গণমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে আলোচনার শীর্ষে থাকার পর সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইসলামাবাদে ঝটিকা-সফর করেন। শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কের সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে, যখন এসসিও-এর কাউন্সিল অফ হেডস অফ গভর্নমেন্ট-এর (সিএইচজি) ২৩তম বৈঠকটি সম্ভবত জয়শঙ্করের স্রেফ রোদচশমার জন্য মনে রাখা হবে। ইদানীং কালের সোশ্যাল মিডিয়ার চরম নিরীক্ষণের যুগে ভাইরাল হওয়া একটি ছোট ভিডিয়ো ক্লিপে দেখা গিয়েছে, জয়শঙ্কর অত্যন্ত কেতাদুরস্ত ভাবে রোদচশমা পরে রয়েছেন, যা কিনা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর ক্ষেত্রে ভারতের আত্মবিশ্বাসের প্রতীকসম। হাস্যকর মনে হলেও ভারতীয় বিদেশনীতির কল্পনায় পাকিস্তানের জন্য যে ন্যূনতমটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা আজ ভারতের কূটনীতিকদের কেতা এবং শারীরিক ভাষায় ফুটে উঠেছে।
তবে অবশ্যই জয়শঙ্করকে এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ইসলামাবাদে পাঠানোর ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি তার এসসিও অংশীদারদের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা বজায় রাখার বিষয়টি নিয়েও বার্তা দিতে চেয়েছে। গত বছর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি এসসিও বৈঠকে অংশ নিতে গোয়া সফর করেছিলেন। সেটি ছিল ২০১১ সাল থেকে কোনও পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর। এবং জয়শঙ্কর গত এক দশকের মধ্যে প্রথম ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানে যান। এই সফরগুলি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কোনও গুরুত্বই বহন করে না।
সন্ত্রাসবাদ সম্পর্ককে পর্যুদস্ত করে চলেছে
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং রাশিয়া, চিন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও ইরান-সহ এসসিও হল একটি ইউরেশীয় জোট, যা চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের মতো আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তবে পরবর্তী কালে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুবিধার্থে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য এটি প্রসারিত হয়।
ভারত তার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করার দিকে মনোনিবেশ করেছে এবং ইউরেশিয়া জুড়ে সংযোগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রচার চালিয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসসিও সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যেমনটা তার সনদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। ভারত তার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করার দিকে মনোনিবেশ করেছে এবং ইউরেশিয়া জুড়ে সংযোগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রচার চালিয়েছে। যাই হোক, এসসিও-র লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও কিছু সদস্য রাষ্ট্র বিদেশনীতির একটি হাতিয়ার হিসাবে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করেছে এবং ইউরেশিয়া ও ভারতের জন্য উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে।
সদস্য দেশগুলির মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের পরিবর্তন রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এসসিও-র কার্যকারিতাকে বাধা দিয়েছে। নয়াদিল্লি সন্ত্রাসবাদ দমনে বৃহত্তর সহযোগিতার জন্য ক্রমাগত ওকালতি করেছে এবং রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে উদ্বেগ উত্থাপন করেছে, বিশেষ করে পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীগুলির বিষয়ে সরব হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য মেলেনি। সর্বোপরি একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল আফগানিস্তান গড়ে তোলার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এই ইউরেশীয় সংস্থার সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জগুলিকেই দর্শায়। কারণ সদস্য রাষ্ট্রগুলি প্রায়শই এই অঞ্চলে শান্তির জন্য সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে।
‘থ্রি ইভলস’ বা ‘তিন অপশক্তি’
ইসলামাবাদের বৈঠকে জয়শঙ্কর এসসিও-কে তার মূল আদেশ ও মৌলিক বিষয়গুলি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সমাবেশে জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘গোষ্ঠীটির স্বতঃসিদ্ধ উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। এবং সনদে ঠিক যেমনটা বলা হয়েছে, এর অর্থ হল ‘তিন অপশক্তি’ মোকাবিলায় দৃঢ় এবং আপসহীন হওয়া। সীমান্তের ও পারের কার্যকলাপ যদি সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দ্বারা চিহ্নিত হয়, তা হলে তা সমান্তরাল ভাবে বাণিজ্য, জ্বালানি প্রবাহ, সংযোগ এবং জনগণের মধ্যে বিনিময়কে উত্সাহিত করতে পারবে না।’
অবশ্য পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখলেও চিনও বাদ যায়নি। কারণ জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘...সহযোগিতা অবশ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সার্বভৌম সমতার উপর ভিত্তি করে হতে হবে, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং প্রকৃত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একতরফা কোনও কর্মসূচি নিয়ে এসসিও এগোতে পারবে না। যদি আমরা বিশ্বব্যাপী অনুশীলন, বিশেষ করে বাণিজ্য এবং সংযোগের বিষয় মাথায় রাখি, তা হলে এ কথা বলতেই হবে।’ তাঁর বর্ণিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারত চিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে। ভারত এই প্রসঙ্গে এসসিও-তে একেবারে ভিন্ন অবস্থান নেয় এবং অন্যান্য সদস্য চিনের সংযোগ উদ্যোগের জন্য নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।
এসসিও বৈঠকটি ছিল মধ্য এশিয়া সংক্রান্ত, পাকিস্তান সম্পর্কিত নয়
পাকিস্তান এবং চিনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মধ্য এশিয়া ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি অগ্রাধিকার হিসাবে উঠে এসেছে। জয়শঙ্করের ইসলামাবাদ সফর তারই প্রমাণ। ২০১৭ সালে পূর্ণ সদস্য হওয়ার পর থেকে ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি মোকাবিলা করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শক্তিশালী সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও বৃহত্তর সহযোগিতার পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ইউরেশিয়া জুড়ে সংযোগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপরও মনোযোগ দিয়েছে, যা তার বিস্তৃত বিদেশনীতির উদ্দেশ্যগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট এবং চাবাহার বন্দর প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি এই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধি করতে নয়াদিল্লির প্রতিশ্রুতিকেই দর্শায়।
তবে দ্রুতই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পরিবর্তন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। মাত্র কয়েক মাস আগে জয়শঙ্কর ঘোষণা করেছিলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘নিরবচ্ছিন্ন আলাপ-আলোচনার যুগ’ শেষ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক কাজের পরিণতি আছে এবং জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে আর্টিকল ৩৭০-এর মাধ্যমে এমনটা করা হয়েছে। এখন বিষয় হল, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে কেমন ধরনের সম্পর্ক আশা করছি। আমরা নিষ্ক্রিয় নই; ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয় প্রেক্ষিতেই আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।’ সরকারের প্রেক্ষিতে তার পদ্ধতির পরিবর্তনের বিষয়ে কোনও প্রণোদনা বা আলোচনা জরুরি নয়। ইসলামাবাদ পরিদর্শন করে জয়শঙ্কর এসসিও সদস্যদের কাছেও এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে, নয়াদিল্লি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক গোষ্ঠীটির প্রতি যথেষ্ট দায়বদ্ধ। বরং পাকিস্তানই ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.