এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
‘মলদ্বীপ প্রজাতন্ত্রকে বিনামূল্যে চিনের সামরিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে’ সম্প্রতি মলদ্বীপ ও চিন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর সরকারের অধীনে মালের ভারত থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়ার বিষয়টিকেই দর্শায়। এই চুক্তি শুধু মাত্র মলদ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকেই তুলে ধরে না, এর পাশাপাশি তা চিনকে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি প্রসারিত করার আর একটি সুযোগও প্রদান করে। এমনকি চুক্তিটি এ বিষয়েরও অন্যতম ইঙ্গিত যে, মুইজ্জু সরকার তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে চিনের দিকে ঝুঁকতে আগ্রহী। কিন্তু তা ভারতকে তার ক্ষুদ্র সামরিক উপস্থিতি অবিলম্বে প্রত্যাহার করার বিষয়ে মুইজ্জুর সর্বজনীন চূড়ান্ত শর্তের সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। ফলে এই সবই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন কৌশলগত বাস্তবতাকেও দর্শায়, যা আঞ্চলিক গতিশীলতার পরিবর্তন করতে পারে এবং নয়াদিল্লি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিকে কৌশলগত ভাবে অত্যাবশ্যক সামুদ্রিক পরিসরে নিজেদের নীতির বিকল্পগুলি পুনরায় মূল্যায়ন করতে প্ররোচিত করতে পারে।
একটি ধোঁয়াশাময় চুক্তি
মলদ্বীপ-চিন প্রতিরক্ষা চুক্তির মধ্যে গোপনীয়তা রয়েছে। চুক্তির একমাত্র জ্ঞাত দিকটি হল এই যে, চিনা সামরিক বাহিনী দ্বীপদেশটিকে বিনামূল্যে ‘অ-প্রাণঘাতী’ সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। এর ঊর্ধ্বে ঊঠে এই চুক্তি সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট বিবরণ জনপরিসরে উপলব্ধ নয়। যে সরকার প্রায়শই ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে মলদ্বীপে ৭৭ জন ভারতীয় সৈন্য এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ১২ জন চিকিৎসা কর্মীর উপস্থিতির কথা তুলে ধরছে, তাঁর জন্য এটি সত্যিই আশ্চর্যজনক যে, মলদ্বীপ চিনের মতো এমন এক দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যারা নিজেরাই অস্বচ্ছ ব্যবস্থার জন্য পরিচিত।
মালের চিন চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অবশ্যই মলদ্বীপের জনগণকেই বহন করতে হবে।
মুইজ্জুর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, এক স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া মালের সার্বভৌমত্বকে অদ্ভুত ভাবে প্রভাবিত করলেও কমিউনিস্ট কর্তৃত্ববাদী চিনের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না! মালের চিন চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অবশ্যই মলদ্বীপের জনগণকেই বহন করতে হবে।
মুইজ্জু যে তাঁর দেশের বিদেশনীতি পুনর্বিন্যাস করবেন, তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যখন তিনি ভারতকে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচার মুইজ্জুকে বেজিংয়ের পাশাপাশি ইসলামি শক্তির অন্যতম প্রিয় পাত্র করে তুলেছিল, যাদের মালের জন্য করা পরিকল্পনা ইব্রাহিম সোলিহ কার্যকর ভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর মুইজ্জুর কাছে প্রথম নিজে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই। তবে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রয়াস প্রত্যাশামাফিক ফল প্রদান করেনি। তবে যে কথা প্রত্যাশা করা যায়নি, তা হল ভারতের প্রতি মুইজ্জু প্রশাসনের তরফে প্রদর্শিত অবজ্ঞা। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের মধ্যে মতানৈক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু কাউকে জনসমক্ষে অসম্মান করা কাম্য বা বিচক্ষণ কাজ নয়।
আরও অশান্তির আশঙ্কা
এই আচরণের পরিণতি শুধু নয়াদিল্লি-মালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরেই নয়, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী হবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ উদ্বেগের বিষয় হওয়ায় প্রতিরক্ষা চুক্তিটিকে ভারত নিজেই গুরুত্ব সহকারে দেখবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের সামুদ্রিক উপস্থিতি যে বৃদ্ধি পাবে, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় উদ্বেগের নিরিখে আঞ্চলিক দেশগুলির জন্য একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় এবং এটি সম্ভবত আরও আঞ্চলিক অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ উদ্বেগের বিষয় হওয়ায় প্রতিরক্ষা চুক্তিটিকে ভারত নিজেই গুরুত্ব সহকারে দেখবে।
মুইজ্জুর চিনের প্রতি ঝোঁক ইতিমধ্যে মলদ্বীপের রাজনীতি ও সমাজকে বিভক্ত করেছে। মলদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সম্প্রতি প্রকাশ্যে বলেছেন যে, ‘মলদ্বীপের জনগণ দুঃখিত’ এবং মুইজ্জুর প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নয়াদিল্লির ঋদ্ধ নীতি প্রতিক্রিয়ার উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। একটি বিভক্ত জাতিকে একত্রিত করার জন্য তাঁর নির্বাচনী বিজয়কে ব্যবহার করার পরিবর্তে মুইজ্জু নিজের বিভাজনমূলক কর্মসূচিকে দ্বিগুণ করে তুলেছেন বলে মনে হচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হবে।
কিন্তু এই মনোভাব মলদ্বীপকে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক চাপানউতোরের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে, যা এই মুহূর্তে অবশিষ্ট বিশ্বকে আকার দিচ্ছে। শুধু মাত্র নয়াদিল্লিই একা নয় যে দ্বীপদেশটিতে চিনা উপস্থিতির উপর নজর রাখছে, অন্যান্য প্রধান শক্তিও মালের প্রতি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করছে বা নতুন করে তৈরি করতে চলেছে। এই সব কিছুই বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মূল বিচ্যুতিরেখা হিসাবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের কেন্দ্রীয়তার দরুন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে ভারতের শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং এটি মালের ভবিষ্যতের বিদেশনীতির গতিপথ একাধিক উপায়ে প্রভাবিত করবে।
অন্যান্য বিকল্পের খোঁজে ভারত
ভারত ইতিমধ্যেই তার নিজস্ব পন্থার ঊর্ধ্বে উঠে ভাবছে এবং পুনর্বিন্যাসও করছে। ভারতীয় নৌবাহিনী ইতিমধ্যে তার ‘কার্যকরী নজরদারি’ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি মলদ্বীপের প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপে তার নতুন নৌ ঘাঁটি আইএনএস জটায়ুর প্রস্তাব দিয়েছে।
ভারত মহাসাগরের অন্য উপকূলীয় দেশগুলির সঙ্গে নয়াদিল্লির দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে এবং কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের মতো নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থাগুলি গতিশীল হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জুগনাউথ যৌথ ভাবে আগালগা-র মরিশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে একটি নতুন এয়ারস্ট্রিপ ও জেটি উদ্বোধন করেছেন, যা ভারতকে দ্বীপে বড় বিমান নোঙর ও মোতায়েন করার অনুমতি দেয়। ভারত মহাসাগরের অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলির সঙ্গে নয়াদিল্লির দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে এবং কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের মতো নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থাগুলি গতিশীল হচ্ছে। মালে গত বছরের অধিবেশন এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও মরিশাস ২০২২ সালে সদস্য হয় এবং বাংলাদেশ ও সেশেলস পর্যবেক্ষক হিসাবে এই কনক্লেভে অংশ নিয়েছে।
ভারতের জন্য ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক পরিসরটি সত্যিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মলদ্বীপের সঙ্গে অস্থির সম্পর্কের দরুন অস্থায়ী সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য নয়াদিল্লির কাছে থাকা বিকল্প নেহাতই সীমিত নয়। কিন্তু বিদেশনীতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখার বিষয়ে মুইজ্জু সরকারের অক্ষমতা ভারত মহাসাগরের অশান্ত জলরাশিতে মালের নিজস্ব কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.