মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটনাপ্রবাহ এক অপ্রত্যাশিত মোড় নেয় যখন কমলা হ্যারিসকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ের সামনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় দ্রুত নির্বাচনের গতিশীলতা পরিবর্তিত হয়েছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস অনেকাংশে আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ভাবমূর্তি, বিশেষ করে মধ্য আমেরিকার দেশগুলি থেকে অভিবাসন মোকাবিলায় তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিল। এখন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনীত সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে কমলা হ্যারিসের আবেদন এবং সম্ভাবনা উভয়ই উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। একজন মহিলা প্রার্থী হিসাবে তিনি ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী হিলারি ক্লিনটনের তুলনায় ব্যাপক ভাবে ভিন্ন রাজনৈতিক আবেগের সুবিধা পেয়েছেন। ক্লিনটন এবং হ্যারিস উভয়েই উল্লেখযোগ্য ভাবে বৈচিত্র্যময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দুই প্রান্তের প্রতিনিধিত্ব করেন। এক দিকে ক্লিনটন শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধিত্ব করায় এলিটিজমের অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর অন্য দিকে হ্যারিস নারী, যুবক এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে থেকে সমর্থন কুড়োতে সক্ষম হয়েছেন। হ্যারিসের রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক তাৎপর্যের অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে তাঁর প্রবেশ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বয়স নিয়ে সমালোচনা, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী মনোনীত করার বিষয়ে আর এক দফা প্রাইমারি আয়োজন এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে একটি লজ্জাজনক পরাজয়ের হাত থেকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে রক্ষা করেছে।
প্রাথমিক ঘোষণার পর পরিস্থিতি খানিক থিতু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিপাবলিকানরা হ্যারিসের উপর আক্রমণ তীব্র করতে পারেন এবং ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর নীতির প্রাসঙ্গিকতাকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। হ্যারিস ব্যক্তিগত ভাবে যে যে বিষয়গুলি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলেন, অর্থাৎ বন্দুক নিয়ন্ত্রণ এবং অভিবাসন… সেই সব বিষয়ের ভিত্তি করেই রিপাবলিকানরা আক্রমণ তীব্র করতে পারেন। তিনি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে নিজের সঙ্গী বাছাই করতেও প্রস্তুত। তবে সেই সঙ্গী কে হতে চলেছেন, তার উপর নির্ভর করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জুটি সকলের নজরে থাকবেন এবং নিরীক্ষণের আওতায় পড়বেন।
উইসকনসিনে বাইডেনের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের পরে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় তিনি তাঁর কিছু নীতিগত অগ্রাধিকার তুলে ধরেন। তার মধ্যে আছে প্রজনন অধিকার, সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা, অর্থ প্রদান করে প্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, আইন ও বিচার এবং শিশুদের যত্ন সুনিশ্চিত করা।
অতীতে হ্যারিস বাইডেনের থেকে নিজের সূক্ষ্ম পার্থক্য তুলে ধরেছেন, বিশেষত যখন তিনি ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যেই হ্যারিসকে ‘ডি.ই.আই.হায়ার’ এবং বৈচিত্র্য, ইক্যুইটি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিগুলিকে তাঁর উত্থানের কারণ বলে মনে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে রিপাবলিকানদের সঙ্গে হ্যারিসের মতবিরোধ থাকবেই, যা থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় প্রতিক্রিয়াই জন্ম নিতে পারে। হ্যারিস প্রত্যাশিত ভাবে নতুন তেল ও গ্যাস ড্রিলিং এবং জ্বালানি ও জলবায়ু নীতির উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার বিষয়ে বাইডেনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও লিঙ্গ, জাতি এবং পরিবেশের বিষয়ে একক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ন্যায়বিচারের বিষয়ে অটল থাকতে পারেন। এই নীতিগত পার্থক্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বৈদ্যুতিক গাড়ির অগ্রাধিকার, যাকে ট্রাম্প অটোমোবাইল শিল্পের জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছেন।
কমলা হ্যারিসের বৈদেশিক নীতির উপর অনেকের নজর থাকবে। বিশেষ করে বাইডেনের উলটো পথে হেঁটে হ্যারিস নীতিগত ভাবে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হ্যারিসের বৈদেশিক নীতির ভিত্তিটি সম্ভবত বাইডেনের সঙ্গে সরাসরি ধারাবাহিকতা থেকে নয়, বরং তাঁর নীতিগুলি থেকে সংক্ষিপ্ত বিচ্যুতি হিসেবে উদ্ভূত হতে পারে। হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে ইউক্রেনের জন্য সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের বিপরীতে - যা ইউক্রেনের পক্ষে গণতন্ত্র রক্ষা করতে এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছিল - হ্যারিস আরও অবাধ অবস্থান পছন্দ করতে পারেন।
অন্যান্য বৈশ্বিক সংঘাতে – যেমন গাজায় - হ্যারিস ইতিমধ্যে নীতির নিরিখে বাইডেনের থেকে আলাদা পথে হাঁটছেন। তিনি ইজরায়েলের প্রতি অব্যাহত সমর্থনের পাশাপাশি তাঁর বক্তব্যের ভারসাম্য বজায় রেখে গাজায় ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, সেনেটের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস কমিটির সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর মেয়াদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিষয়ে হ্যারিসের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। হ্যারিসের প্রধান অগ্রাধিকার হতে পারে বাইডেনের অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর কাটানো সময়ের ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসা। বাইডেনের বিপরীতে হ্যারিস দ্বিতীয় মেয়াদেও ক্ষমতায় থাকার প্রত্যাশী। তাই উত্তরাধিকারও হ্যারিসের প্রশাসনের এক অন্যতম মূল উপাদান হয়ে উঠতে পারে।
কমলা হ্যারিসের ভারত নীতি মূলত বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রাখবে। তবে তা আরও সূক্ষ্ম হবে এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আরও উদারপন্থী শাখাকেই প্রতিফলিত করবে। এটি কী ভাবে ভারতের জন্য নির্দিষ্ট নীতিগুলিকে প্রভাবিত করবে, তা এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে সাধারণত মার্কিন রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান ভারতীয় প্রভাবের ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে।
বিদেশনীতির বিষয়ে হ্যারিসের একটি স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছিল মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে (এমএসসি) অংশগ্রহণের সময়, যেখানে তিনি একাধিক বার অংশগ্রহণ করেছেন। ২০২২ সালে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি জোরালো সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমএসসি-তে একটি দ্বিদলীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এমএসসি-তে হ্যারিস শক্তিশালী ট্রান্স-আটলান্টিক সংহতির জন্য সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং ‘বিপজ্জনক, অস্থিতিশীল ও প্রকৃতপক্ষে অদূরদর্শী’ হিসাবে জোটকে অবমূল্যায়ন করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে সম্ভাব্য ট্রাম্প প্রশাসনের ভয়কেও প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জোটের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি - যা তাঁর বিদেশনীতির অনেকাংশকে রূপ দিতে পারে – স্পষ্ট হয়েছে হ্যারিসের বক্তব্যেই, যখন তিনি বলেন: ‘আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি যে, জোট গঠন এবং জোট টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি আমেরিকাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। জোটগুলি যুদ্ধ প্রতিরোধ করেছে, স্বাধীনতা রক্ষা করেছে এবং ইউরোপ থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক পর্যন্ত স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। এই সমস্ত জোটকে ঝুঁকির মুখে ফেলা বোকামিরই নামান্তর।’ তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং আমি গত তিন বছরে স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, আমরা বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ততা অনুসরণ করতে, আন্তর্জাতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে, দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে এবং অভিন্ন সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের অংশীদার ও মিত্রদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
হ্যারিস ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কারণ এশিয়ায় অন্তত সাতটি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঁচটি সফরে তাঁকে দেখা গিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে তিনি একটি শক্তিশালী মার্কিন উপস্থিতির মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার জন্য সওয়াল করেছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ‘শৃঙ্খলা ও নিয়মাবলির পক্ষে কথা বলেন, যা মার্কিন জনগণের জন্য এবং প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলের জনগণের জন্য অভূতপূর্ব শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রদান করেছে।’ যাই হোক, রিপাবলিকানরা বাইডেনের সিদ্ধান্ত নিয়ে হ্যারিসকে আক্রমণ করার দিকে মনোনিবেশ করবেন, যা কিনা আদতে বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস করেছে। এ ছাড়াও হ্যারিস এখনও চিন সম্পর্কে কোনও কৌশল উপস্থাপন করেননি।
হ্যারিসের বৈদেশিক নীতি কেমন হবে, বিশেষ করে ভারত সম্পর্কে তাঁর নীতি নিয়ে অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তাঁর জামাইকান সংযোগের উপর জোর দেওয়ার সময় হ্যারিসকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়টিকে অবমূল্যায়ন করতে দেখা গিয়েছে। এই কৌশলটি - যা কিনা ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রদর্শিত হতে পারে - তাঁর প্রচারাভিযানের সমীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অঞ্চলগুলিকে তিনি লক্ষ্য করছেন, সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোট তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এই পদ্ধতিটি তাঁর পরিচয় এবং সম্ভাব্য নীতি সম্পর্কে ভারত সংক্রান্ত প্রাথমিক উচ্ছ্বাসকে খর্ব করেছে। তাই সর্বোপরি ভারতও এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক। কাশ্মীর প্রশ্নে রিপ্রেজেন্টেটিভ সদস্য প্রমীলা জয়পালের অবস্থানের সমর্থনে হ্যারিসের সওয়াল বা ভারতের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য তেমন ভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি।
কমলা হ্যারিসের ভারত নীতি মূলত বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রাখবে। তবে তা আরও সূক্ষ্ম হবে এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আরও উদারপন্থী শাখাকেই প্রতিফলিত করবে। এটি কী ভাবে ভারতের জন্য নির্দিষ্ট নীতিগুলিকে প্রভাবিত করবে, তা এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে সাধারণত মার্কিন রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান ভারতীয় প্রভাবের ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৩ সালে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় কমলা হ্যারিসের উল্লেখ-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রবাসীদের বিশেষ ভূমিকা স্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃঢ় ভিত্তি আশা জোগায় যে সেটি সব রকম রাজনৈতিক অস্থিরতা অতিক্রম করতে সক্ষম।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ওপেন ম্যাগাজিন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.