছে। এটি এমন একটি দেশের জন্য এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যে তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে সন্ত্রাসবাদ রফতানির নিরিখে বা সন্ত্রাসবাদ চালানোর ঘটনায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানের পি প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কও এই চ্যালেঞ্জের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চিন পাকিস্তানকে তার ঋণের বোঝা মোকাবিলায় সাহায্য করলেও তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান চিন-পাকিস্তান অংশীদারিত্বের জন্য মোটেও ভাল নয়।
চিনের ভাইস প্রিমিয়ার হে লিফেং-এর সফরে পাকিস্তান ও চিন আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধি করতে এবং সিপিইসি প্রকল্পে গতিশীলতা আনতে আরও ছ’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও কার্যকর ভাবে মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুপস্থিতিতে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর কী ভাবে সিপিইসি-কে সাহায্য করবে, তা সহজেই অনুমেয়। যাই হোক, বেজিং ইসলামাবাদকে সরাসরি বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত চিনা নাগরিক এবং সম্পদ রক্ষা করার কথা বলেছে।
একটি সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। রাজনৈতিক মেরুকরণ পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থার পক্ষে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কোনও জাতীয় পন্থার নির্মাণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন জোটের তরফে অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের কার্যকারিতার অভাব বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, যা যুবসম্প্রদায়কে চরমপন্থী মতাদর্শ ও কৌশলের পথে চালিত করেছে।
বহিরাগত শক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ভাবে লড়ার জন্য পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ যে সম্পদ কাজে লাগাবে বলে ভেবেছিল, তা বর্তমানে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের তৈরি করা দানবটিকে নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, বশে আনাও সম্ভব নয়। দিগ্ভ্রান্ত পাকিস্তান এক সঙ্কট থেকে অন্য সঙ্কটের দিকে ছুটে চলেছে এবং সে দেশের রাজনৈতিক অভিজাতরা দেশকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সম্পূর্ণ সন্দিহান। ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় ইসলামাবাদ সাহায্যের শেষ উপায় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই মনে করলেও, চিন বর্তমানে সেই জায়গা দখল করেছে। এমন এক দেশ, যে এক সময় আঞ্চলিক নেতৃত্বের জন্য ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখত, বর্তমানে সেই দেশটিই আঞ্চলিক উন্নয়নমূলক আখ্যানের নিরিখে প্রান্তিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে। আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তান সম্পর্কে আগ্রহ তলানিতে ঠেকেছে, যা সঙ্কট-সংক্রমিত দেশটিকে পুনরায় নিজেকে সামলে ওঠার চ্যালেঞ্জটিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। পাকিস্তানে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের কারণে নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তাই ভারত এবং অবশিষ্ট বিশ্বকে খারাপতম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.