গত দুই বছরে ভারত ও মিশরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ধারাবাহিক উন্নতি ঘটেছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক প্রধানেরা এই সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৯৯৭ সালের পর প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জুন মাসে কায়রো সফর করলেন। এটি বর্তমান সরকারের সময় ভারতের পশ্চিম এশিয়া নীতিতে আরেকটি সংশোধন হিসাবে দেখা হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ডায়াস্পোরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অঞ্চলটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতা এল–সিসি গত জানুয়ারিতে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ভারতে এসেছিলেন, এবং সেপ্টেম্বরে জি–২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য মিশরকেও ভারত আমন্ত্রণ জানিয়েছে। নয়াদিল্লি ও কায়রো উভয়ই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের অধীনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) যুগ থেকে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভাগীদার। যাই হোক, পরবর্তী দশকগুলিতে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়েছিল, কারণ রাজনৈতিক উথালপাতাল প্রায়শই মিশরকে রাহুগ্রস্ত করেছিল। ভারতের বিদেশনীতিও ১৯৯০–এর দশকে উদারীকরণ–পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
সিসির অধীনে মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরে নিষিদ্ধ, এবং তা কায়রোর সঙ্গে আবুধাবি ও রিয়াদের সম্পর্ক সুগম করেছে।
আরব বসন্তের পরবর্তী মিশর মাঝে মাঝে এক ধরনের নির্বাচনী–গণতন্ত্র ব্যবস্থায় উত্তরণের অপেক্ষা করছিল। যাই হোক, একটি আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ২০১২ সালের মিশরীয় নির্বাচন অনেকের কাছে অপ্রীতিকর হয়ে উঠেছিল ,কারণ মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মোরসি শীর্ষে উঠে আসেন এবং আরব বিশ্বের কোনও রাষ্ট্রের প্রথম ইসলামপন্থী শাসক হয়ে ওঠেন। যদি একে আদর্শগত পছন্দ বলে ভাবা হয়, তা হলে তা অনেককেই উদ্বিগ্ন করেছিল, এবং নয়াদিল্লিতে এই ঘটনাকে একেবারেই পছন্দ করা হয়নি। একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র তিন মাস আগে মোরসি ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ভারত সফর করেছিলেন, যদিও ভারত মূলত সব ধরনের রাজনৈতিক ইসলামকে চরমপন্থার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’–এর বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করে। বহুত্ববাদ, আকর্ষণীয়ভাবে, এই একদিনের সফরের একটি শীর্ষ অ্যাজেন্ডা ছিল। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার জন্য ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তৎকালীন যুগ্ম সচিব রাজীব শাহরে বলেছিলেন, ‘‘এটি (বহুত্ববাদ) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মিশর দেখছে।’’ ভারত দূরে বসে এই বিষয়ে আলোচনা চালালেও মিশরের নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের কাছে ব্রাদারহুডের জন্য এই ধরনের মনোভাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। সিসির অধীনে মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরে নিষিদ্ধ, এবং তা কায়রোর সঙ্গে আবুধাবি ও রিয়াদের সম্পর্ক সুগম করেছে। এই আন্তঃআঞ্চলিক ভূ–রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়াদিল্লির মতো অনেককেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা এবং কায়রোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার জন্য উপযুক্ত সুযোগ দিয়েছে।
আগামী দিন
এই বছরের শুরুর দিকে সিসির ভারত সফর এবং মোদীর পাল্টা সফর প্রকৃতপক্ষে একটি নতুন যুগের উপযোগী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি শক্তিশালী মঞ্চ উপস্থাপিত করেছে। মিশর যখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় পারস্পরিকভাবে উপকারী ও উদারীকৃত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থা ব্যবহার করে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করা যায়, এবং এই ধরনের কর্মসূচি কার্যকর করার উপযোগী মৌলিক কাঠামো স্থাপন করা যায়। এগুলিকেই অদূর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ হিসাবে গণ্য করা উচিত। অদূর ভবিষ্যতে কৃষি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, সবুজ অর্থায়ন, দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থার মোকাবিলা এবং অভিন্নতার অন্য ক্ষেত্রগুলি সহজলভ্য, আর তার জন্য প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও সম্পদ।
যাই হোক, উভয় রাষ্ট্র দ্বারা নির্ধারিত কর্মসূচিগুলিও বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। দেশে তৈরি হ্যাল তেজস বিক্রির জন্য ভারতের অতি্রিক্ত বিপণন-উদ্যোগ তার লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। এক্ষেত্রে একটি বড় মাপের প্রতিরক্ষা চুক্তির বাস্তবসম্মত প্রত্যাশার পরিবর্তে ঘরোয়া জয়ের সন্ধান করা হয়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে ভবিষ্যতে এই ধরনের চুক্তি করা সম্ভব নয়। কিন্তু অ–শস্ত্র সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, আইটি সমাধান এবং এমনকি ছোট অস্ত্র ও সামরিক সরবরাহের মতো ক্ষেত্রে অর্জনযোগ্য লক্ষ্যগুলি মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে মিশরীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিবিড় করা আরও আদর্শ পথ হবে, বিশেষ করে মিশরীয় সামরিক বাহিনীর মধ্যে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তোলার জন্য। মিশর ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন সামরিক সাহায্যের উপর নির্ভর করত, এবং এখনও এফ–১৫ যুদ্ধবিমানের মতো মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে কায়রো এর মধ্যে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেনি। তার কাছে রুশ ও চিনা অস্ত্রও আছে, এবং সেইভাবে ভবিষ্যতে ভারতীয় সংস্থাগুলির জন্যও একটি ভাল সুযোগ থাকছে।
অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হ্যাল তেজস বিক্রির জন্য ভারতের অতি্রিক্ত বিপণন-উদ্যোগ তার লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। একটি বড় মাপের প্রতিরক্ষা চুক্তির বাস্তবসম্মত প্রত্যাশার পরিবর্তে ঘরোয়া জয়ের সন্ধান করা হয়েছিল।
পরিশেষে, ভারত ও মিশর উভয়ই এমন একটি বিশ্বে প্রবেশ করছে যেখানে তাদের কিছু স্বার্থ একমুখী, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে আসন্ন দ্বিমেরু বৈশ্বিক সংঘর্ষে নিরাপদ স্থান বজায় রাখা, এবং ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধের মধ্যে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করা। এটি করার থেকে বলা সহজ, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ভারত যদি বহুমেরু বিশ্বে একটি মেরু হতে চায়, কিছু ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বা সৌদি আরবের মতো দেশও তাই চায়। এই নতুন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে অনেকগুলিই বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সুবিধা পাওয়ার জন্য আজ একই পথের পথিক। পরে কিন্তু বৈশ্বিক শৃঙ্খলার মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি চোরাস্রোতও থাকবে। অনেকে যেমন মতামত দেন, তার বিপরীতে এটি একটি স্বাস্থ্যকর অনুমান এবং ঘটনাটি মোটেই ক্ষতিকারক হবে না।