গত ১৮ জুলাই হংকং থেকে কাঠমান্ডু ভিত্তিক রেডি ট্রেড প্রাইভেট লিমিটেডের আমদানি করা ১০০ কিলোগ্রাম সোনা কাঠমান্ডুতে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (টিআইএ) খুব কাছে সিনামঙ্গলে আটক করা হয়েছিল। এই সোনা ভারতে পাচার হওয়ার কথা ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, এবং তা মোটরসাইকেলের ব্রেক শু ও ইলেকট্রিক শেভারের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনার পরপরই নেপাল সরকারের রাজস্ব তদন্ত বিভাগ (ডিআরআই) সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে নেপাল, চিন ও ভারতের নাগরিকসহ মোট ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়াও এটি সনাক্তকরণ এড়িয়ে সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে গাফিলতিগুলির তদন্ত করতে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এই সোনা ভারতে পাচার হওয়ার কথা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, এবং তা মোটরসাইকেলের ব্রেক শু ও ইলেকট্রিক শেভারের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
এই ঘটনার আগেও রেডি ট্রেড প্রাইভেট লিমিটেড হংকং থেকে প্রায় ১,৯৯৭ কেজি সোনা আমদানি করেছিল। এই ফার্মের গুদামে ডিআরআই পরিচালিত অভিযানের সময় সরকারি কর্তৃপক্ষ সোনা লুকনোর জন্য ব্যবহৃত বাক্সগুলির সঙ্গে সোনা ওজন করা ও গলানোর মেশিন খুঁজে পায়। এটা খুবই কৌতূহলজনক যে এই ফার্মের আইনি মালিক কোনও হাই–প্রোফাইল ব্যবসায়ী নন, বরং নিছক একজন দৈনিক মজুর যিনি নেপালের দোলখা জেলার মেলুং গ্রামীণ পৌরসভা ১–এ বসবাস করেন।
এই ১০০ কেজি সোনা কেলেঙ্কারির আগে সরকারি কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে টিআইএ–তে ৩৩ কেজি সোনা ধরেছিল, কিন্তু সোনা হারিয়ে গিয়েছিল এবং এখনও তার খোঁজ মেলেনি। কিছুকাল আগে ক্ষমতাসীন মাওবাদী দলের একজন সিনিয়র নেতা ইলেকট্রনিক সিগারেটের আড়ালে ৯ কেজি সোনা পাচারে জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটো ও ভিডিওগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে কথিত সোনা চোরাকারবারীরা অন্য হাই–প্রোফাইল মাওবাদী নেতাদের সঙ্গে পোজ দিচ্ছে ৷
এই ফার্মের গুদামে ডিআরআই পরিচালিত অভিযানের সময় সরকারি কর্তৃপক্ষ সোনা লুকনোর জন্য ব্যবহৃত বাক্সগুলির সঙ্গে সোনা ওজন করার ও গলানোর মেশিন খুঁজে পায়।
এখন প্রশ্ন উঠছে টিআইএ–র নিরাপত্তা কর্মকর্তারা, যাঁরা একটি ছোট মুদ্রাও শনাক্ত করতে পারেন, তাঁরা কীভাবে এক কুইন্টাল সোনা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেন? কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে এত বড় সোনার চালান বিমানবন্দর দিয়ে গেল? টিআইএ–তে মানবিক ও প্রযুক্তিগত উভয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, কারণ সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার জন্য পরিচিত একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে বিমানবন্দরের বাইরের অংশ ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চল ব্যবস্থাপনার বরাত দেওয়া হয়েছে।
নেপালে সোনা চোরাচালান অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার (১৯৬০–১৯৯০) সময়ও এটি চলত। পরবর্তীতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও সোনা চোরাচালান অব্যাহত থাকে। প্রতিদিন সোনা চোরাচালান ঘটলেও সোনা আটকের ঘটনা বিরল। এবং সোনা বাজেয়াপ্ত করা হলেও মূল খেলোয়াড় নয়, বরং বাহকদের শাস্তি দেওয়া হয়।
চোরাচালান ইস্যুতে সরকারি কর্তৃপক্ষ কতটা দক্ষ তা দেখানোর জন্যই চোরাচালান হওয়া সোনা আটক করা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই স্বর্ণ কেলেঙ্কারির মামলা তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নেপালের খ্যাতি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, কারণ এটি এখন সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে সোনা বেশিরভাগই নেপালে আমদানি করা হয় চিন থেকে, এবং তারপর তা ভারতে পাচার করা হয়। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র লিংডেল বলেন, “কাউকে দেখানোর জন্য এই পরিমাণ সোনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠছে নেপাল। অন্যান্য দেশ চাপ দেওয়ার পরেই সোনা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।’’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নেপালের খ্যাতি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, কারণ এটি এখন সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠছে।
নেপাল পুলিশের প্রাক্তন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল হেমন্ত মাল্লা ঠাকুরি বলেছেন যে চোরাচালানকারী, শুল্ক আধিকারিক ও শীর্ষ স্তরের অন্য লোকেদের মধ্যে যোগসাজস ছাড়া এত বড় পরিমাণে চোরাচালানের সময় সোনা সনাক্ত না–হওয়া সম্ভব নয়৷ তিনি সোনা চোরাচালানকে আন্তর্জাতিক মাত্রার সংগঠিত অপরাধ বলেও অভিহিত করেন, কারণ সোনা তৃতীয় দেশ থেকে আনা হয়।
তা ছাড়া, হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের (নেপালি সংসদ) আইন, বিচার ও মানবাধিকার কমিটির বৈঠকে ভাষণ দেওয়ার সময় নেপালি কংগ্রেসের আইনপ্রণেতা সুনীল শর্মা উপ–প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠ এবং অর্থমন্ত্রী প্রকাশ শরণ মাহাতর পদত্যাগ চেয়েছিলেন বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান রোধে ব্যর্থতার জন্য। কারণ টিআইএ–র কাস্টমস বিভাগ অর্থ মন্ত্রকের অধীনে কাজ করে এবং পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করে। নেপালি কংগ্রেসের একজন সিনিয়র নেতা শেখর কৈরালা এমনকি সোনা চোরাচালানে অন্য একজন হাই–প্রোফাইল ব্যক্তি জড়িত আছেন বলে সন্দেহ করেছেন।
দেশের প্রধান বিরোধী দল সিপিএন–ইউএমএল অভিযোগ করেছে সরকার সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত প্রধান অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। দলটি সোনা চোরাচালানের বিষয়ে একটি স্বাধীন উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছে, এবং এর জন্য এটি বেশ কিছুদিন ধরে হাউস অফ রেপ্রেজেন্টেটিভস–এর কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে। সিপিএন (ইউএমএল)–এর যুব শাখা ন্যাশনাল ইয়ুথ ফেডারেশন কাঠমান্ডুতে একটি মশাল র্যালি করে যাতে সরকারকে সোনা চোরাচালানে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাপ দেওয়া হয়। এটি সরকারকে শুধুমাত্র বাহকদের গ্রেফতার করে মাস্টারমাইন্ডকে ‘রক্ষা করার’ দায়ে অভিযুক্ত করেছে।
সিপিএন (ইউএমএল)–এর যুব শাখা ন্যাশনাল ইয়ুথ ফেডারেশন কাঠমান্ডুতে একটি মশাল র্যালি করে যাতে সরকারকে সোনা চোরাচালানে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাপ দেওয়া হয়।
নেপাল সরকার কীভাবে সোনা কেলেঙ্কারির মূলে পৌঁছবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হল ডিআরআই ইতিমধ্যেই মামলাটির তদন্ত করছে, এই অসার কারণ দেখিয়ে সরকার একটি স্বাধীন উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা ডিআরআই যেহেতু একটি সরকারি সংস্থা এবং এই মামলায় উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিকেরা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়েছে, তাই এই সংস্থার প্রতিবেদন নিরপেক্ষ হবে কি না তা সন্দেহজনক। সেক্ষেত্রে কেলেঙ্কারির মূল হোতাসহ প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে, এমনটা ভাবা কঠিন। কিন্তু এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে সোনা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কোনও ধরনের উদারতা শুধুমাত্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে নেপালের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করবে না, দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার উপরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
হরি বংশ ঝা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন ভিজিটিং ফেলো
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.