সম্প্রতি নেপালের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (সিবিএস) প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের উপস্থিতিতে দেশটির ১২তম জাতীয় আদমশুমারি প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নেপালের মোট জনসংখ্যা ২০১১ সালের ২৬.৪ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২৯.২ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বৃদ্ধির হার ২০১১ সালের ১.৩৫ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ০.৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী গড় ১.০১ শতাংশের (২০২০) চেয়েও কম। প্রকৃতপক্ষে, ২০২১ সালে নেপালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯১১ সালে দেশটির জনগণনা শুরু করার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সর্বনিম্ন।
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কয়েক বছর ধরে সাক্ষরতার হার ৭৬.৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা জনগণের সচেতনতার মাত্রা বৃদ্ধির দিকেই পরিচালিত করেছে। মানুষ বর্তমানে (বেশি) সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে তাঁদের জীবনযাত্রার মানকে বেশি গুরুত্ব দেন। উপরন্তু দেশ থেকে যুবকদের চলে যাওয়া, সন্তান লালন-পালনের খরচ বৃদ্ধি, কর্মশক্তিতে নারীদের অধিক অংশগ্রহণ এবং বিয়ের জন্য বিলম্বিত বয়সের মতো কারণগুলির ফলেও জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
২০২১ সালে নেপালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯১১ সালে দেশটির জনগণনা শুরু করার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সর্বনিম্ন।
নতুন আদমশুমারি প্রতিবেদনে প্রবীণ জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলিও বিদ্যমান৷ ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১৪ বছর বা তার কম বয়সি শিশুদের জনসংখ্যা ৩৪.৯১ শতাংশ থেকে কমে ২৭.৮৩ শতাংশ হয়েছে। অন্য দিকে, ১৫-৫৯ বছর বয়সি জনসংখ্যা ২০১১ সালের ৫৬.৯৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৬১.৯৬ শতাংশ হয়েছে। এর পাশাপাশি, একই সময়ে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সি জনসংখ্যা ৮.১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০.২১ শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়নে অধিক বিনিয়োগ এবং মাতৃত্বের পরিচর্যার উন্নতির কারণে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ জনসংখ্যার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানে সরকারের দায়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের শুরু থেকে বার্ধক্য ভাতার জন্য যোগ্যতার বয়স ৭০ বছর থেকে কমিয়ে ৬৮ বছর করার ফলে এই সংখ্যা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ানো বার্ধক্য ভাতার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানোর ব্যাপারে সরকার এখন চিন্তিত।
তবে নতুন আদমশুমারির প্রতিবেদন প্রকাশের পর যে বিষয়টি দেশকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করেছে, তা হল দেশের তিনটি পরিবেশগত বলয় অর্থাৎ হিমালয় বা পার্বত্য অঞ্চল, পাহাড় এবং ভারতের সীমান্তবর্তী তরাইয়ের ভূমির সমতল অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভারসাম্যহীনতা। দেশের তিনটি পরিবেশগত অঞ্চলের মধ্যে নেপালের ৫৪ শতাংশ জনসংখ্যা বিশিষ্ট তরাই বা মাধেশ অঞ্চলের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর পরেই রয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা বিশিষ্ট পাহাড়ি অঞ্চল এবং ৬ শতাংশ জনসংখ্যা বিশিষ্ট পার্বত্য অঞ্চল। এমনকি পাহাড় ও পার্বত্য অঞ্চলের সম্মিলিত জনসংখ্যাও (৪৬ শতাংশ) তরাইয়ের জনসংখ্যার (৫৪ শতাংশ) চেয়ে কম।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ানো বার্ধক্য ভাতার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানোর ব্যাপারে সরকার এখন চিন্তিত।
অনেক মানুষই বিশ্বাস করেন যে, আঞ্চলিক জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানের চেয়েও খারাপ। পাহাড় এবং পার্বত্য অঞ্চল থেকে মানুষের চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির গুরুত্বের কথা নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলের চৌবিসের গ্রামীণ পৌরসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান তাঙ্কমায়া ভাল ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষকে এখানে রাখার জন্য আমরা যাই করি না কেন, তারা শুধুই চলে যেতে চায়; এটি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে উঠছে… আমরা গ্রামীণ উন্নয়নের কথা বলতে থাকি, কিন্তু এখানে উন্নয়ন করার মতো কেউই নেই। মানুষজনকে নিজেদের পৈতৃক ভূমি এ ভাবে ছেড়ে যেতে দেখলে খুব খারাপ লাগে।’
অতীতে তরাই অঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যার চেয়ে পাহাড় ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারীদের জনসংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। পাহাড় ও পার্বত্য উভয় অঞ্চলই জনবসতিহীন হয়ে পড়ছে এবং তরাই অঞ্চল জনবহুল হয়ে উঠছে। পর্বত ও পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের চিরাচরিত বসতি ছেড়ে দিয়ে বেশিরভাগ তরাই অঞ্চলে বা কাঠমান্ডুর মতো নিম্ন হিমালয় অঞ্চলে চলে গেছেন। এ ছাড়াও তাঁদের অনেকেই চাকরির সন্ধানে অন্য দেশে চলে যাওয়ার দরুন আর বাড়িতে ফিরে আসেননি।
দেশটির সম্মুখে আসল চ্যালেঞ্জ শুধু আঞ্চলিক জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতাই নয়, বরং উত্তর থেকে দক্ষিণে জনসংখ্যার অভ্যন্তরীণ অভিবাসন তরাই অঞ্চলে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও জন্ম দিয়েছে। দেশের মোট ভূমির মাত্র ১৭ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে থাকলেও তরাই অঞ্চলটি দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ বহন করে। অন্য দিকে, পাহাড় ও পার্বত্য অঞ্চল মোট ভূমির ৮৩ শতাংশ জুড়ে থাকলেও সেখানকার জনসংখ্যা মাত্র ৪৬ শতাংশ। তরাই অঞ্চলে মানুষের স্থানান্তরের কারণে সমগ্র চুরে বা শিবালিক পর্বতমালা এবং হিমালয়ের পাদদেশ বিপর্যস্ত।
পর্বত ও পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের চিরাচরিত বসতি ছেড়ে দিয়ে বেশিরভাগ তরাই অঞ্চলে বা কাঠমান্ডুর মতো নিম্ন হিমালয় অঞ্চলে চলে গেছেন।
চুরে এবং তরাই উভয়েরই বনাঞ্চল নতুন বসতি গঠনের কারণে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু চুরে পর্বতমালা সমগ্র তরাই এবং উত্তর ভারতের নিচের অঞ্চলগুলির জন্য জলের প্রধান উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হত, তাই এই অঞ্চলগুলিতে জলের স্তর মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও, মাটির ক্ষয় এবং ভূমিধস নদীর তলদেশকে এমন মাত্রায় উঁচু করেছে যে, প্রতি বছর নেপালের তরাই অঞ্চল এবং ভারতে নেপালের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে বর্ষায় বন্যার জলে ডুবে যাচ্ছে। অতীতের মতো উর্বর সার বহন করার পরিবর্তে নেপাল থেকে ভারতে প্রবাহিত এই নদীগুলি বর্ষা মরসুমে বেশিরভাগ পলি বহন করে, যা কৃষি জমি নষ্ট করে ধীরে ধীরে বন্ধ্যা জমিতে পরিণত করে।
এ ভাবে নেপালের নতুন ২০২১ সালের আদমশুমারির তথ্য একাধিক দিক থেকেই টনক নড়িয়ে দেওয়ার মতো। কারণ দেশটির প্রবীণ জনসংখ্যা, বেশ কয়েকটি পাহাড় ও পার্বত্য অঞ্চলের জনসংখ্যা, তরাই অঞ্চলের অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্লাবন এবং কৃষিজমির মরুকরণের মতো সমস্যাগুলি প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। আদমশুমারির তথ্য জাতিগত, ভাষা এবং ধর্মের মতো অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্ত করলে আরও দরকারি তথ্য সংগ্রহ করা যেত। তবুও এটি পরিকল্পনাকারী এবং নীতিনির্ধারকদের একটি পরিবর্তনশীল জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করার জন্য যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জোগাবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.