Published on Jan 14, 2022 Updated 0 Hours ago

আং সান সু চি-কে একাধিক ধারায় বিচারের আওতায় আনায় বিশ্ব স্তম্ভিত। এর ফলে কি মায়ানমারে গণতন্ত্রের সমাধিপ্রস্তর স্থাপন করা হল?

মায়ানমার: আং সান সু চি সংক্রান্ত রায় এবং তার পরিণাম

মায়ানমারের সামরিক আদালতের সে দেশের প্রাক্তন স্টেট কাউন্সেলরকে দু’বছরের জন্য কারারুদ্ধ করার সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে ‘গণতন্ত্রের প্রতি বড় রকমের আঘাত’ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ২০২৩ সালের তথাকথিত ‘বহুদলীয় নির্বাচন’-এর আগে বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী নেতাদের নির্মূল করার ব্যাপারে জুনটার যে অভিপ্রায়, তার সঙ্গে এটি সাযুজ্যপূর্ণ।

ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের পর আটক হওয়া দ আং সান সু চি-র বিরুদ্ধে বর্তমানে ১১টি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় কোভিড-১৯ অতিমারির বিধিনিষেধ লঙ্ঘন, উসকানিমূলক আচরণ, অবৈধ ভাবে পণ্য আমদানি এবং ঔপনিবেশিক যুগের সরকারি গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের মতো অপরাধ। এই সব ক’টি ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর সর্বোচ্চ কারাদণ্ডের পরিমাণ হবে ১০০ বছরের বেশি। সম্প্রতি যে দু’টি অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিচার হল, তার প্রথমটি হল জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া এবং দ্বিতীয়টি হল দেশে কোভিড-১৯ বিধিনিষেধকে লঙ্ঘন করা।

আং সান সু চি উসকানি দেওয়ার মামলায় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইতিমধ্যেই ১০ মাস আটক রয়েছেন। যে হেতু প্রাথমিক কারাদণ্ডের পরিমাণ চার থেকে কমিয়ে দু’বছর করা হয়েছে, এই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে আরও এক বছর এবং দু’মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে এ রকম কোনও শাস্তি মকুব হয়নি।

ভারপ্রাপ্ত সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং দেশটিকে ঠিক এক দশক আগের অবস্থায় ফেরত নিয়ে গেছে।

নির্ধারিত বাজারদরের চেয়ে কম মূল্যে ভাড়ার সম্পত্তি ক্রয় করার ঘটনায় জুনটার আনা দুর্নীতির অভিযোগের শুনানিতে তিনি ১৭ ডিসেম্বর কারাগারের পোশাকে আদালতে হাজির হন।

মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনা আং সান সু চি-র জীবনে নতুন নয়। তিনি ইতিমধ্যেই গৃহবন্দি অবস্থায় জীবনের ১৫ বছর কাটিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত এক মাসের মধ্যে অভ্যুত্থান তার প্রথম বছর পূর্ণ করবে। এই ঘটনাকে এমন ভাবে দেখা যেতে পারে যে, ভারপ্রাপ্ত সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং দেশটিকে ঠিক এক দশক আগের অবস্থায় ফেরত নিয়ে গেছে। উল্লিখিত রায়ের প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং অভ্যুত্থানের কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।

২০১১ সাল থেকে সামরিক শাসকরা এন এল ডি পার্টিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য তাদের কিছু নীতি পরিবর্তন করেছিল যা অতি প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথ সুগম করেছিল। তিনটি বিষয়ের সংমেল, যথাক্রমে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং নাগরিকদের বিক্ষোভ, এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে, জুনটার রাজনৈতিক আগ্রহ এই ধরনের পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়নে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা সত্যি যে, সামরিক নেতারা মানুষের মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলেন এবং এটা তাঁরা জানতেন যে, তাঁদের ৮৮৮৮ বা ২০০৭ সালের গেরুয়া বিপ্লবের মতো আকস্মিক গণঅভ্যুত্থানকে যে কোনও মূল্যে এড়িয়ে চলতে হবে। এমনটা মনে করা হয়েছে যে, সামরিক সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এই ভাবেই ২০০৮ সালের সংবিধানের বলে বলীয়ান হয়ে— যেখানে জুনটার হাতেই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা থাকা সুনিশ্চিত করা হয়েছিল— তারা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল।

পূর্ববর্তী সরকার যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার অথবা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের এন এল ডি শাসনে নতুন সরকার সামান্যই পরিবর্তন এনেছে। এই সময়কাল জুনটা এবং অসামরিক সরকারের মধ্যে একটি ব্যবহারিক সম্পর্কের সাক্ষী থেকেছে, যেখানে গোটা বিশ্ব দেখেছে কী ভাবে জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের উপরে করা জুনটার নৃশংস অত্যাচারকে সরকার আড়াল করেছে।

২০২০ সালের নির্বাচন এই দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। কোভিড নিয়মাবলি, প্রতিরোধ এবং বিধিনিষেধগুলি প্রচারের বিষয় হয়ে উঠলেও, ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউ এস ডি পি) ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তির নির্বাচনী অপ্রাসঙ্গিকতা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক নেতাদের জন্য একটি চরম ধাক্কা দেয়। ২০২০ সালে এন এল ডি সরকারের একচেটিয়া জয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা সরকারের আইনি শাখার উপর সামরিক বাহিনীর প্রভাবকে ঘনীভূত করেছে। এটি সংবিধান সংস্কারের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যা অবশেষে সরকারের উপরে সামরিক বাহিনীর প্রভাবকে নির্মূল করবে। এটি এন এল ডির অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারত কারণ নির্বাচনী জনাদেশ অনুযায়ী তার নিজের শর্তে শাসন করার অধিকার ছিল। কিন্তু জুনটা কোনও মতেই এমনটা হতে দিতে পারত না এবং হয়তো নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ এবং তার পরবর্তী অভ্যুত্থানের নেপথ্যে এটিই প্রধান কারণ ছিল।

বর্তমান রায় দেশব্যাপী আন্দোলনকে লড়াইয়ের নতুন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তরুণরা নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জুনটার কার্যকলাপের প্রতিবাদ করায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ মানুষ খুন হয়েছেন, বহু গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। মূলত এন এল ডি পার্টির প্রাক্তন নেতাদের নিয়ে গঠিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট পার্টি সম্প্রতি জুনটাকে যৌথ ভাবে উৎখাত করার জন্য আরাকান ন্যাশনাল লিগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও দেখতে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

বিশ্বব্যাপী নিন্দা

বর্তমান শাস্তির বিধান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে ইতিমধ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে এবং ইন্টারনেট ও সংবাদ মাধ্যমগুলিতে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার ঢেউ উঠেছে। একটিতে এই রায়ের নিন্দা করা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে বলা হয়েছে যে, এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু দ্বিতীয় অভিমতটি গভীর উদ্বেগের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ই ইউ), রাষ্ট্রপুঞ্জ (ইউ এন), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইউ এস) এবং নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র প্রকাশ্যে এই কাজের নিন্দা করেছেন। ই ইউ-এর কূটনীতিক জোসেফ বোরেল এই রায়কে ‘রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান মিশেল বাকেলেট বলেছেন, যে আদালত সু চি-কে দোষী সাব্যস্ত করেছে তারা ‘জাল বিচার’ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদ এই রায়কে নিন্দা করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে এবং মায়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির পক্ষে সওয়াল তুলেছে। বর্তমান নেতাদের কর্মপন্থা পরিবর্তনে বাধ্য করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে।

২০২২ সালের আসিয়ানের সভাপতি হিসেবে, মায়ানমারের প্রতি কম্বোডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি আগামী দু’বছরের জন্য দেশের মধ্যে সমস্যাগুলি সমাধানে ব্লকের প্রচেষ্টাকে অভিমুখ দেবে।

প্রতিবেশী দেশগুলি আবারও গঠনমূলক সুর তুলেছে এবং এমন বিবৃতি দিয়েছে, যাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদ্বেগ ফুটে উঠেছে এবং সেগুলি অতিরিক্ত সমালোচনামূলক নয়। উদাহরণ স্বরূপ, জাপানের বিদেশমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেছেন যে, টোকিও বর্তমান রায় নিয়ে গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন যে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে নয়াদিল্লি চিন্তিত। উভয় দেশই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে।

চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, বেজিং আশা করছে ‘মায়ানমারের সব ক’টি দলই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ ও সূক্ষ্ম মতপার্থক্যের কথা মাথায় রাখবে এবং বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস আঞ্চলিক ব্লকের সভাপতি চার্লস সান্তিয়াগো এই সাজাকে ‘বিচারের নামে প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছেন, যা আঞ্চলিক ব্লকের সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপগুলি মেনে চলার ক্ষেত্রে জুনটার নেতিবাচক মনোভাবকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। অন্য দিকে আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসে পারস্পরিক আলোচনার পথ সুগম করতে মায়ানমার সফর করবেন। ২০২২ সালের আসিয়ানের সভাপতি হিসেবে, মায়ানমারের প্রতি কম্বোডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি আগামী দু’বছরের জন্য দেশের মধ্যে সমস্যাগুলি সমাধানে ব্লকের প্রচেষ্টাকে অভিমুখ দেবে। তার এই পদক্ষেপ যদিও তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে যে হেতু এমনটা করার অর্থ হল আসিয়ানের চোখে সামরিক শাসকদের কর্তৃপক্ষ হিসেবে বৈধতা দেওয়া— তবুও পারস্পরিক আলোচনার পথ খোলা ও তা সুগম করার জন্য এই ধরনের সফর প্রয়োজন। প্রকৃত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকলে এ হেন পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কয়েকটি নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝা জরুরি হলেও এর ফলে প্রত্যাশিত প্রভাব আনার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

যদি কেউ দেশ ও অঞ্চলটির সামগ্রিক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করেন, তা হলে জুনটাকে বাতিল করে দিলে বিশেষ সুবিধে হবে না। গঠনমূলক পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়নের জন্য জুনটার রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বরাবরই থাকবে। এ ক্ষেত্রে সারা বিশ্ব আরও একাধিক রায় এবং তার প্রভাবের আশঙ্কায় দিন গুনলেও গণতান্ত্রিক দেশগুলির জন্য তাদের বিদেশনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে মায়ানমারকে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.