বেশ কিছু সপ্তাহ যাবৎ ভারত ব্যস্ত থেকেছে। নভেম্বর মাসের শুরুতে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২+২ স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগের পরপরই ২০ নভেম্বর ভারত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আর একটি ২+২ কৌশলগত আলোচনার আয়োজন করে। ২০ নভেম্বর ভারত-অস্ট্রেলিয়া বিদেশমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনার দ্বিতীয় সংস্করণের আয়োজক হল নয়াদিল্লি। অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ও ডিফেন্স মিনিটার রিচার্ড মার্লেস এবং ফরেন মিনিস্টার পেনি ওং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার জন্য নয়াদিল্লিতে এসেছিলেন। মন্ত্রীরা তাঁদের সমকক্ষদের সঙ্গে পৃথক দ্বিপাক্ষিক আলোচনাও সারেন।
অস্ট্রেলিয়া-ভারত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা গত তিন বছরে অভাবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা বিশেষ করে বলা যায় কারণ দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে একটি ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার কাজ শুরু করেছে মাত্র ২০২০ সালের জুন মাস থেকে। দুই দেশের মধ্যে ২+২ মন্ত্রী-পর্যায়ের আলোচনার উদ্বোধনী দফা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভারত ২+২ মন্ত্রী-পর্যায়ের কৌশলগত আলাপ-আলোচনায় সম্পৃক্ত হয়েছে শুধুমাত্র গুটিকয়েক দেশের সঙ্গেই (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান তাদের মধ্যে দুই দেশ; কাকতালীয় নয় যে, এই দুই দেশ কোয়াড অংশীদারও)। এবং তা ভারতের কৌশলগত গণনায় অস্ট্রেলিয়ার তাত্পর্যকেই প্রতিফলিত করে।
২০২১ সালের উদ্বোধনী আলোচনায় ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া একটি সামরিক সরবরাহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা দুই দেশের সামরিক বাহিনীকে একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে মেরামত ও ঘাটতি পূরণ করার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক প্রবেশাধিকার প্রদান করে। এ হেন চুক্তি দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে জোরদার করে, যা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে সহজতর করে।
তাঁর সফরের আগে মার্লেস ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা অস্ট্রেলিয়ার ইন্দো-প্যাসিফিককে উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিস্থাপক রাখার পদ্ধতির কেন্দ্রে রয়েছে।’ তিনি পার্থে ভারতীয় ডুবোজাহাজের সফর এবং মালাবার অনুশীলনের অস্ট্রেলীয় আয়োজন-সহ সম্পর্কের অন্যান্য অগ্রগতির দিকেও ইঙ্গিত করেন।
সিং এবং মার্লেসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দু’জনই এ বিষয়ে সম্মত হন যে, সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অ্যান্টি-ড্রোন এবং অ্যান্টি-সাবমেরিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বর্ধিত অংশীদারিত্বের সুযোগ রয়েছে এবং এর পাশাপাশি মেরিটাইম ডোমেন অ্যাওয়ারনেস (এমডিএ) এবং সাবসারফেস ডোমেন অ্যাওয়ারনেস… উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সহযোগিতা জোরদার করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি দুই মন্ত্রী প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতাকে তাঁদের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে তুলে ধরেন। সিং জাহাজ নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি বিমান রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং সামগ্রিক সংস্কারকে সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরেন।
দুই মন্ত্রী জলের নীচের প্রযুক্তি সংক্রান্ত যৌথ গবেষণা এবং দুই দেশের প্রতিরক্ষামূলক স্টার্ট আপের মধ্যে অংশীদারিত্বের বিষয়েও সম্মত হয়েছেন। সিং এবং মার্লেস আরও উল্লেখ করেছেন যে, ‘একটি শক্তিশালী ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রতিরক্ষামূলক অংশীদারিত্ব শুধুমাত্র দুই দেশের পারস্পরিক সুবিধার জন্যই নয়, বরং ইন্দো-প্যাসিফিকের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্যও জরুরি।’
দুই বিদেশমন্ত্রী ২১ নভেম্বর ১৪তম ফরেন মিনিস্টেরিয়াল ফ্রেমওয়ার্ক ডায়লগের জন্য পৃথক ভাবেও সাক্ষাৎ করেন, যেখানে তাঁরা দ্বিপাক্ষিক সামগ্রিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের অবস্থা পর্যালোচনা করেন এবং একই সঙ্গে এই অঞ্চল ও তার বাইরেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেন। দুই বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সম্পর্কে বলতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন যে, ‘আলোচনা খুব ভাল হয়েছে’। এবং তিনি অংশীদারিত্বের ‘একটি বাস্তব গতিশীলতা’কেই নির্দেশ করেন। একই ভাবে, অস্ট্রেলিয়ার ফরেন মিনিস্টার ওং উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন যে, ২০২৩ সালটি ‘আমাদের অংশীদারিত্বের একটি মাইলফলক বছর এবং এটি সমগ্র অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
২+২ আলোচনার যৌথ বিবৃতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দেয়। বিবৃতিতে ‘ভারত-অস্ট্রেলিয়া সামগ্রিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ইতিবাচক ও বর্ধিত গতিশীলতা’র উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে জয়শঙ্কর উল্লেখ করেছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ২+২ আলোচনা ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ও গভীরতর সম্পৃক্ততারই প্রতিফলন।’ তিনি ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্যিক চুক্তি কার্যকর হওয়া, প্রথম বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন, অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টারের দু’টি সফর এবং ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক-সহ নানাবিধ দিক তুলে ধরেন। উভয় পক্ষ নতুন দূতাবাস খুলতেও সম্মত হয়েছে, যা সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান অ-নিরাপত্তা উপাদানের দিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু নিরাপত্তা উপাদান আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। জয়শঙ্কর বলেন যে, উভয় দেশই ‘ক্রমবর্ধমান সাধারণ অভিন্নতা ভাগ করে নিয়েছে’ যার মধ্যে রয়েছে ‘সমুদ্রের সংবিধান হিসাবে আনক্লজ-এর উপর ভিত্তি করে একটি অবাধ, মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ এবং নিয়ম-ভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য অভিন্ন অঙ্গীকার।’ এই জাতীয় বক্তব্যে ইন্দো-প্যাসিফিকের নিয়ম-ভিত্তিক আদেশের উপর জোর দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই চিনের দিকে ইঙ্গিত করে, যার কথা ভারত ও অস্ট্রেলিয়া মাথায় রেখেছে। তবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমস্যাও আলোচনায় উঠে এসেছে এবং যৌথ বিবৃতিতে ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং তার দুঃখজনক মানবিক পরিণতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ, ‘ইউক্রেনে সামগ্রিক, ন্যায্য এবং স্থিতিশীল শান্তির জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের সব সনদের উদ্দেশ্য এবং নীতিগুলিকে সমর্থন’ প্রসঙ্গে দুই দেশের তরফে একই সুর অনুরণিত হয়েছে।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, দুই দেশ একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত, বিশেষ করে কৌশলগত ক্ষেত্রে অবশ্যই। উভয়ই একে অপরকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে মনে করে এবং ক্যানবেরা ও নয়াদিল্লি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃত পক্ষে, কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় ভারত সরকারের ভূমিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় প্রবাসীদের রাজনীতি সম্পর্কে উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু উদ্বেগের মতো সম্ভাব্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধরত চিন সম্পর্কে কৌশলগত স্বার্থ ও উদ্বেগগুলি ভারত-অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কটিকে একটি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.