Author : Harsh V. Pant

Published on Jul 18, 2023 Updated 0 Hours ago
ফ্রান্সে মোদী – অতীতের উদযাপন, ভবিষ্যতের প্রস্তুতি

বর্তমান সময়টি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের একটি মুহূর্ত। দেশগুলি প্রাণপণে চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছে। এই অনিশ্চিত পরিবেশে এগোনোর জন্য নতুন অংশীদারিত্ব এবং নতুন মঞ্চগুলি আকার পাচ্ছে। এমন এক সময়ে ভারত বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সমস্ত বৃহৎ শক্তি ভারতের সঙ্গে জোরালো অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী। ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যস্ত নির্ঘণ্ট উদীয়মান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রিকতার সাক্ষ্য বহন করে। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকায় তাঁর সফল রাষ্ট্রীয় সফরের পরে প্রধানমন্ত্রী মোদী এই সপ্তাহে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ডে অর্থাৎ বাস্তিল দিবস উপলক্ষে প্রধান অতিথি হিসাবে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন।

এই সফরটি ছিল তাঁদের দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বর্ষপূর্তি উদযাপন, যেখানে মোদীকে ম্যাক্রোঁ কর্তৃক গ্র্যান্ড ক্রস অফ দ্য লিজিয়ন অব অনার প্রদান করা হয়। একটি ২৬৯ সদস্যের ভারতীয় ট্রাই-সার্ভিসেস কন্টিনজেন্ট বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে এবং ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’র সুরে কুচকাওয়াজ করে। এর পাশাপাশি ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) তিনটি রাফালে যুদ্ধবিমান ফরাসি জেটের সঙ্গে যৌথ ভাবে ফ্লাইপাস্টে যোগ দেয়।

ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যস্ত নির্ঘণ্ট উদীয়মান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রিকতার সাক্ষ্য বহন করে।

ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, যেখানে ফ্রান্স কাশ্মীর থেকে পারমাণবিক শক্তি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ভাবে বিতর্কিত ও বিভাজনমূলক বিষয়গুলিতে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন জুগিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদকে সমর্থন করার জন্য ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারকারী প্রথম দেশ ছিল ফ্রান্স। দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গত শতাব্দীর শেষ দশকে গতিশীল হয়ে ওঠে। পারমাণবিক পরীক্ষার পরে যখন বিস্তৃত পশ্চিমী শক্তিগুলি ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, ফ্রান্স সেই হাওয়ায় গা ভাসায়নি। ইন্দো-ফরাসি সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল যে, দুই দেশই একবিংশ শতাব্দীতে এই বন্ধুত্বের সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সমমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি এ কথাই প্রমাণ করে। উভয় নেতাই যে কোনও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্স রাশিয়ার প্রতি ভারতের মতোই বাস্তবিক ব্যবহারিক মনোভাব প্রদর্শন করেছিল। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের জন্য প্রায়শই ফ্রান্সের অব্যবহিত সমর্থনও দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করে দেয়। ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীরতর করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ফ্রান্স ভারতের একটি প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরে এই অংশীদারিত্ব একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতকে একটি দেশের উপর তার অত্যধিক কৌশলগত নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। তাই ভারত প্রতিরক্ষা উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বাড়ানোর প্রতি মনোনিবেশ করছে। এ কাজে ফ্রান্সের মতো দেশগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; তারা কেবল অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতেই প্রস্তুত নয়, বরং তাদের প্রযুক্তি ভাগ করে নিয়ে যৌথ উৎপাদন এবং যৌথ উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করতে আগ্রহী। পি৭৫ প্রোগ্রামের অধীনে তিনটি অতিরিক্ত ডুবোজাহাজ নির্মাণের জন্য মাজাগাওঁ ডকইয়ার্ড লিমিটেড ও নেভাল গ্রুপের মধ্যে একটি মউ বা সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা সাফরান এবং ডিআরডিও-র (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) মধ্যে একটি যুদ্ধবিমান ইঞ্জিনের যৌথ নির্মাণকে সমর্থন জুগিয়ে উন্নত অ্যারোনটিক্যাল প্রযুক্তিতে সহযোগিতার জন্য একটি পথনির্দেশিকা প্রদানের মাধ্যমে ভারত-ফরাসি প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা রাখে। উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য ভারত প্যারিসে তার দূতাবাসে ডিআরডিও-র একটি প্রযুক্তি কার্যালয় স্থাপন করবে।

ভারত প্রতিরক্ষা উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বাড়ানোর প্রতি মনোনিবেশ করছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি ভারত এবং ফ্রান্সের জন্য অভিন্ন স্বার্থবিশিষ্ট একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। তাই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত-ফ্রান্স আন্তঃসহযোগিতার একটি পথনির্দেশিকার সূচনা এই সম্পৃক্ততাকে আরও কার্যকরী করে তুলতে পারে। এই ভৌগোলিক পরিসরে উভয় দেশের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে তারা নতুন মঞ্চ তৈরিতে অন্য সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গেও জোটবদ্ধ হয়েছে। যেখানে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের সঙ্গে একত্রে একটি জোট শক্তিশালী হয়ে উঠছে, সেখানে ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ভারত আরব সাগরে তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে জোটবদ্ধ হচ্ছে। ফ্রান্স থেকে ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সফরও যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ।

মোদী ফ্রান্সে ভারতের ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) চালু করার পাশাপাশি ফরাসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত (স্নাতকোত্তর এবং তৎপরবর্তী) ভারতীয়দের জন্য পাঁচ বছরের বৈধতাসম্পন্ন স্বল্পস্থায়ী শেনজেন ভিসার কথা ঘোষণা করেন। দক্ষ পেশাদারদের গতিশীলতা এখন বিস্তৃত পশ্চিমী শক্তিগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার একটি প্রধান দিক হিসেবে উত্থিত হচ্ছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসার সুযোগ বাড়ানোর ফ্রান্সের সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন ইউরোপীয় দেশগুলি অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশগুলির সঙ্গে একজোটে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়া অসংখ্য ছাত্রকে আকৃষ্ট করছে। ব্লু  ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি এবং সামুদ্রিক প্রশাসন থেকে শুরু করে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেমিকন্ডাক্টর ও ডিজিটাল প্রযুক্তি-সহ একাধিক বিষয়ে ভারত এবং ফ্রান্সের একজোটে কাজ করার পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী ফরাসি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদের ভারতের বৃদ্ধির আখ্যানের অংশ হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ভারতীয় অর্থনীতির গতিশীলতা এখন বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট জায়ান্ট বা বৃহৎ কর্পোরেটগুলিকে ভারতে বিনিয়োগ করার জন্য প্রলুব্ধ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত এফটিএ-কে কার্যকর করতে সদিচ্ছা প্রদর্শন করেছে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি নেতৃত্বও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

ভারত এবং ফ্রান্স তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করার ফলে মোদীর সফর সম্পর্কের এই কাঠামোকে পরবর্তী ২৫ বছরের জন্য প্রস্তুত করেছে। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নয়াদিল্লি এবং প্যারিসের জন্য আন্তঃসহযোগিতার নতুন পথ খুলে দেবে, যা রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক বলে মনে করা হচ্ছে।


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.