আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ক্ষয়ের দরুন নেপাল এক নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। সর্বোপরি, চিনের সঙ্গে নেপালের সাধারণ সীমান্ত বস্তুত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে দুই দেশের মধ্যে মানুষ ও পণ্য চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে। এবং চিন থেকে নেপালে পর্যটক আসা ও বিনিয়োগ… দুইয়ের উপরেই এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। সে দেশের সঙ্কট নিবারণের স্বার্থে নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ১ এপ্রিল থেকে ৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত সফরে আসেন। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, শক্তি বাণিজ্য (পাওয়ার ট্রেড), অর্থনৈতিক সংযোগ এবং আন্তঃসীমান্ত পরিবহণ ব্যবস্থার মতো একাধিক বিষয়ে তাঁর আলোচনা হয়। উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলির বেশ কয়েকটির প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি নেপালের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী দেউবা ও প্রধানমন্ত্রী মোদী উভয়েই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কথোপকথন ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিতর্কিত সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সম্মত হয়েছেন। ২০২০ সালের মে মাসে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যার সূত্রপাত ঘটে যখন কে পি শর্মা অলি নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নেপাল ও ভারত উভয়েই নেপালের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত কালাপানি, লিপুলেখ এবং লিম্পুয়াদুহুরা অঞ্চলগুলিকে স্ব স্ব দেশের সীমান্তভুক্ত বলে দাবি জানায়। এ ছাড়াও এই সাক্ষাতে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মুক্ত সীমান্ত ব্যবস্থার অবাঞ্ছিত শক্তি দ্বারা অপব্যবহৃত হওয়া রোধ করার ব্যাপারে সহমত হয়েছেন।
নেপাল ও ভারত উভয়েই নেপালের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত কালাপানি, লিপুলেখ এবং লিম্পুয়াদুহুরা অঞ্চলগুলিকে স্ব স্ব দেশের সীমান্তভুক্ত বলে দাবি জানায়। এ ছাড়াও এই সাক্ষাতে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মুক্ত সীমান্ত ব্যবস্থার অবাঞ্ছিত শক্তি দ্বারা অপব্যবহৃত হওয়া রোধ করার ব্যাপারে সহমত হয়েছেন।
নেপাল ও ভারত উভয়েই নেপালে ভারতীয় প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নের অগ্রগতির পুনর্মূল্যায়ন করেছে। উভয় তরফেই পঞ্চেশ্বর মাল্টিপারপাস প্রজেক্টের বাস্তবায়নের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে সহমত জানানো হয়। সেই ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও মহাকালী চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা নেপালের পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সদস্য দ্বারা সমর্থিত হয়। কিন্তু এই চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় আড়াই দশক পরেও প্রকল্পটি অচলায়তন হয়ে পড়ে আছে এবং এটির ডিটেলড প্রজেক্ট রিপোর্ট (ডি পি আর) এখনও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। মহাকালী চুক্তির অন্তর্ভুক্ত পঞ্চেশ্বর মাল্টিপারপাস প্রজেক্টটির বাস্তবায়ন হলে ৬০০০ মেগাওয়াট পরিমাণ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হত, যা নেপালের জন্য যুগান্তকারী বলে প্রমাণিত হতে পারত।
নেপালে ভারতের সহায়তায় গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রূপায়ণের জন্য প্রধানমন্ত্রী দেউবা ভারতকে তাঁর সরকারের তরফে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এবং এই প্রসঙ্গে কাভরেপালানচকে ন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমি গড়ে তোলা, নেপালগঞ্জ ও ভাইরাহাওয়াতে ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট নির্মাণ এবং রামায়ণ সার্কিটের অধীনস্থ প্রকল্পগুলির মতো ভারতীয় সহায়তায় গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সকল বকেয়া সমস্যা সমাধানেও সদর্থক ভূমিকা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রধানমন্ত্রী দেউবা যৌথ ভাবে একটি ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩২ কে ভি ডি সি সোলু করিডোর ট্রান্সমিশন লাইন এবং নেপালে একটি সাব স্টেশনের উদ্বোধন করেন। উল্লিখিত দু’টি প্রকল্পই ভারত সরকার প্রদত্ত ২০০ কোটি টাকা অর্থ সাহায্য দ্বারা পুষ্ট। এ ছাড়াও ভারত নেপালকে আন্তর্জাতিক সৌর জোট বা ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্সের সদস্য হতে সাহায্য করেছে যা স্থিতিশীল, সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত শক্তি উৎপাদনের প্রচারের লক্ষ্যে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল দুই দেশই নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলির যৌথ রূপায়ণের জন্য আন্তঃসহযোগিতা সুদৃঢ় করতে একটি ভিশন স্টেটমেন্ট বা ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সেই অনুসারে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিমুখী শক্তি রফতানি সহজতর করে তোলার জন্য আন্তঃসীমান্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার উপরে জোর দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী দেউবা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের (ভারত) জয়নগর থেকে নেপালের কুরথা / জনকপুর পর্যন্ত আন্তঃসীমান্ত যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবার উদ্বোধন করেন যেটি আদতে ভারত সরকারের দেওয়া ৮.৭৭ বিলিয়ন এন পি আর আর্থিক অনুদানের উপরে নির্ভর করে পরিকল্পিত ৬৮.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়নগর-বিজলপুরা-বারদিবাস রেল সংযোগপথের একটি অংশ। এ ছাড়াও তাঁরা নেপালে রুপে পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম চালু করেন যা দুই দেশের অর্থনৈতিক আন্তঃসংযোগের মধ্যে মানুষে মানুষে সংযোগ সুদৃঢ়করণ ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক পর্যটকের প্রবাহে বৃদ্ধি ঘটাবে।
প্রধানমন্ত্রী দেউবা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের (ভারত) জয়নগর থেকে নেপালের কুরথা / জনকপুর পর্যন্ত আন্তঃসীমান্ত যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবার উদ্বোধন করেন যেটি আদতে ভারত সরকারের দেওয়া ৮.৭৭ বিলিয়ন এন পি আর আর্থিক অনুদানের উপরে নির্ভর করে পরিকল্পিত ৬৮.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়নগর-বিজলপুরা-বারদিবাস রেল সংযোগপথের একটি অংশ।
শক্তি ক্ষেত্রে আন্তঃসহযোগিতা সংক্রান্ত জয়েন্ট ভিশন স্টেটমেন্ট বা যৌথ কর্মসূচি বিবৃতি জারি করার পরপরই ভারত নেপাল ইলেকট্রিসিটি কর্তৃপক্ষকে বর্তমানে তাদের রফতানিকৃত ৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎসীমার বাইরেও অতিরিক্ত ৩২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দেয়। নেপাল আগামী বর্ষা থেকে ভারতকে বিদ্যুৎ রফতানি শুরু করবে। কারণ তত দিনে দেশটি ৪০০-৫০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সমর্থ হবে। নেপালের প্রতি ভারতের ইতিবাচক মনোভাবকে স্বাগত জানিয়ে নেপাল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কুলমান ঘিসিং বলেন, ‘নেপালের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের উন্নয়নের পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।’
এক উল্লেখযোগ্য নীতি পরিবর্তনের সূত্রে ভারত তার মনোভাব স্পষ্ট করেছে যে, সে চায় বিদ্যুৎ রফতানিতে নেপাল ভারত ছাড়াও বিকল্পের কথা ভাবুক এবং বি বি আই এন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপাল) চুক্তির পরিকাঠামোর অন্তর্গত উপ-আঞ্চলিক ক্ষেত্রগুলিতে এক শক্তি হয়ে উঠুক। এর আগে ভারত চেয়েছিল যে, নেপাল শুধু মাত্র তার সঙ্গেই শক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করুক। কিন্তু বর্তমানে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গেও নেপালের শক্তি রফতানি সংক্রান্ত সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে। তাই নিজের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিচলন লাইন বা ইলেকট্রিসিটি ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের অনুমতি দিয়ে ভারত যে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ রফতানির সুযোগ করে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের এই উদার মনোভাবকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সম্ভবত নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে।
ভারত নেপালের কাছে এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সে এমন কোনও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করবে না, যেগুলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে চিনা সংস্থানের সম্পর্ক রয়েছে। নেপালের সঙ্গে শক্তি চুক্তিতে ভারতীয় নীতির এই পরিবর্তনের প্রভাব প্রধানমন্ত্রী দেউবার দিল্লি থেকে কাঠমাণ্ডু ফিরে যাওয়ার পরপরই স্পষ্ট হয়ে যায়। নেপাল সরকার চিনা সংস্থাকে দেওয়া বহু বিতর্কিত ১২০০ মেগাওয়াটের বুড়ি গন্ডকি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দায়িত্ব সময় মতো কাজ শুরু করতে না পারার কারণে খারিজ করে দেয়। নেপাল সরকারের তরফে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্পটির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আরও বেশি পরিমাণে ভারতের কাছে বিক্রির পথকে সুগম করে তুলবে বলে আশা করা যায়।
নেপাল সরকার চিনা সংস্থাকে দেওয়া বহু বিতর্কিত ১২০০ মেগাওয়াটের বুড়িগন্ডকি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দায়িত্ব সময় মতো কাজ শুরু করতে না পারার কারণে খারিজ করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী দেউবার ভারত সফর এখনও পর্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে, যে হেতু এই সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা আলাপচারিতার মাধ্যমে সমাধান করা এবং মূলত ভারতীয় বিনিয়োগের সাহায্যে নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পথ সুগম করা সম্ভব হয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত সংযোগের উপরে জোর দেওয়া এবং রুপে পেমেন্ট কার্ড সিস্টেমের মাধ্যমে আর্থিক সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে নেপাল ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের সুবিধা লাভে সমর্থ হয়েছে। কৌশলগত দিক থেকে এই সফর ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের প্রধান লক্ষ্য হল নেপালে চিনা বিনিয়োগের প্রতিরোধ করা এবং বি বি আই এন সদস্য দেশগুলির মধ্যে শক্তি রফতানির মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক আন্তঃসহযোগিতা গড়ে তোলার প্রচার চালানো। এক দিকে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিয়ে নেপাল ও চিনের মধ্যে চাপানউতোর এবং অন্য দিকে নেপালের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে ভারতের ইতিবাচক মনোভাব ভারত ও নেপালের মধ্যে এক উচ্চ স্তরের বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে দুই দেশেরই জনসাধারণের হিতার্থে বৃহত্তর অর্থনৈতিক আন্তঃসহযোগিতাকে সুনিশ্চিত করবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.