এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এনডিটিভি-তে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোল্যান্ড ও ইউক্রেন সফর তাদের নিজ নিজ দিক থেকে ঐতিহাসিক: পোল্যান্ডের জন্য এটি ৪৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং ইউক্রেনের জন্য কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর। যেখানে মোদী ভারত ও পোল্যান্ডের ‘গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের প্রতি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি’ সম্পর্কে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার কথা বলেছেন, সেখানে তিনি ইউক্রেনে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আশা’ ব্যক্ত করেছেন।
প্রায়শই ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে চিন এবং ভারতকে একই বন্ধনীতে রাখা হয়। কিন্তু মোদীর গত মাসে বহু বিতর্কিত রাশিয়া সফরের পরে এই সপ্তাহে ইউক্রেন সফরের দিকে নজর রাখলে বোঝা যাবে বিশ্বের কারওই আসলে ভারত ও চিনের মধ্যে তুলনা করা উচিত নয়।
ইউরোপে ভারতের ভূমিকা মধ্যস্থতাকারীর চাইতেও বেশি
গত মাসে মোদীর রাশিয়া সফর অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিল। কারণ এটি ছিল মোদীর তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বিদেশ সফরও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অন্যতম সম্ভাব্য শান্তিরক্ষক হয়ে ওঠার কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এমনটা ভাবা বৃহত্তর আঙ্গিককে উপেক্ষা করে সাময়িক লক্ষ্যের উপরে নজর দেওয়ার সামিল। যুদ্ধের বিষয়ে নয়াদিল্লির অবস্থান আগে যা ছিল, তাই-ই রয়েছে, সে কথা তুলে ধরতেই মোদী ইউক্রেন সফর করছেন। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এবং রাশিয়াকে আগ্রাসী হিসাবে প্রকাশ্যে না বলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্ত্বেও, নয়াদিল্লি সর্বদা বজায় রেখেছে যে, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পবিত্রতা আন্তর্জাতিক বিষয়ে অলঙ্ঘনীয় এবং আলোচনা ও কূটনীতিই স্থিতিশীল ফলাফল নিয়ে আসতে পারে।
গত মাসে মোদীর রাশিয়া সফর অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিল। কারণ এটি ছিল মোদীর তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বিদেশ সফরও।
চিনের বিপরীতে মস্কো সফরের সময় মোদী প্রকাশ্যে পুতিনকে বলেছিলেন যে, এটি যুদ্ধের যুগ নয় এবং কিয়েভের প্রধান হাসপাতালে রাশিয়ার একটি প্রাণঘাতী হামলার পরে শিশুদের মৃত্যুতে বেদনা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়া সফরের জন্য মোদীর নিন্দা করেছিলেন এবং এই সফরকে ‘শান্তি প্রচেষ্টার জন্য ধ্বংসাত্মক আঘাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু নয়াদিল্লি গত আড়াই বছর ধরে যুদ্ধ চলাকালীন মস্কো ও কিয়েভ উভয়ের সঙ্গেই তার সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এবং মোদী এই বিশ্বাসে অবিচল রয়েছেন যে, কোনও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হলে উভয় পক্ষের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে হবে।
ইউরোপের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
ইউরোপ ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, বিস্তৃত আঞ্চলিক বিভাজন, একটি এমন যুদ্ধ যা শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণই দর্শায় না, ক্রম-আগ্রাসী চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদের আহ্বান এবং ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সমীকরণ বদলে যাওয়ার এক অভূতপূর্ব মুহূর্তের সম্মুখীন। ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি সম্ভবত ইউরোপে একটি নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে। কিন্তু সেই সমাপ্তির সম্ভাবনা মোটেও দেখা যাচ্ছে না। কারণ উভয় পক্ষই যুদ্ধক্ষেত্রের অনুকূল বাস্তবতা খুঁজতে আগ্রহী, যাতে দুই পক্ষই আলোচনার টেবিলে এলে সম্ভাব্য ভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়ে উঠতে পারে। এই সঙ্কটময় সময়েই ইউরোপ ভারতকে মূল অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।
আর নয়াদিল্লিও পাল্টা প্রত্যুত্তর দিয়েছে। ভারত এখন ইউরোপকে তার উন্নয়নমূলক এবং কৌশলগত অগ্রাধিকারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মনে করে। মোদী সরকার ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে গতিশীল করার জন্য যে অসাধারণ কূটনৈতিক বিনিয়োগ করেছেন, তা থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। ইউরোপের প্রতি ভারতের এই মনোভাবের একটি বিকশিত বৈশিষ্ট্য হল ইউরোপের বিভিন্ন উপ-অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য ভারতের প্রচেষ্টা, যা নয়াদিল্লিকে তাদের মূল শক্তিগুলির উপর মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। ভারতের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে মধ্য ইউরোপ। মোদী গত মাসে অস্ট্রিয়া সফরের পরে এখন পোল্যান্ড ও ইউক্রেন সফর করছেন। বিশেষ করে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে অঞ্চলটি ইউরোপীয় বিষয়ে নিজস্ব স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর গড়ে তুলেছে এবং এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলির জন্য বৃহত্তর ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
নয়াদিল্লির কাছে পোল্যান্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ
পোল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম এবং ইউরোপকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কৌশলগত আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউক্রেনে যুদ্ধের সূচনা শীতল হয়ে এলে ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনে ওয়ারশ-র ভূমিকাও জরুরি হবে। এটির অবস্থান পোল্যান্ডকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে সংযোগের একটি কেন্দ্র করে তোলে এবং এ ক্ষেত্রে পোল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ভারতের সদিচ্ছা রয়েছে। ভারত যদি তার ইউরোপীয় ভাবনায় ফ্রান্স, জার্মানি এবং ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে পোল্যান্ডের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ হবে। মোদীর সফর ওয়ারশ-র সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল অংশীদারিত্বের ভিত্তি স্থাপন করবে।
ইউক্রেনে যুদ্ধের সূচনা শীতল হয়ে এলে ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনে ওয়ারশ-র ভূমিকাও জরুরি হবে।
এটি নয়াদিল্লির স্বার্থের অনুকূল যে ইউরোপে একটি স্থিতিশীল নিরাপত্তা কাঠামো আকার ধারণ করছে। কারণ ইউরোপীয় স্থিতিশীলতা সেই ভৌগোলিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ সমতা-সহ বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ত ভারতের জন্য উল্লেখযোগ্য। নয়াদিল্লি শুধু মাত্র মধ্যস্থতার ভূমিকাই পালন করবে না। ভারতের দৃষ্টি নিবদ্ধ বৃহত্তর স্বার্থের দিকে, যেখানে ইউরোপের একটি বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসাবে ভারতের উত্থানকে বৃহত্তর ব্যাঘাত থেকে তার নিজস্ব উন্নয়নমূলক এবং কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখার সঙ্গে সমাপতিত বলে মনে হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.