Author : Shoba Suri

Published on Aug 26, 2021 Updated 0 Hours ago

ল্যানসেটের সমীক্ষা অনুযায়ী, টিকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য শিশুরোগের ঝুঁকি ঠেকাতে নিয়মিত টিকাকরণের পদ্ধতিকে আরও মজবুত করে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

কোভিড অতিমারির ফলে লক্ষ লক্ষ শিশু নিয়মিত টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে

শিশুদের প্রাণরক্ষার জন্য টিকাকরণ অত্যন্ত জরুরি এবং সাশ্রয়ীও বটে। কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির ভীতিতে গত বছর বিশ্ব জুড়ে প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ শিশু নিয়মিত টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অতিমারির ফলে প্রতিরোধযোগ্য শিশুরোগের জন্য প্রয়োজনীয় টিকাকরণের নিম্নগামী হার এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ অতিমারিতে লকডাউনের বিধিনিষেধ, স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব এবং অতিমারি আটকাতে টিকাকরণের কাজে বরাদ্দ অর্থের খাত বদল ইত্যাদি কারণে টিকাকরণের সচেতনতামূলক প্রচার এবং কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে। দেখা গেছে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির ক্ষেত্রে শিশু টিকাকরণে প্রতি ১ ডলারের বিনিয়োগ ৪৪ ডলারের মুনাফা এনে দেয়।

প্রদত্ত টিকাকরণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক দশকব্যাপী প্রায় সমহারে চলার পরে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী টিকাকরণের হার ৮৩%-এ নেমে এসেছে এবং টিকাবিহীন শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ৩৪ লক্ষ। সম্প্রতি ল্যানসেটের করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০২০ সালের শেষে প্রয়োজনীয় ও প্রদত্ত টিকাকরণের মাঝে বিস্তর ফারাক ঘটে গেছে, যা ২০২১-সালেও বহাল থাকবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভারতে ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-পারটিউসিস (ডিটিপি)৩ এবং বসন্তের টিকাকরণের হার যথাক্রমে ৭৬.৭% এবং ৭৮.৯%-এ নেমে আসতে চলেছে। ভারতে ডিটিপি ৩ টিকাকরণের হার ইতিমধ্যেই ৯১% থেকে ৮৫%-এ নেমেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের দেওয়া সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভারতে প্রায় ৩০ লক্ষেরও বেশি শিশু ডিটিপি ৩-এর প্রথম দফার টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে যা ২০১৯ সালে টিকা না পাওয়া শিশুর সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি।

ইন্দ্রধনুষ প্রকল্পের কর্মসূচির ফলে ইতিমধ্যেই ভারত টিকাকরণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে, যার লক্ষ্য হল প্রতি বছর ২ কোটি ৭০ লক্ষ নবজাতক এবং ২ কোটি ৯০ লক্ষ গর্ভবতী মহিলার টিকাকরণ। তবুও সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপে সদ্যোজাত শিশুদের বড় অংশ অসুস্থতা ও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে চলেছে।

ইন্দ্রধনুষ প্রকল্পের (এখন ইন্টেন্সিফায়েড মিশন ইন্দ্রধনুষ—আই এম আই) এর কর্মসূচির ফলে ইতিমধ্যেই ভারত টিকাকরণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে, যার লক্ষ্য হল প্রতি বছর ২ কোটি ৭০ লক্ষ নবজাতক এবং ২ কোটি ৯০ লক্ষ গর্ভবতী মহিলার টিকাকরণ। তবুও সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপে সদ্যোজাত শিশুদের বড় অংশ অসুস্থতা ও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে চলেছে। নিউমোনিয়া এবং ডায়েরিয়া প্রগ্রেস রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, ভারতে নিউমোনিয়া ও আন্ত্রিকের ফলে প্রায় ৫ লক্ষ মৃত্যু হয়। মৃত্যুর হারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নাইজেরিয়া। হস্তক্ষেপ ব্যতীত স্তন্যপান, টিকাকরণ, পানীয় জল ও শৌচের সুব্যবস্থা এবং বায়ুদূষণের পরিমাণ হ্রাসের মাধ্যমে ভারতে এই মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমানো সম্ভব।

ভারতের ২২টি রাজ্য/ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাম্প্রতিক এনএফএইচএস-৫ (২০১৯-২০) তথ্য অনুযায়ী, ১২-২৩ মাস বয়সি শিশুদের সার্বিক টিকাকরণে উন্নতি হয়েছে, যেমনটা দেখানো হয়েছে চিত্র ১-এ। এনএফএইচএস-৪ (২০১৫-১৬)-এর জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী সার্বিক টিকাকরণের হার ছিল ৬২%।

চিত্র ১

বিপন্ন শিশুদের মধ্যে টিকাকরণে বৈষম্য ভারত ও ভারতের মতো অন্য জনবহুল দেশগুলির এক অন্যতম সমস্যা। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে টিকাকরণ এবং পিছিয়ে পড়া ও নিচুতলার মানুষদের টিকা না পাওয়ার পরিসংখ্যান আদতে টিকাকরণ পদ্ধতির বৈষম্যকেই সুস্পষ্ট করে তোলে।

সাম্প্রতিক কালে করা কয়েকটি সমীক্ষায় ভারতে বেশ কিছু রাজ্যে টিকাকরণের ক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থার বৈষম্যের প্রভাব কমতে দেখা গেলেও, এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারতে টিকাকরণের হার মাত্র ১৯% বৃদ্ধি পেয়েছে যার অন্যতম কারণ হল সচেতনতার অভাব, পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও টিকা পাওয়ার অসুবিধে।

শিশুর টিকাকরণ সংক্রান্ত দ্বিধা ভারতে এক গভীর সমস্যা, যার মূল কারণ হল বাবা-মায়ের অশিক্ষা, তাঁদের উপার্জনের অক্ষমতা, টিকাকরণের সময়সূচি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকা এবং টিকা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা। অতিমারির সময়ে সমাজের শিক্ষিত ও স্বচ্ছল অংশের মধ্যেও ভুল তথ্যের ফলে টিকাকরণের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের হার বেড়েছে। ইন্টেনসিভ মিশন ইন্দ্রধনুষের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, দক্ষতার অভাব ও অপ্রতুল সময়-এই দুই কারণে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা মানুষজনকে সঠিক পরামর্শ দিতে অক্ষম হয়েছেন। টিকাকরণ সংক্রান্ত ভুল তথ্য ও ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে সঠিক, সুস্পষ্ট তথ্যের আদানপ্রদানের উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে।

তিমারির সময়ে নিয়মিত টিকাকরণের কাজে সৃষ্ট ব্যাঘাতকে অতিক্রম করতে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত শিশুদের নিয়মিত টিকাকরণের উপদেশ দিয়েছে। টিকাকরণ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া এবং সংক্রমণের ঝুঁকির থেকেও যে তার গুরুত্ব বেশি, তা স্পষ্ট হয়েছিল ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময়েই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় ম্যালেরিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ইবোলার ফলে হওয়া মৃত্যুর চেয়ে ছিল অনেকাংশে বেশি। আফ্রিকায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধে ও ঝুঁকি বনাম পরিষেবা গ্রহণের সময়ে সার্স কোভিড-২ দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির তুল্যমূল্য বিচারে দেখা গেছে, টিকাকরণের সময়ে সার্স কোভিড ২-এর ফলে সংক্রমিত হয়ে যদি অতিরিক্ত একজনের মৃত্যু হয়, তা হলে পাশাপাশি নিয়মিত টিকাকরণের সুবিধে পেলে বাঁচতে পারে ৮৪টি শিশুর প্রাণ।

২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যেই ভারতের ছ’লক্ষ গ্রামে প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু নিয়মিত টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ভারতে কোভিড-১৯ অতিমারির ফলে নিয়মিত টিকাকরণের পরিষেবায় ব্যাঘাতের প্রভাব নির্ধারণ করতে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, টিকাকরণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ৫০% এবং টিকাকরণের পরিষেবা খুবই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা ও প্রদত্ত টিকাকরণের ফারাকের ফলে ঘটে চলা কোভিড ব্যতীত অন্য রোগে অসুস্থতা ও মৃত্যুহার নিয়ে উদবেগ প্রকাশ করেছেন ৭৫%-এরও বেশি বিশেষজ্ঞ। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবার ধারাবাহিকতা নির্ণয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা পালস সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় সব স্তরেই জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে (চিত্র ২)। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিয়মিত টিকাকরণের পরিষেবা যার মধ্যে লোকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে টিকা দেওয়ার কাজ ব্যাহত হয়েছে ৭০% এবং টিকাকরণ কেন্দ্রে এসে টিকা নেওয়ার কাজ ব্যাহত হয়েছে ৬১%।

চিত্র ২


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জারি করা নির্দেশিকার সূত্র ধরে বর্তমান অবস্থার ধারাবাহিক মূল্যায়নে নিয়মিত টিকাকরণের পদ্ধতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সেই সমস্ত অরক্ষিত মানুষদের জন্য যাঁরা অতিমারি চলাকালীন প্রাপ্য টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত আইএমই ৩.০ (ইনটেনসিভ মিশন ইন্দ্রধনুষ) কর্মসূচি চালু করেছে যার প্রধান লক্ষ্য হল, অতিমারির সময়ে টিকা না পাওয়া শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের টিকাকরণ। একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সুপরিকল্পিত এবং সদাপ্রস্তুত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নির্মাণ ও টিকার সমবণ্টনের নিয়মানুগ প্রথা অবলম্বন করলে প্রদেয় ও প্রদত্ত টিকার মাঝের এই সুবিশাল ফারাক অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

সকল আর্থ-সামাজিক স্তরের মানুষদের টিকা পাওয়ার অধিকার ও সুবিধা আসলে স্থিতিশীল উন্নয়নের পরিচায়ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নিয়মিত টিকাকরণের কাজ ফের চালু করতে হবে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পত্রিকা ল্যানসেটের মতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিয়মিত টিকাকরণের পদ্ধতিকে আরও মজবুত করা এবং টিকাকরণের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য শিশুরোগ নিয়ন্ত্রণ এবং টিকাকরণের পদ্ধতিকে ত্বরান্বিত করা। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শিক্ষা প্রদান এবং কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে টিকাকরণের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে তুলতে হবে। এবং পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী, তত্ত্বাবধায়ক এবং টিকা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা যাতে সুরক্ষিত অবস্থায় নিয়মিত টিকাকরণের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সেই বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন সুরক্ষিত করার জন্য টিকাকরণ কর্মসূচিতে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করার সময় এটাই।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.