Author : Harsh V. Pant

Published on Jan 08, 2022 Updated 0 Hours ago

ভারতের মতো মধ্য ক্ষমতাশালী অথচ একাধিক বহুপাক্ষিক জোটের অংশীদার দেশগুলি এক উদীয়মান বিশ্ব ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ভূ-রাজনীতিতে পরিবর্তনশীল সমীকরণের নতুন অঙ্ক

বেশ কিছু দিন যাবৎ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বের বহুপাক্ষিক জোটগুলি তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম নয়। কোভিড-১৯ অতিমারি বিশ্বকে এই ক্রমক্ষয়ের বাস্তব ফলাফল সম্পর্কে অবগত করেছে মাত্র। বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্ষমতার টানাপড়েনের সত্যতা তুলে না ধরা এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিস্থিতির ক্রমপরিবর্তনশীল বাস্তবতার আলোকে আন্তর্জাতিক আলাপচারিতাকে উপস্থাপন করতে না পারার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউ এন এস সি ) যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। বেশ কয়েক দশক যাবৎ ইউ এন এস সি-র সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাপী আলোচনা এবং বিতর্ক চললেও তার কোনও ফল হয়নি। ভারতের মতো দেশগুলির শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন এবং নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার দায় এখন রাষ্ট্রপুঞ্জের উপরেই বর্তায়।

অনেকেই যেটা দেখে অবাক হয়েছেন তা হল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের মতো আপাত বিশ্বাসযোগ্য সংস্থাগুলির তীব্র রাজনীতিকরণের বাস্তবতা। নিজেদের স্বার্থ এবং অগ্রাধিকার পূরণে চিন অন্য সব দেশকে ছাপিয়ে বহুপাক্ষিক জোটগুলিকে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার বিষয়ে অগ্রণী। অতিমারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হু বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিনের শীর্ষ নেতৃত্বের কথা মেনে চলার নেপথ্যের কারণগুলি ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। জানা গিয়েছে যে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের উপরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা পয়েন্টে কারচুপি করে, বিশেষ করে চিনের অবস্থানের উন্নতি করার চেষ্টা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রকৃতি মজ্জাগত ভাবে রাজনৈতিক হলেও ১৯৪৫ সালের পর থেকে যে ভাবে চিন বিশ্বব্যাপী বহুপাক্ষিক জোটগুলিকে নিজেদের স্বার্থে নিপুণ ভাবে ব্যবহার করছে তা আন্তর্জাতিক স্তরে চিনের ক্ষমতায়নের বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

বহুপাক্ষিক জোটগুলির ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার নেপথ্যে পৃথিবীর দুটি প্রধান শক্তি আমেরিকা এবং চিনের ভূমিকা সর্বাধিক। এই দুটি দেশ বহুপাক্ষিক জোটগুলির ভিত্তির শর্তগুলিকে আকার দিতে হয় অনিচ্ছুক নয়তো ব্যর্থ বলা চলে। এক দিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দেশটি অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত কমছে এবং তাঁর জাতীয় কর্মসূচি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে জো বাইডেন পর্যন্ত… আমেরিকার দেশের ভিতরে নজর সীমাবদ্ধ রাখার নীতির সঙ্গে যুঝতে হয়েছে সারা বিশ্বকে। অন্য দিকে শি জিনপিং-এর চিন আর কোনও মতেই পূর্ব নির্ধারিত সীমার মাঝে আবদ্ধ থেকে কাজ করতে আগ্রহী নয়। তারা সম্ভাব্য প্রতি পদে বিদ্যমান বিশ্বব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

এই বাস্তব পরিস্থিতি মধ্য ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলির জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে যাদের মধ্যে অধিকাংশ দেশই বিদ্যমান বহুপাক্ষিক জোটগুলির ফলে উপকৃত হয়েছে। ভারতও এই দেশগুলির অন্যতম এবং বর্তমানে ভারতের বিদেশনীতির একটি বড় অংশ হল এই প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী অবস্থার পরিবর্তনের সুযোগ খোঁজা। এই লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল অন্য আগ্রহী দেশগুলির সঙ্গে একত্র হয়ে সমমনস্ক দেশগুলির মধ্যে সাধারণ সমস্যাগুলির সমাধানে সমন্বয় গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করা।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষুদ্র জোটের আধিক্য এই সুবিশাল অঞ্চলটিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের তীব্র অভাবকেই তুলে ধরে। পাশাপাশি অঞ্চলটিতে মুখ্য শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে ঐকমত্য না থাকার কারণে মধ্যশক্তির দেশগুলির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমেরিকা, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক চতুর্দেশীয় সুরক্ষা সংক্রান্ত আলোচনাসভা বা কোয়াড এই প্রেক্ষিতে সর্বাধিক আলোচিত মঞ্চ। ২০১৭ সাল থেকে এই মঞ্চটির নাটকীয় পুনরুত্থান এবং ক্রমবর্ধমান প্রভাব সুবিস্তৃত এই অঞ্চলটিতে এক নতুন উদ্যমের সূচনা করেছে। এর ফলে বেশ কয়েকটি দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও তা চিনের সংশয় বাড়িয়েছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুটি শীর্ষস্তরীয় সম্মেলনের একটি ভার্চুয়াল এবং অন্যটিতে ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত থাকার মাধ্যমে নবজাতক এই মঞ্চটির কর্মসূচিতে টিকাকরণ, উদীয়মান কৌশলগত প্রযুক্তি, পরিকাঠামোগত সংযোগ স্থাপন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো সমসাময়িক জটিল বিষয়গুলি উঠে এসেছে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে মঞ্চটির প্রতি ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার দায়বদ্ধতা ওয়াশিংটনকে এই উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করে তুলেছে।

গত মাসে আর একটি কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সকলের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরের সাম্প্রতিক ইজরায়েল সফরের সময় ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং আমেরিকার এই নতুন স্বল্পপাক্ষিক জোটের উদ্বোধন হয়। এর ফলে বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে পরিকাঠামো নির্মাণ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বিগ ডেটা’ বা সর্বাত্মক তথ্যের আদানপ্রদানের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলিকে মজবুত করে তোলার ব্যাপারে ভারত তার আগ্রহ সুস্পষ্ট করেছে। আমেরিকা, ইজরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বিদ্যমান এবং গত বছর আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে মধ্য এশিয়ায় একটি নতুন আঞ্চলিক ক্ষমতাবিন্যাসের সূচনা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এই অঞ্চলটিতে বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়তে আগ্রহী নয় এবং বর্তমানে তাঁর মূল লক্ষ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষমতার বিস্তার। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মধ্য এশিয়ায় এই নতুন জোটের গঠন ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব ছিল না।

এগুলি ছাড়াও অন্যান্য ত্রিপাক্ষিক জোট আছে যেখানে মধ্য ক্ষমতার দেশগুলি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক স্তরে ইন্দো-প্যাসিফিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসার ফলস্বরূপ একাধিক বিষয়ে সরব হয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলি সামনের সারিতে এগিয়ে এসে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। সব মধ্য ক্ষমতাশালী দেশ একই রকম নয় এবং তারা সকলে সমতৎপরও নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সব মধ্য ক্ষমতাশালী দেশ সমসাময়িক রাজনীতির প্রেক্ষিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। পাশ্চাত্যে যখন বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তিগুলি তাদের অঞ্চল বহির্ভূত রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে তখন পূর্বে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলি একজোট হচ্ছে… এটি নিঃসন্দেহে ভূ-রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন সূচনা।

পৃথিবী দ্রুত বদলাচ্ছে এবং আমেরিকা বা চিন কেউই আর বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত নয়। এর ফলে, মধ্য ক্ষমতাশালী দেশগুলির বহুপাক্ষিক জোট এই ভূ-রাজনৈতিক শূন্যস্থান দ্রুত পূরণের এক অন্যতম উপায় হয়ে উঠছে। এ ভাবে এক দিকে আমেরিকাকে সন্তুষ্ট রাখার পাশাপাশি চিনকেও পিছু হঠতে বাধ্য করা যেতে পারে। এই মুহূর্তে ক্রমপরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির রূপরেখা নির্মাণ করছে মধ্য ক্ষমতাশালী দেশগুলি। নয়া দিল্লিরও উচিত এই মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে ক্রমউদীয়মান বিশ্ব ব্যবস্থাকে আকার দিতে তৎপর হওয়া।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় মিন্ট’-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.