Published on Feb 05, 2022 Updated 0 Hours ago

দুই দেশের মধ্যে সামরিক আলোচনার ১৪তম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে। কিন্তু অবস্থার কোনও প্রকৃত পরিবর্তন ঘটেনি।

চিন-ভারত সামরিক আলোচনায় অচলাবস্থা

দুই দেশের মধ্যে ২০২০ সালের মাঝামাঝি শুরু হওয়া সীমান্ত সমস্যার সমাধানে ভারত এবং চিন সম্প্রতি ১৪তম সামরিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। কোর কম্যান্ডার পর্যায়ের এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় চুশুল-মলদো সীমান্ত ঘাঁটিতে, যেটি দুই দেশের সেনাকে পৃথককারী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল-এর (এল এ সি) পাশে চিনের দিকে অবস্থিত। আলোচনার পর প্রকাশিত এক যৌথ প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, ‘এল এ সি বরাবর পশ্চিম ক্ষেত্রের প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলির সমাধানসূত্র সন্ধানে দুই পক্ষই খোলাখুলি এবং গভীর ভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছে। দেশগুলির শীর্ষ নেতৃত্বের দেওয়া নির্দেশ মেনে চলা এবং অবশিষ্ট সমস্যার যথাসম্ভব দ্রুত সমাধান করার বিষয়েও উভয়পক্ষই সহমত পোষণ করেছে।’ দুই পক্ষই এ কথাও বিশ্বাস করে যে, ‘এর ফলে এল এ সি বরাবর পশ্চিম ক্ষেত্রটিতে শান্তি ও স্থিতাবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও উন্নতি ঘটবে।’ তারা এ-ও জানিয়েছে যে তারা ‘ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ’ রাখবে এবং কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় পথ ব্যবহারের মাধ্যমে ‘অবশিষ্ট সমস্যার দ্রুততার সঙ্গে সমাধান সূত্র খুঁজে বের করবে।’

আলোচনার পর প্রকাশিত এক যৌথ প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, এল এ সি বরাবর পশ্চিম ক্ষেত্রের প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলির সমাধানসূত্র সন্ধানে দুই পক্ষই খোলাখুলি এবং গভীর ভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছে।

এই কোর কম‍্যান্ডার স্তরের আলোচনায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন লে-ভিত্তিক ১৪ কোর-এর নতুন ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অনিন্দ্য সেনগুপ্ত এবং চিনের তরফে এই দায়িত্বে ছিলেন দক্ষিণ শিনজিয়াং সামরিক জেলার প্রধান মেজর জেনারেল ইয়াং লিন। গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আলোচনার ১৩তম অধিবেশনে কোনও লাভ হয়নি এবং সেটি এক অচলাবস্থায় শেষ হয়। নিরাপত্তা বিভাগের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলির মতে, পারস্পরিক আলোচনার ১৪তম পর্বে ভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিল হট স্প্রিং (পেট্রলিং পয়েন্ট ১৫) থেকে চিনা সেনা প্রত্যাহার এবং ‘পূর্ব লাদাখের অন্যান্য সংঘাত স্থান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সেনাদল সরিয়ে নেওয়া’র উপরে জোর দেওয়া। দেপসাং বালজ ও ডেমচক সমস্যা নিয়েও ভারত আলোচনা করতে চেয়েছিল।

দুই পক্ষের মধ্যে বর্তমান আলোচনাপর্বের পটভূমিকা ছিল চিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্ব লাদাখের বেশ কিছু জায়গায় নতুন পরিকাঠামো নির্মাণের গতিবৃদ্ধি। সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, ‘চিন তার নিজের ভূখণ্ডে প্যাংগং সো-এর উত্তর এবং দক্ষিণ তীর দুটির মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী একটি সেতু নির্মাণ করছে, যার ফলে প্যাংগং সো-এর উভয় পার্শ্বের মধ্যে অর্থাৎ এক দিক থেকে অপর দিকে সেনা এবং সরঞ্জামের চলাচলের সময় উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাবে।’

চিন-ভারত সীমান্ত বরাবর ইতিমধ্যেই চিনের চমৎকার পরিকাঠামো বর্তমান। নতুন সেতু নির্মাণের তাৎপর্য হল যে এর ফলে প্যাংগং সো-এর উত্তর তীরে কুরনাক দুর্গের পি এল এ গ্যারিসন এবং দক্ষিণ তীরবর্তী মদলো গ্যারিসনের মধ্যে দূরত্ব হবে ন্যূনতম। এখন এই দূরত্ব প্রায় ২০০ কিমি। অর্থাৎ এক পার্শ্ব থেকে অপর পার্শ্বে সেনা চলাচল এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের জোগান পাঠানোর প্রক্রিয়াগুলি দ্রুততার সঙ্গে করা সম্ভব হবে। এই নতুন সেতুটি এল এ সি থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দ্য হিন্দুর মতে, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে চিনের তরফে ‘এল এ সি-র কাছে সেনাছাউনির ব্যাপক নির্মাণ এবং সশস্ত্র সেনা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের যাতায়াতের জন্য রাস্তা তৈরির কাজ’ চালানো হচ্ছে।

নিরাপত্তা বিভাগের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলির মতে, পারস্পরিক আলোচনার ১৪তম পর্বে ভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিল হট স্প্রিং (পেট্রলিং পয়েন্ট ১৫) থেকে চিনা সেনা প্রত্যাহার এবং পূর্ব লাদাখের অন্যান্য সংঘাত স্থান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সেনাদল সরিয়ে নেওয়ার উপরে জোর দেওয়া।

নভেম্বর মাসে অন্য ভারতীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে ‘অরুণাচল প্রদেশের মাটিতে চিনের একগুচ্ছ ইমারতের নির্মাণ’ এবং ডোকলামের আশপাশে একাধিক গ্রাম গড়ে তোলার কথা তুলে ধরা হয়। শেষোক্ত অঞ্চলটি ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের কারণ হয়ে উঠেছিল। অরুণাচল প্রদেশে গ্রাম নির্মাণের ঘটনা প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রশাসনের তরফে জানানো হয় যে, সব কটি নতুন নির্মাণকার্যই এল এ সি-র উত্তর পার্শ্বে চিন অধিকৃত ভূখণ্ডে নির্মিত। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু ভারতীয় ভূখণ্ডে গ্রাম নির্মাণের গুজবকে সরাসরি খারিজ করে দেন। তিনি বলেন, ‘চিনা সেনাদলের কেউই অরুণাচলে প্রবেশ করেনি এবং অরুণাচল প্রদেশের ভূখণ্ডে চিনসেনা দ্বারা কখনওই কোনও রকমের নির্মাণকার্য চালানো হয়নি।’ ভারতীয় সেনা এ-ও জানায় যে, ‘উল্লিখিত স্থানাঙ্কের অনুরূপ জায়গাটি… এল এ সি-র উত্তর পার্শ্বে চিন অধিকৃত ভূখণ্ডে অবস্থিত।’

ইতিমধ্যে একটি বার্ষিক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে বলেন যে, ভারতীয় সেনা ‘পি এল এ-র সঙ্গে প্রয়োজনীয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ স্তরের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিও নিচ্ছে।’ সেনাপ্রধানের কথা অনুযায়ী, ‘(সীমান্তের) উভয় দিকে সেনাশক্তি মোটামুটি ভাবে এক থাকলেও আমাদের (ভারতের) তরফে তা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’ উভয় পক্ষই সীমান্ত বরাবর ‘এক লাখের বেশি সংখ্যক সৈন্য… সুতীব্র ঠান্ডার মধ্যেও উচ্চতম অঞ্চলগুলিতে মোতায়েন করে রাখার লক্ষ্য’ বদ্ধপরিকর

নারাভানে এ-ও বলেন যে, দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে সীমান্ত সংঘাতের নেপথ্যে প্রধান কারণটি হল পি এল এ দ্বারা সীমান্ত বরাবর বিশাল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করা। তিনি আরও যোগ করেন যে, এটা স্পষ্ট নয় ‘এই সেনা মোতায়েন করার প্রক্রিয়াটি কি স্থায়ী না কি আগামী ভবিষ্যতে সীমান্তের আলোচিত অঞ্চল থেকে তাদের প্রত্যাহার করা হবে।’ দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন, ‘এল এ সি বরাবর সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পরই দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন, প্রত্যন্ত স্থানগুলি থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া এবং নতুন ভাবে তাদের পুনর্বহাল করার মতো ঘটনাগুলি ঘটা সম্ভব।’ দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক এবং সামরিক আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেও সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় সেনাপ্রধানের মন্তব্য চিনের কার্যকলাপে ভারতের বিরক্তিকে তুলে ধরে।

অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু ভারতীয় ভূখণ্ডে গ্রাম নির্মাণের গুজবকে সরাসরি খারিজ করে দেন।

কিন্তু বর্তমানে সংঘর্ষ বিন্দুগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিন অনেক দিন ধরেই ভারতীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশকে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নামে অভিহিত করে এসেছে। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে তাদের তরফে অরুণাচল প্রদেশের আটটি আবাসিক অঞ্চল, চারটি পর্বত, দুটি নদী এবং একটি গিরিবর্ত্ম-সহ মোট ১৫টি স্থানের নতুন নামকরণ করা হয়। এমনকি এক বছর আগে চিনের বিদেশমন্ত্রক জানায় যে, সীমান্তের পূর্ব পার্শ্বে তাদের অবস্থান ‘ধারাবাহিক এবং স্পষ্ট’। এর পাশাপাশি তাঁরা আরও বলেন যে, ‘আমরা কখনওই চিন ভূখণ্ডে বেআইনি ভাবে নির্মিত তথাকথিত অরুণাচল প্রদেশকে স্বীকৃতি দিইনি।’ ভারতের বিদেশমন্ত্রক সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রত্যুত্তরে কড়া ভাবে জানিয়েছে যে, ‘অরুণাচল প্রদেশ সব সময়ই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং আগামিদিনেও তেমনটাই থাকবে। অরুণাচল প্রদেশের নানা স্থানের ইচ্ছা মতো নামকরণ এই বাস্তব তথ্যের কোনও পরিবর্তন ঘটাবে না।’

পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে এমন এক উত্তেজক পদক্ষেপ নিয়ে অক্টোবর মাসে চিনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটি একটি নতুন জমি নীতি পাশ করে যেটির প্রধান লক্ষ্য হল ‘দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সুরক্ষা এবং যথার্থ ব্যবহার।’ ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি এই আইনটি চালু হয়। যদিও এই নতুন আইন শুধু মাত্র ভারতকেন্দ্রিক নয়, তবুও এর ফলে ভারতের সঙ্গে চিনের সুদীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে সংঘাত আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে যা কোনও সমাধানের সম্ভাবনাকে কঠিনতর করে তুলবে।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাটএ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.