Author : Vikrom Mathur

Published on Sep 28, 2021 Updated 0 Hours ago

দেশের পশ্চিম উপকূল যখন সাইক্লোন টওটে-এর প্রকোপে প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কায় ধুঁকছে, তখন ভারতের পূর্ব উপকূলে মে মাসের শেষ সপ্তাহে এল সাইক্লোন ইয়াস, আর ধ্বংসলীলা চালাল পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার উপকূলে।

উপকূলীয় সর্বজনীন সম্পদ সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার

পুরো গোয়ায় তখন কোভিড–১৯ ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সারা দেশের মধ্যে সেখানেই পজিটিভিটি রেট ছিল সবচেয়ে বেশি। আর ঠিক তখনই সেখানে সাইক্লোন টওটে-এর প্রকোপে অসংখ্য গাছ পড়ে যায়, বাড়িঘর ভেঙে যায়, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যায় আর ইন্টারনেটের কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার বাড়ি যেখানে, সেই আলডোনা গ্রামে জীবন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। ষাট ঘণ্টা বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ফোনের নেটওয়র্ক বা জল সরবরাহ, কিছুই ছিল না। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে লড়াই করে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর যে কাহিনি এতদিন ছিল অবয়বহীন, তা সেখানে হঠাৎ হয়ে গেল বাস্তব, স্থানীয় এবং ব্যক্তিগত।

ঐতিহাসিক ভাবে আরব সাগরে বঙ্গোপসাগরের তুলনায় অনেক কম সাইক্লোন আসত। সেই আরব সাগর এখন ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে। ২০১৯ সালে ভারতে যে আটটি সাইক্লোনের কথা নথিভুক্ত হয়েছিল, তার পাঁচটিই এসেছিল আরব সাগর থেকে। পরিসংখ্যানটা উদ্বেগজনক, কারণ এর সঙ্গে তুলনীয় শুধু ১৯০২ সালের তথ্য। তিন দশকের মধ্যে পশ্চিম উপকূলে যত সাইক্লোন আঘাত হেনেছে তার মধ্যে টওটে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং যত অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক জলবায়ু–সংক্রান্ত ঘটনা ঘটছে, সেই তালিকায় এই সাইক্লোনটি সাম্প্রতিকতম। সারা পৃথিবীর মধ্যে এই সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুত। সাইক্লোন টওটে-এর সঙ্গে যুক্ত নানা বিচিত্র ঘটনাকে আবহবিদরাও উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন। এই সাইক্লোন নিম্নচাপ থেকে দু’‌দিনের মধ্যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছিল, এবং তার শক্তি ধরেও রেখেছিল।

দেশের পশ্চিম উপকূল যখন সাইক্লোন টওটে-এর প্রকোপে প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কায় ধুঁকছে, তখন ভারতের পূর্ব উপকূলে মে মাসের শেষ সপ্তাহে এল সাইক্লোন ইয়াস, আর ধ্বংসলীলা চালাল পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার উপকূলে।

জীবন  জীবিকা

ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রায় ১৭ কোটি মানু্ষ থাকেন। কিন্তু এই মানুষেরা, বিশেষ করে যাঁরা নিচু অঞ্চলে থাকেন, তাঁরা সারাক্ষণই বন্যা অথবা সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক উচ্চতাবৃদ্ধি, অপ্রত্যাশিত ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিজনিত বিপদের মধ্যে রয়েছেন। ভারত ১৯৯০ থেকে ২০১৬–র মধ্যে উপকূলবর্তী অঞ্চলের ২৩৫ বর্গ কিমি এলাকা হারিয়েছে ভূমিক্ষয়ের কারণে। বন্যা ও বর্ষাকালীন বৃষ্টির কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালে প্রতি বছর ৩৬ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে।

ভারত মহাসাগর দ্রুত উষ্ণ হয়ে ওঠার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় যত সাইক্লোন আসছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত করছে পৃথিবীর প্রায় এক–তৃতীয়াংশ মানুষকে। গত বছরের বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোন আমফানের ধাক্কা এখনও উপকূলের বিভিন্ন জায়গা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনও মানুষ লড়াই করে চলেছেন। তার মধ্যেই আবার আঘাত হেনেছে সাইক্লোন ইয়াস। এই সব অপ্রত্যাশিত সাইক্লোনের ধাক্কা সব চেয়ে বেশি লাগে মৎস্যজীবীদের উপর।

এই বছর ৮ জুন যখন আমরা বিশ্ব মহাসমুদ্র দিবস পালন করেছি ‘‌জীবন ও জীবিকা’‌কে থিম হিসেবে তুলে ধরে, তখন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও নতুন নানা বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। এমন চিন্তাভাবনা প্রয়োজন যার কেন্দ্রে থাকবে উপকূলের মানুষের জন্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর ভবিষ্যৎ গড়া এবং ভারত মহাসাগরের স্থিতিশীল ব্যবস্থাপনার (সাস্টেনেবল ম্যানেজমেন্ট)‌ জন্য তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। তা ছাড়া দ্রুত নগরায়নের জন্য উপকূলের মানুষের সর্বজনীন সম্পদের যাতে ক্ষতি না হয় এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকা যেন নষ্ট না হয় তার দিকে নজর দেওয়া দরকার।

এই বছর  জুন যখন আমরা বিশ্ব মহাসমুদ্র দিবস পালন করেছি ‘‌জীবন  জীবিকা’‌কে থিম হিসেবে তুলে ধরেতখন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও নতুন নানা বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। এমন চিন্তাভাবনা প্রয়োজন যার কেন্দ্রে থাকবে উপকূলের মানুষের জন্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর ভবিষ্যৎ গড়া এবং ভারত মহাসাগরের স্থিতিশীল ব্যবস্থাপনার (সাস্টেনেবল ম্যানেজমেন্ট)‌ জন্য তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। তা ছাড়া দ্রুত নগরায়নের জন্য উপকূলের মানুষের সর্বজনীন সম্পদের যাতে ক্ষতি না হয় এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকা যেন নষ্ট না হয় তার দিকে নজর দেওয়া দরকার।

এক নতুন ভাবনা

উপকূলবর্তী অঞ্চল, বিশেষ করে উপকূলের শহরগুলো, সাগর বা মহাসাগরের সঙ্গে যে ভাবে যোগসূত্র গড়ে তোলে তার মধ্যে একটা মৌলিক গলদ আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ স্থলভূমিকেই প্রাধান্য দিয়েছে, আর সমুদ্রকে অবহেলা করেছে। ফলস্বরূপ আমরা এখনও ম্যানগ্রোভ বা জলাভূমির মতো সংবেদনশীল জলজ বাস্তুতন্ত্র হারাচ্ছি, আর তার জায়গায় গড়ে উঠছে জলকে যা দূরে ঠেলে দিতে চায় তেমন নানা স্থল–পরিকাঠামো প্রকল্প। আমরা আমাদের পরিবেশ নিয়ে যা এতদিন ভেবেছি, তা এখন নতুন করে কল্পনা করা প্রয়োজন। জলাভূমি শেষ করে দিয়ে সেখানে শুকনো জমি সৃ্ষ্টি করা বা স্থলভূমিকে সমুদ্রের বিপরীত হিসেবে ধরে নেওয়ার বদলে আমাদের বর্ষা ও জলকে নাগরিক পরিকল্পনার অঙ্গ করে নেওয়া প্রয়োজন। এর ফলে এমন শহর তৈরি করা সম্ভব হবে যা পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সামনেও টিকে থাকার শক্তিতে ভরপুর থাকবে।

উপকূলের মানুষের জীবন সমুদ্রের সঙ্গে অনেক ভাল করে সংমিশ্রিত হয়। কাজেই সমুদ্র আর স্থলকে পৃথক ভাবে ভাবার দৃষ্টিভঙ্গিটিকেই আমাদের নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার। বর্তমান প্রজন্মের নগর–পরিকল্পনায় যুক্ত ব্যক্তিরা অনেক বেশি করে সবুজায়নের দিকে নজর দেন। কিন্তু এবার উপকূলে বন্যার মতো সমস্যাগুলোর মোকাবিলার জন্য গাছপালার পাশাপাশি জলকেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

উপকূলের মানুষের জীবন সমুদ্রের সঙ্গে অনেক ভাল করে সংমিশ্রিত হয়। কাজেই সমুদ্র আর স্থলকে পৃথক ভাবে ভাবার দৃষ্টিভঙ্গিটিকেই আমাদের নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার। বর্তমান প্রজন্মের নগরপরিকল্পনায় যুক্ত ব্যক্তিরা অনেক বেশি করে সবুজায়নের দিকে নজর দেন। কিন্তু এবার উপকূলে বন্যার মতো সমস্যাগুলোর মোকাবিলার জন্য গাছপালার পাশাপাশি জলকেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে উপকূলের জমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রক আইনগুলোকে লঘু করে দিয়ে আমাদের দেশ অনেকগুলো পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ করেছে। ২০১৯–এর কোস্টাল রেগুলেশন জোন বিধি উপকূলের শহরগুলিতে বাড়িঘর নির্মাণের উপর বিধিনিষেধ কমিয়ে দিয়েছে, আর সেই সঙ্গে উপকূলের গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে চাষ হয় না তেমন জমিতে বিমানবন্দর গড়ার অনুমতি দিয়েছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলের জন্য এখন যে সামাজিক–প্রযুক্তিগত ভাবনাচিন্তা চলছে — যেমন লক্ষদ্বীপ, আন্দামান  মুম্বই কোস্টাল রোড প্রজেক্ট — তা জটিল স্থল–জল বাস্তুতন্ত্র ও স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর একটা জাঁকজমকপূর্ণ স্বপ্ন চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু উপকূলের কাছে এ সব নির্মাণকাজের ফলে শুধু স্থানীয় মানুষের প্রথাগত জীবিকাই বিপন্ন হবে না, সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিপর্যয় আসতে পারে তার বিরুদ্ধে প্রস্তুতিকেও দুর্বল করবে।

প্রাণশক্তির রচনা

বিপর্যয়ের পর ভারতীয় সংস্থাগুলো দ্রুত মানুষকে উদ্ধার করা এবং নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শুধু এই সব কাজ দিয়ে তো সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না। জলবায়ুগত কারণে ঘটা এই সব বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে হলে এবং স্থানীয় মানুষকে মোকাবিলার শক্তি জোগাতে হলে উপকূলবর্তী মানুষের জীবিকা–সংক্রান্ত সুযোগের ক্ষেত্রে আরও বৈচিত্র আনতে হবে। গোয়ার রাজধানী পানজিমের ক্ষেত্রে বলা যায়, উপকূলের কাছে শিল্পোদ্যোগ সংক্রান্ত কাজ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ভঙ্গুর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার ক্ষতি করছে।

স্থানীয় পর্যায়ে বেআইনি ভাবে জমি দখল রুখতে স্থানীয় সংগঠন ও আইন রক্ষাকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সেই সঙ্গেই প্র‌য়োজন উপকূলবর্তী সর্বজনীন সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য তৃণমূল স্তরে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া। অবিলম্বে জরুরি প্রয়োজন উপকূল অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা।

বিশ্বের সেরা অনুসৃত পন্থার ভিত্তিতে বলা যায়, এমন বাস্তুতন্ত্র–ভিত্তিক ও নির্দিষ্ট স্থান–ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে যা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাবে।

বিশ্বের সেরা অনুসৃত পন্থার ভিত্তিতে বলা যায়এমন বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক  নির্দিষ্ট স্থানভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে যা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি  ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাবে।

উপকূলবর্তী জীবনের উপর যখন ব্যাপক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে, তখন প্রয়োজন জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝতে পারবে এমন সব কাজে বিনিয়োগ। এই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ও অভিযোজন ক্ষমতা তৈরির জন্য প্রয়োজন আর্থিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ ও বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞান। জাতীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক তহবিল হাতে থাকলেও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হল সেই সমস্ত স্থানীয় সংস্থার কাছে তা পৌঁছে দেওয়া যারা তৃণমূল পর্যায়ে এই ক্ষমতা তৈরির কাজ করছে। এখন প্রয়োজন উপকূলবর্তী সর্বজনীন সম্পদ সম্পর্কে বিভিন্ন ধ্যানধারণা ভাল ভাবে উপলব্ধি করা, এবং ঐতিহ্যগত ভাবে যারা প্রান্তিক তাদের মুখে ভাষা দেওয়া।


এই নিবন্ধটি প্রথমে সায়েন্স দ্য অয়্যার–এ প্রকাশিত হয়েছিল।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.