মার্কিন আধিপত্য হ্রাস পাওয়া এবং চিন ও অন্য মধ্যশক্তির দেশগুলির উঠে আসার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে বিশ্বব্যবস্থা একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এবং তা বিশ্বকে অস্থির করছে। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিম ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (ডাবলুআইওআর) রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ভূচিত্র ব্যাপক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে অবস্থিত ডাবলুআইওআর দিয়ে গিয়েছে বিশ্বের কিছু ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক শিপিং লাইন (আইএসএল), যা বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক মালবাহী ও কনটেনার ট্রাফিক পরিবহণ করে। ডাবলুআইওআর প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরা। ২০১৭ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড (ডাবলুডাবলুএফ) রিপোর্ট অনুমান করে যে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য ৩৩৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ডাবলুআইওআর-এর কেন্দ্রে মরিশাস প্রজাতন্ত্রের ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্রটি অবস্থিত। এক মিলিয়নেরও বেশি লোকের বসবাসের এই দেশটিতে ১.৯ মিলিয়ন বর্গ কিমি এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড), এবং সেশেলসের সঙ্গে একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা চুক্তি (জেএমএ) অনুযায়ী অতিরিক্ত ৩৯৬,০০০ বর্গ কিমি সামুদ্রিক এলাকাসহ দ্বীপগুলির একটি বিন্যাস রয়েছে। প্রজাতন্ত্র দুটি প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত, মরিশাস এবং রদরিগেজ, এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দূরের দ্বীপ যেমন আগালেগা ও সেন্ট ব্র্যান্ডন।
ডাবলুআইওআর প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরা। ২০১৭ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড (ডাবলুডাবলুএফ) রিপোর্ট অনুমান করে যে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য ৩৩৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
নিরাপত্তার মাত্রায়, মরিশাস একটি কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করে—একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র যা এশিয়া ও আফ্রিকার দুটি প্রধান মহাদেশের মধ্যে একটি গতিশীল নিরাপত্তা পরিবেশে কাজ করে। এই গবেষণাটি মরিশাস যে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সমস্যাগুলির সম্মুখীন হচ্ছে তা পরীক্ষা করেছে। এটি এই যুক্তি উপস্থাপন করবে যে এই নিরাপত্তা সমস্যাগুলির প্রধান কারণ হল এর সীমানার মধ্যে মহাশক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এতে সহযোগিতার জন্য অ্যাজেন্ডা তৈরির সম্ভাবনার বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ডাবলুআইওআর নিরাপত্তা পরিমণ্ডলের মধ্যে মরিশাসের অবস্থানের একটি ব্যাপক মূল্যায়ন করা হয়েছে।
চিত্র: মরিশাস দ্বীপের অবস্থান
মরিশাসের স্বাধীনতা
গুরুত্বপূর্ণ আইএসএল-এর কাছাকাছি থাকার কারণে মরিশাস কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন এবং ভারত ও চিনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সাথে সাথে এই অঞ্চলে প্রধান শক্তিগুলির স্বার্থ বাড়ছে। নিরাপত্তা উদ্বেগ, ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থ, এবং সক্ষমতাবৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে চালিত করে। ইন্টারপোলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে সাম্প্রতিক সময়ে জলদস্যুতা, মানি লন্ডারিং, মাদক পাচার ও মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধও আরও তীব্র হয়েছে।
চাগোসের উপর সার্বভৌমত্বের বিরোধ এবং আগালেগার প্রশ্ন এই সমীকরণকে আরও জটিল করে তোলে। এই ঘোলা জল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খোঁজার জন্য মরিশাস দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তার উপর গুরুত্ব দিয়ে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রী-পর্যায়ের সম্মেলনের দুটি সংস্করণের আয়োজন করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, আরও দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণের জন্য মরিশাসের ক্ষমতা একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র হিসাবে শুধুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে জড়িত থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তবে এটি ডাবলুআইওআর-এর নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কিছু নির্দিষ্ট সক্রিয় পদক্ষেপের বাস্তবায়ন করেছে। মরিশাস ডাবলুআইওআর-এর শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রেক্ষিতে একটি উন্মুক্ত, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিকের মূল্য স্বীকার করে। এই অঞ্চলে মালবাহী জাহাজ চলাচল সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে এবং খরচ কমাতে মরিশাসের সদ্যপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগনাথ একটি সম্মিলিত আঞ্চলিক সামুদ্রিক শিপিং লাইনের পক্ষে কথা বলেছিলেন।
তেল ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ, সামুদ্রিক দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমন সবই মরিশাস এবং এই অঞ্চলের অন্য ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলির জন্য উদ্বেগের কারণ।
কার্যকর যোগাযোগ এবং উৎপাদনশীল সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য মরিশাস প্রায়শই বিভিন্ন আলোচনার মঞ্চে অংশগ্রহণ করে। এই আলোচনাগুলি জলের নীচে সম্পদের আবিষ্কার ও শোষণ, সামুদ্রিক টহল ও নজরদারি, স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং, রিফ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সামুদ্রিক দূষণ, নৌচলাচলের স্বাধীনতা ও জলদস্যুতা প্রশমন, কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা-নির্মাণ এবং অন্য বিষয়গুলি নিয়ে অভিন্ন আগ্রহ প্রদর্শন করে। তেল ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ, সামুদ্রিক দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমন সবই মরিশাস এবং এই অঞ্চলের অন্য ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলির জন্য উদ্বেগের কারণ।
আন্তর্জাতিক ক্ষমতার খেলা
অনেক দেশ এখানে তাদের শক্তি প্রক্ষেপণ করার কারণে এই অঞ্চলটি ক্ষমতার খেলার প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ডাবলুআইও অঞ্চলের পাওয়ার হাউস। এটি দীর্ঘকাল ধরে বেশিরভাগ ডাবলুআইও দেশগুলির নিরাপত্তা সরবরাহকারী এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে একটি নেট নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ফ্রান্স এই অঞ্চলে তার ঔপনিবেশিক অতীত এবং অবিরত চলমান সম্পর্কগুলির সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সমস্ত দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ১৯৮২ সালে ফ্রান্স এই অঞ্চলের পাঁচটি দ্বীপরাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক ব্লক ইন্ডিয়ান ওশন কমিশন (আইওসি) প্রতিষ্ঠা করেছিল।
ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও ভারত দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিম ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে একটি সামুদ্রিক প্রতিবেশী হিসাবে বিবেচনা করে আসছে। ভারতকে সম্প্রতি আইওসি-তে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ডাবলুআইও অঞ্চলে ভারত সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে ফ্রান্স ও অন্য ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, বিশেষ করে মোজাম্বিক চ্যানেলে। আগালেগা দ্বীপে একটি নতুন জেটি ও এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করে ভারত এখন আরও বড় ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।
এদিকে ভারত মহাসাগরে চিনের আগ্রহও ক্রমাগত বাড়ছে। চিনা যুদ্ধজাহাজগুলি ২০০৮ সাল থেকে ভারত মহাসাগরে টহল দিচ্ছে, এবং ২০১৭ সাল নাগাদ চিনের জিবুতিতে ৪০০ মেরিন-সহ একটি সম্পূর্ণ কার্যকর সামরিক ঘাঁটি ছিল। এটি নিরক্ষীয় গিনি, গ্যাবন, সেশেলস ও কমোরোস-সহ একাধিক ঘাঁটির পরিকল্পনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের বেসরকারি বিনিয়োগের কারণে চিন মরিশাসেও উপস্থিত রয়েছে। সম্প্রতি হুয়াওয়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের জন্য একটি ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ জলের নিচের কেবল নির্মাণ করে মরিশাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ রদরিগেজকে সংযুক্ত করেছে, যা মরিশাস অ্যান্ড রদরিগেজ সাবমেরিন কেবল সিস্টেম (মার্স) নামে পরিচিত। উপরন্তু, বেজিং মরিশাস টেলিকম কোম্পানিকে মরিশাস সেফ সিটি প্রকল্পের (এমএসসিপি) জন্য ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে।
এটি দেখতে আকর্ষণীয় হবে যে মরিশাস তার নিজস্ব উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করতে এবং এই বৈশ্বিক শক্তিগুলির মধ্যে কোনও বড় দ্বন্দ্ব প্রতিরোধে কীভাবে এই একাধিক নিহিত স্বার্থসম্পন্ন বহিরাগত খেলোয়াড়দের ব্যবহার করতে পারে।
চিনের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব রক্ষা করতে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। মূলত তার নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে অস্ট্রেলিয়াও ডাবলুআইও-তে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। যাই হোক, যেহেতু দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের মতো নিজের কাছাকাছি অঞ্চলগুলিতে তার মনোযোগ স্থানান্তরিত করছে, অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর প্রভাব ডাবলুআইওআর-এ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। তবে পরিবর্তনশীল স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়া পরে এই অঞ্চলে তার দায়বদ্ধতা পুনর্মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সামনের দিনে এটি দেখতে আকর্ষণীয় হবে যে মরিশাস তার নিজস্ব উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করতে এবং এই বৈশ্বিক শক্তিগুলির মধ্যে কোনও বড় দ্বন্দ্ব প্রতিরোধে কীভাবে এই একাধিক নিহিত স্বার্থসম্পন্ন বহিরাগত খেলোয়াড়দের ব্যবহার করতে পারে।
উপসংহার
আফ্রিকার ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলির নিরাপত্তা ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলি মূল্যায়ন করার সময়, মরিশাস এবং এর আশপাশের অঞ্চলকে প্রভাবিত করার জন্য অসামান্য লড়াইকে বিবেচনায় রাখা উচিত। দ্বীপপুঞ্জের সুবিধাজনক ভূ-কৌশলগত অবস্থান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন এর আকর্ষণীয়তায় অবদান রাখছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় উৎকর্ষ সাধন করেছে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি, যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা বিশ্ব ব্যাঙ্ক, মরিশাসে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
মরিশাস ভারত মহাসাগরের ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে ডাবলুআইওআর-এ নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইন্ডিয়ান ওশন কমিশন (আইওসি) ও ইন্ডিয়ান ওশন রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআএ)-এর সদর দপ্তর রয়েছে মরিশাসে। একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও মরিশাসের লক্ষ্য ডাবলুআইওআর-এর উপকূলীয় এবং অ-উপকূলীয় সরকারগুলির বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি একত্র করা। এটি এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক কথোপকথনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু প্রধান আন্তর্জাতিক পক্ষগুলি মরিশাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং এর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করার জন্য নতুন পদ্ধতির সন্ধান করছে, আসন্ন বছরগুলিতে মরিশাসের কূটনীতিতে কিছু আকর্ষণীয় উন্নয়ন হতে পারে।
সমীর ভট্টাচার্য অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন সহযোগী ফেলো
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.