Author : Anirban Sarma

Published on Jun 22, 2023 Updated 0 Hours ago

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন প্রধানমন্ত্রী মোদীর কর্মসূচির অগ্রাধিকারে রয়েছে ব্যক্তিবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বহুপাক্ষিকতাবাদের নবজাগরণ তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়ে ওঠার মূল্যবোধ।

লক্ষ্যে অটল: ভারতকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী রূপে ক্ষমতায় আসার পরে গত ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম বারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় সফরে নিউ ইয়র্কে পৌঁছন। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, ‘এই সফর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে গভীর ও ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব এবং আমেরিকান ও  ভারতীয়দের একত্রে সংযুক্তকারী পারিবারিক ও বন্ধুত্বের উষ্ণ বন্ধনকে দৃঢ়তর   করবে।’ প্রকৃতপক্ষেই এই সফর বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গণতন্ত্র দু’টির সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই সফর প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভারতকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা, গভীরভাবে অনুভূত ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আন্তর্জাতিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় নেতৃত্ব প্রদর্শনের লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কর্মসূচিগুলির অন্যতম ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউএন) সদর দফতরে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালনে নেতৃত্ব প্রদান যা প্রত্যক্ষভাবে তিনটি নীতিকে প্রতিফলিত করে। রাষ্ট্রপুঞ্জে তিনি বলেন, যোগ বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ হিসাবে ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর চেতনাকেই উপস্থাপন করে। এটি ‘অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত করতে’ এবং ‘আমাদের দ্বন্দ্ব, বাধা ও প্রতিরোধ দূর করতে’ সাহায্য করে। ভারত ‘সর্বদাই একত্রীকরণ, গ্রহণ এবং আলিঙ্গনের ঐতিহ্যকে লালন করেছে’ এবং যোগ আসলে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ধারণারই একটি সম্প্রসারণ।

এই একই প্রয়োজনে ২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ হিসাবে উদযাপন করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর পূর্ববর্তী এবং দিকনির্দেশকারী সফল ‘লাইফ’ উদ্যোগের সূচনা। উভয় ক্ষেত্রেই একটি সর্বোত্তম ভারতীয় অনুশীলন বা নৈতিকতার ধারনাকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থেকে সর্বজনীন স্তরে উন্নীত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এবং বর্তমানে এটি একটি বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠ অনুশীলন হিসাবে প্রশংসিত হয়েছে। মিলেটের পুষ্টিগুণ অশেষ এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলি স্থিতিশীল উত্পাদন ও ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করবে। একই ভাবে, আমরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগত স্তরে যদি পরিবেশ-বান্ধব জীবনধারার পরিবর্তন আনি, তা একটি দূষণমুক্ত, সবুজ গ্রহের নির্মাণে সাহায্য করবে।

নীতির এই বিস্তৃত কাঠামোই জি২০-তে ভারতের সভাপতিত্ব এবং গ্লোবাল সাউথের বৈধ কণ্ঠস্বর হিসাবে দেশটির উত্থানের রূপরেখা প্রদান করেছে। মৌলিক সামাজিক চুক্তির সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হওয়া এবং একটি নতুন ব্যক্তিবাদ, নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং নব বহুপাক্ষিকতাবাদকে সমর্থন জোগানোর জন্য এটি প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার ভিত্তি হিসাবেও কাজ করেছে।

ডিজিটাল ক্ষমতায়ন একটি নতুন ব্যক্তিত্ববাদের উত্থানের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এমন্ই আশা করা হচ্ছে। তাই ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার-এর (ডিপিআই) প্রচার ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের মূল অগ্রাধিকার। বর্তমানে ভারতই প্রথম এমন এক দেশ যে তিনটি মৌলিক ডিপিআই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে— একটি অনন্য পরিচয় ব্যবস্থা, একটি রিয়েল-টাইম ফাস্ট পেমেন্ট সিস্টেম এবং গোপনীয়তার সঙ্গে  আপস না করে ব্যক্তিগত তথ্য ভাগ করে নেওয়ার একটি মঞ্চ। সম্মিলিত ভাবে এই তিনটি স্তর পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি বা জনপরিষেবামূলক ব্যবস্থা ও নাগরিক ক্ষমতায়নকে রূপান্তরিত করেছে এবং একটি অভূতপূর্ব পর্যায়ে উদ্ভাবনকে তুলে ধরেছে। বর্তমানে ৯৯.৯ শতাংশেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় সরকারি পরিষেবাগুলি পেতে তাঁদের আধার কার্ড ব্যবহার করেন, ভারতীয়রা ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেসের মাধ্যমে প্রত্যেক দিন ৩০ মিলিয়ন লেনদেন করেন, এই ভাবে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি-সক্ষম আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কর্মসূচি পরিচালনা করছে৷  ভারত তার নিজস্ব ডিপিআই দক্ষতা বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে গ্লোবাল নর্থের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁর সফরের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল রোমার। এই আলাপচারিতায় পল রোমার বলেন যে, আধার এবং ডিজিলকারের মতো প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা বলে ভারত ‘সমগ্র বিশ্বকে সঠিক পথে এগোনোর দিশা দেখাতে সক্ষম।’ কোয়াড নেতৃবৃন্দ এবং ইইউ-ইন্ডিয়া ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলিও ডিপিআই-এর রূপান্তরকারী শক্তির উপর জোর দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী মানুষ এবং পৃথিবীর স্বার্থে একটি সামাজিক চুক্তি রচনায় আগ্রহী। ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতের শূন্য নিঃসরণে পৌঁছনোর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ  করলেও তিনি এ বিষয়ে সচেতন যে, একটি নতুন আন্তর্জাতিকতাবাদ কেবল মাত্র জলবায়ু সহযোগিতার নতুন ব্যবস্থার ফলেই জন্ম নিতে পারে। সেই অনুসারে, ভারত এবং ফ্রান্স ২০১৫ সালে যৌথভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী সৌর-প্রধান ক্লিন এনার্জি সলিউশন বা দূষণহীন শক্তি সমাধানের বিকাশ ও স্থাপনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স (আইএসএ) প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে আইএসএ-র সদস্য দেশের সংখ্যা ১১৪ এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী দ্বারা সূচিত এর ‘এক সূর্য, এক বিশ্ব, এক গ্রিড’ (‘ওয়ান সান, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, ওয়ান গ্রিড’ প্রোগ্রাম) কর্মসূচিকে আসলে একটি অভিন্ন সাধারণ গ্রিডের মাধ্যমে বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রিডকে সংযুক্ত করার একটি দূরদর্শী প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা সীমান্ত অতিক্রম করে রিনিউয়েবল বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির জোগান দিতে সক্ষম। জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মসূচিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু এবং দুর্যোগের ঝুঁকির জন্য পরিকাঠামোর স্থিতিস্থাপকতাকে সশক্ত করতে বহু অংশীদারসম্পন্ন কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিডিআরআই) প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিডিআরআই স্থাপনের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের  প্রশংসা করেছে এবং ইউএসএআইডি তার কাজকে সমর্থন জোগানোর জন্য তহবিল বরাদ্দ এবং জ্ঞান বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সর্বোপরি, একটি নতুন সংস্কারমুখী বহুপাক্ষিকতাবাদের দাবিতে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে ভারত। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদী জি-২০-র অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধান আধিকারিকদের বহুপাক্ষিক উন্নয়নমূলক ব্যাঙ্কগুলিকে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ করার আহ্বান জানান। এপ্রিল মাসে ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিলে (ইউএনএসসি) ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি (ইন্ডিয়ান পার্মানেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ) রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদকে ‘অ্যানাক্রনিস্টিক’ বলে অভিহিত করেন এবং ভিটো ক্ষমতা-সহ পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের ইউএনএসসি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, সংশ্লিষ্ট পাঁচটি দেশকে কোনও মতেই ‘অন্যদের চেয়ে অধিক সমতাবিশিষ্ট’ করে তোলা সম্ভব নয়। উভয় হস্তক্ষেপই এ কথা দর্শায় যে, ইউএন এবং ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলির সামগ্রিক সংস্কারের নিরিখে ভারতের অবস্থান বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গত ন’বছর ধরে এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যেখানে তীব্র ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী অতিমারি, আঞ্চলিক অনুপ্রবেশ এবং আর্থিক মন্দার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যা ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজির (গুরুত্বপূর্ণ এবং উদীয়মান প্রযুক্তি) ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে, একটি আসন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তিতে এবং কোয়াডের প্রসঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন রাষ্ট্রপুঞ্জে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সফরে গিয়েছেন, তখন তাঁর কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার পেয়েছে ব্যক্তিবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বহুপাক্ষিকতাবাদের প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান বিশ্বের এক কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মূল্যবোধ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.