৭-৮ ডিসেম্বর ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন দের লেইন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল ২৪তম ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-চিন শীর্ষ সম্মেলনের জন্য বেজিংয়ে এসেছিলেন। গত চার বছরের মধ্যে এই প্রথম দুই দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত স্তরে সাক্ষাৎটি ইইউ-চিন সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ঘটেছে।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ববর্তী ইইউ-চিন ভার্চুয়াল সম্মেলনের সময়ে ইউক্রেন সংঘাতই ছিল ইউরোপীয়দের জন্য প্রাথমিক আলোচনার বিষয়বস্তু এবং জলবায়ু ও অর্থনীতির মতো অন্য বিষয়গুলিকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
এ বার অবশ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থনীতিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে ১৫ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ গঠনমূলক বৈঠকের ফলে মার্কিন-চিন উচ্চ-পর্যায়ের সামরিক আলোচনা ফের শুরু হয়েছে এবং তাইওয়ানের বিষয়ে শি-র আশ্বাস ইইউ-কে অর্থনৈতিক চাপানউতোর সমাধানের পথ প্রদান করেছে।
ঘাটতি, নির্ভরতা এবং ঝুঁকিমুক্তকরণ
ইইউ-চিনের দৈনিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২.২ বিলিয়ন ইউরো হওয়ার দরুন ইইউ চিনের সঙ্গে তার পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ২০২২ সালে সেই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪০০ বিলিয়ন ইউরো। চিনে ইইউ রাষ্ট্রদূত জর্জ টলেডো এই পরিমাণকে ‘মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ’ বলে উল্লেখ করেন। বিদেশি সংস্থাগুলির জন্য চিনের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের প্রেক্ষাপটে ইইউ দুপক্ষের জন্য একই রকম সুবিধাযুক্ত বাণিজ্যিক ক্ষেত্র এবং বাণিজ্যে বৃহত্তর পারস্পরিকতার বিষয়ে আগ্রহী।
বিরোধের আর একটি প্রধান ক্ষেত্র হল বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) মতো মূল শিল্প রফতানি খাতে ভর্তুকি প্রদান করার ফলে চিনের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা যা ইউরোপীয় অটোমোটিভ শিল্পকে দুর্বল করে তুলেছে। ইউরোপীয় কমিশন ইতিমধ্যে ইভি খাতের জন্য একটি তদন্ত শুরু করেছে এবং বর্তমানে বায়ু শক্তি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম-সহ অন্য প্রধান খাতগুলি বিবেচনা করে দেখছে।
বিরোধের আর একটি প্রধান ক্ষেত্র হল বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) মতো মূল শিল্প রফতানি খাতে ভর্তুকি প্রদান করার ফলে চিনের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা যা ইউরোপীয় অটোমোটিভ শিল্পকে দুর্বল করে তুলেছে।
এর পাশাপাশি ইউরোপ চিন থেকে আসা লিথিয়াম এবং গ্যালিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যা দূষণহীন রূপান্তরের জন্য অপরিহার্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঁচামালের ৯০ শতাংশের বেশি চিন থেকে সরবরাহ হলেও ইইউ তার ক্রিটিক্যাল র মেটেরিয়ালস অ্যাক্টের মাধ্যমে এই নির্ভরতাকে মোকাবিলা করার লক্ষ্য রাখে।
দক্ষিণ চিন সাগরে চিনা আগ্রাসন, জিনজিয়াং-এ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অতিমারি-যুগের সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধার মতো কারণগুলি চিন সম্পর্কে ইউরোপীয় ধারণার অবনতি ঘটিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বে বেজিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইইউ-এর তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি মস্কোর সঙ্গে চিনকে ইতিবাচক ভাবে তার প্রভাব ব্যবহার করতে ইউরোপীয় নেতাদের ব্যর্থতার কারণে ইইউ-চিন সম্পর্কের নিম্নমুখিতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুতরাং বাণিজ্যিক ঘাটতির পাশাপাশি ব্যাপক আস্থার ঘাটতিও দেখা গিয়েছে।
৬ নভেম্বর শীর্ষ সম্মেলনের মাত্র এক মাস আগে ভন দের লেইন তাঁর বক্তৃতায় ‘চিনকে বিশ্বের উপর কম নির্ভরশীল করতে ও বিশ্বকে চিনের উপর আরও নির্ভরশীল করার প্রয়াসের নিরিখে’ ‘চিনের পরিবর্তিত বিশ্ব ভঙ্গি’র বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। চিনকে ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে স্বীকার করে নেওয়ার সময় তিনি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে ‘প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক সুস্পষ্ট উপাদান’-এর উপরেও জোর দেন।
অশ্রুত আলোচনা?
ইইউ এবং তার সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের চিন নীতি পুনঃসংশোধন করছে এবং জার্মানির মতো দেশগুলি তাদের পদ্ধতির রূপরেখার জন্য চিন-নির্দিষ্ট নথি প্রকাশ করেছে। ইইউ-এর ‘ঝুঁকিমুক্তকরণ’ কৌশলটির লক্ষ্য হল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমানো। এর পাশাপাশি নিজেদের নীতিপ্রক্রিয়া সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইউনিয়ন অন্তর্মুখী-বহির্মুখী বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক যাচাইকরণ, জবরদস্তির বিরোধী উপকরণ ও দ্বৈত-উদ্দেশ্যসম্পন্ন প্রযুক্তির রফতানি নিয়ন্ত্রণ-সহ বিভিন্ন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করছে। একটি বিবর্তিত ইউরোপীয় পদ্ধতির এই প্রেক্ষাপটে শীর্ষ সম্মেলনটি ইইউ-চিন পর্যবেক্ষকদের কাছে বহুপ্রত্যাশিত ছিল।
সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও উচ্চ-স্তরের কূটনৈতিক আদান-প্রদান পুরোদমে অব্যাহত রয়েছে এবং যার মধ্যে বেশ কয়েকটিকে – যেমন এপ্রিল মাসে ভন দের লেইনের চিন সফর, সেপ্টেম্বর মাসে ইইউ ট্রেড কমিশনার ভালদিস দোমব্রোভস্কিসের সফর এবং অক্টোবর মাসে ইইউ বিদেশ নীতি প্রধান জোসেপ বোরেলের সফর – এই শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে মনে করা যেতে পারে।
ইইউ-এর ‘ঝুঁকিমুক্তকরণ’ কৌশলটির লক্ষ্য হল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমানো। এর পাশাপাশি নিজেদের নীতিপ্রক্রিয়ার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইউনিয়ন অন্তর্মুখী-বহির্মুখী বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক যাচাইকরণ, জবরদস্তির বিরোধী উপকরণ ও দ্বৈত-উদ্দেশ্যসম্পন্ন প্রযুক্তির রফতানি নিয়ন্ত্রণ-সহ বিভিন্ন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করছে।
একটি মন্থর চিনা অর্থনীতি ইউরোপকে তার অর্থনৈতিক সুবিধা পরিচালনা করার সুযোগ দেয়। যাই হোক, ইউরোপের চিন নীতি সংক্রান্ত ধূসর ক্ষেত্রগুলি বিদ্যমান, বিশেষ করে পদক্ষেপের বাস্তবায়ন এবং আরও কার্যকর সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে। প্রায়শই সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজের মতো নেতাদের অন্য সব কিছুর চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতার কারণে আপস করা হয়। এ ভাবে অর্থনৈতিক সুযোগ ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে ইউরোপ কী ভাবে লাভজনক চিনা বাজারের সঙ্গে তার আন্তঃনির্ভরতা পরিচালনা করবে, তার জবাব সময়ই দেবে।
পূর্ববর্তী ইইউ-চিন শীর্ষ সম্মেলন থেকে কোনও যৌথ বিবৃতি উঠে আসেনি এবং সেই অনুযায়ী এই শীর্ষ বৈঠকটিরও তেমন বিবৃতি তুলে ধরার সম্ভাবনা ছিল কম। তবুও ইইউ-র জন্য অমীমাংসিত উদ্বেগগুলিকে সামনে তুলে ধরা এবং কিছু সাধারণ ভিত্তি তৈরি করার সুযোগ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে সম্মেলনটিকে। নির্দিষ্ট ফলাফল ছাড়াই শীর্ষ সম্মেলনটির ‘অশ্রুত আলোচনা’ হওয়ার ঝুঁকি ছিল, যেমনটা বোরেল আগের সম্মেলনটিকে অভিহিত করেছিলেন।
পুনর্নবীকৃত ট্রান্সআটলান্টিক সংহতির মধ্যে বেজিংয়ের নানাবিধ বাগাড়ম্বর এই ইঙ্গিত দেয় যে, চিন ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এবং ওয়াশিংটনের প্রভাব থেকে সরে এসে চিনের জন্য আরও স্বাধীন ইউরোপীয় নীতিতে আগ্রহী। তবুও ব্রাসেলসের জন্য এই পুনর্মিলন হবে বেজিংয়ের মৌলিক ভিন্নতা মোকাবিলার ইচ্ছার শর্তসাপেক্ষে।
শায়েরী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.