Published on Jul 06, 2022 Updated 0 Hours ago

আন্তর্জাতিক মানবিক কর্তৃপক্ষগুলি মায়ানমারে বিদ্যমান মানবিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে দ্রুত এবং কার্যকরী সচেতনতা দেখিয়েছে।

মায়ানমার সঙ্কট: ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয়

মায়ানমারে ২০২১-এর অভ্যুত্থান তার দ্বিতীয় বছরের পঞ্চম মাসে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির মানবিক পরিস্থিতি গভীর ভাবে উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে মায়ানমারের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেবে। ত্রাণের চাহিদা বহু গুণ বৃদ্ধি পেলেও কোভিড-১৯ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ, যেমন- গতিবিধির সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি বিদ্যমান বিক্ষোভ এবং ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তার অভাবজনিত অভ্যুত্থান সঙ্কট, ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, সীমিত নগদ অর্থ প্রবাহ এবং জুন্টা দ্বারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ত্রাণের কাজে বাধা দেওয়া মানবিক সাহায্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকে নতুন করে অন্ততপক্ষে আরও ৪,২৫,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যার ফলে উদ্বাস্তু মানুষের মোট সংখ্যা ২০২২ সালে দশ লক্ষে গিয়ে পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সে দেশের সেনা মানবিক ত্রাণের পথ রোধ করে চলেছে।

শাসক-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রাক্তন আইন প্রণেতা কো ফাইও জেয়া থ এবং বর্ষীয়ান গণতন্ত্রকর্মী বা ডেমোক্রেসি অ্যাক্টিভিস্ট কো জিমিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ঘোষণা বর্তমান প্রশাসনের নৃশংসতাকেই তুলে ধরে।

২০২২ সালের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুযায়ী সে দেশে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষের মানবিক ত্রাণের প্রয়োজন। মায়ানমারের বেশ কিছু অংশে মানবিক নিরাপত্তা পরিবেশের অবনতি ঘটেছে, এমনকি সেই সব জায়গাতেও যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তেমন ভাবে গৃহযুদ্ধের ছায়া পড়েনি।

সূত্র : ও সি এইচ এ মায়ানমার, ৩১ মে, ২০২২

রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউ এন) প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সহস্রাধিক ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল (আই ডি পি) বা দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত মানুষ, যাঁরা ইতিমধ্যেই তাঁদের বাসা বা আশ্রয় ছেড়ে পালিয়েছেন, তাঁদের আবারও জায়গা বদল করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০,০০০ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে তাইল্যান্ড ও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলিতে প্রবেশ করেছেন। ২০২১ সালে সংঘর্ষ চলাকালীন গৃহস্থ বাড়ি, গির্জা ও মঠের মতো ধর্মীয় ইমারত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সহ ১২,৭০০-রও বেশি সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। নতুন বাসস্থানের নির্মাণ বা ফিরে আসার উপযুক্ত পরিস্থিতি কোনওটাই না হওয়ার ফলে আই ডি পি-দের প্রত্যাবর্তনের নিরিখে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ধারাবাহিক সংঘর্ষের মধ্যেই ২০২২-এর এপ্রিল থেকে দেশের উপকূলবর্তী এলাকাগুলি প্রবল ঝড়বৃষ্টির মুখে পড়েছে। কায়িন, কাচিন, রাখাইন এবং শানের মতো নিচু রাজ্যগুলিতে বৃষ্টির ফলে ঘরবাড়ি এবং আশ্রয়স্থলগুলি গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনটা হওয়ার ফলে প্রভাবিত মানুষদের, বিশেষত সংরক্ষিত বাস্তুচ্যুত কেন্দ্রগুলিতে বসবাসকারী আই ডি পি-দের জন্য, বিদ্যমান সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংঘর্ষ-প্রভাবিত অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষজন ছাড়াও ইয়াংগন-এর মতো শহুরে অঞ্চলগুলির মানুষেরাও খাদ্য ঘাটতি এবং গৃহহীনতার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (আই এল ও) ২০২২-এর মতে, ১৬ লক্ষ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন। এর পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি খাদ্য ও জ্বালানি-সহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এই মুদ্রাস্ফীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধও অংশত দায়ী। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে মায়ানমারে ডিজেলের দাম ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে ২০২২ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে জ্বালানির দাম ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এই মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়েছে৷

মানবতাবাদী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া

মানবিক কর্তৃপক্ষগুলি দ্রুত প্রভাবিত পরিবারগুলির কাছে পৌঁছেছে এবং তাঁদের দড়ি, কম্বল, রান্নার সরঞ্জাম, মশারি, বালতি, শোয়ার মাদুর, স্যানিটারি কিট, কোভিড-১৯ ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম এবং সৌর বাতির মতো অ-খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করার পাশাপাশি ত্রিপল জুগিয়েছে ও বাসস্থান মেরামতের কাজে সাহায্য করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) এই সংঘাত-প্রভাবিত মানুষদের জীবনদায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদানে দিবারাত্র কাজ করে চলছে। ২০২১ সালে ডব্লিউ এফ পি খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা নিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এর মধ্যে রয়েছে সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলের ৫৬,০০০ আই ডি পি এবং শহরাঞ্চলের ১৭ লক্ষ মানুষ। তবে প্রকৃত চাহিদা বর্তমান ক্ষমতা, পুঁজি এবং প্রাপ্ত সুবিধের তুলনায় বহু গুণ বেশি।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) এই সংঘাত-প্রভাবিত মানুষদের জীবনদায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদানে দিবারাত্র কাজ করে চলছে।

সামরিক জুন্টা দেশের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল জুড়ে মানবিক ত্রাণ সরবরাহের পথ রুদ্ধ করেছে। তারা সরবরাহের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বা ভ্রমণের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। চিন প্রদেশ এবং উত্তর পশ্চিম অংশে পণ্য চলাচল প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং নিয়মিত তল্লাশি চলছে। ফলে খাদ্য বা অ-খাদ্য সামগ্রী সরবরাহে গুরুতর বিঘ্ন ঘটছে। ত্রাণকর্মীরা তাঁদের সুরক্ষার জন্য এবং প্রান্তিক অঞ্চলে পণ্য সরবরাহ বাধাহীন করার জন্য এবং সামরিক সংযোগ ব্যবস্থা এড়াতে হয় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী অথবা স্থানীয় জনগণের সাহায্য নিচ্ছেন।

মানবিক কর্তৃপক্ষগুলি আই ডি পি-দের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে  গুরুতর বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। কারণ সামরিক জুন্টা আগের মতো নাগরিক এবং জাতিগত সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ফারাক করছে না এবং মানুষ ও তাঁদের সম্পত্তি পুড়িয়ে দিচ্ছে।  জুন মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ১৮৮৩ জনকে হত্যা করেছে এবং ১৩,৫০০-এরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে অন্য নাগরিকদের সঙ্গে একত্রে দু’জন মানবিক কর্মীকে জুন্টা দ্বারা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি যদি না অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তা হলে এ জাতীয় উদাহরণ আরও বাড়তে পারে। ত্রাণকর্মীদের সুরক্ষা এ ক্ষেত্রে অসীম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরাই অভাবী মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া ও তাঁদের যত্ন নেওয়ার কাজ করছেন।

কার্যকর পদক্ষেপ সুনিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তার পাশাপাশি আরও বেশি করে পুঁজির প্রয়োজন। ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষ পর্যন্ত, ২৬ লক্ষ মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছেছে। যদিও এখনও ৫৯ শতাংশ মানুষের ত্রাণের প্রয়োজনে রয়েছে এবং সেই কারণেই অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে মাত্র ১০ শতাংশ পরিমাণ অর্থায়ন করা হয় এবং সেই সময়ে ঘাটতি ছিল ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার। এমনটা না হলে মানবিক কর্তৃপক্ষরা এমন এক সময়ে নিজেদের সহায়তার হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন যখন সহায়তার প্রয়োজন সর্বোচ্চ।

আঞ্চলিক শক্তিগুলির তরফে প্রতিক্রিয়া

রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ মায়ানমারে মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসিয়ানের আঞ্চলিক ব্লক পাঁচ দফা ঐকমত্যের মধ্যে মানবিক ত্রাণের বিষয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আসিয়ানের সভাপতি কম্বোডিয়া এই সাহায্য বিতরণের জন্য সামরিক জেনারেলের অনুমোদন এবং সহায়তা চাওয়ায় নিন্দার মুখে পড়েছে। ৬ মে আসিয়ানের চেয়ার-সহ আসিয়ান কো-অর্ডিনেটিং সেন্টার ফর হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স অন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (এ এইচ এ) মায়ানমারের টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। মায়ানমার রেড ক্রস সোসাইটি এই টাস্ক ফোর্সের অন্তর্গত যারা সামরিক নির্দেশ মেনে চলে। এই সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কোভিড-১৯ মোকাবিলা করার জন্য প্রভাবিত মানুষদের কাছে ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের ত্রাণ এবং আরও ৭ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রদানের পদ্ধতিগুলি স্থির করা। কোনও প্রভাবিত মানুষই ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হবেন না… এই আদর্শের ভিত্তিতে আলোচনাটির আয়োজন করা হয় এবং সকল পদক্ষেপ ও কর্মসূচি বৈষম্যহীন এবং স্বাধীন হবে, এমনটাই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু মানবিক গোষ্ঠীগুলি, রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (নির্বাসিত সরকার) এ কথা ব্যক্ত করেছে যে জুন্টাকে এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করায় তারা কর্মসূচির মূল সুর বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জুন্টাই এই অভাবী মানুষদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালাচ্ছে।

আসিয়ানের আঞ্চলিক ব্লক পাঁচ দফা ঐকমত্যের মধ্যে মানবিক ত্রাণের বিষয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আসিয়ানের চেয়ার কম্বোডিয়া এই সাহায্য বিতরণের জন্য সামরিক জেনারেলের অনুমোদন এবং সহায়তা চাওয়ায় নিন্দার মুখে পড়েছে।

মানবিক ত্রাণ সরবরাহের উপায়গুলি নিয়ে আলোচনা চালানো কম্বোডিয়ার তরফে এক সৎ প্রচেষ্টা হলেও সঠিক মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছনো সুনিশ্চিত করতে পারা এখনও এক উদ্বেগের কারণ। বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, আসিয়ানের উচিত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে মানবিক হস্তক্ষেপের স্বার্থে একটি নির্দেশিকা জারি করতে অনুরোধ করা যা প্রয়োজনের স্থানে ত্রাণ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি সুনিশ্চিত করবে।

এ কথা অপরিহার্য যে, আসিয়ান, ই ইউ, ইউ কে, ইউ এস এবং ইউ এন-এর মতো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলি স্থানীয় সংস্থা বা কর্মীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ ভাবে কাজ করবে এবং প্রয়োজনে মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছনো সুনিশ্চিত করতে আন্তঃসীমান্ত সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরাসরি মানবিক ত্রাণ প্রদান করবে। বিরাজমান গোষ্ঠী সংযোগ সূত্রগুলিকে কাজে লাগাতে পিপল টু পিপল অ্যাপ্রোচ বা মানুষে মানুষে যোগাযোগের মনোভাব অবলম্বন করতে হবে যা ত্রাণের সঠিক সরবরাহ সুনিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়া এবং সরবরাহ পদ্ধতিগুলি সফল ও সচল রাখার জন্য সময় মতো অর্থায়ন করা অপরিহার্য।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.