বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ ও ভূ–রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যখন কিছুটা অভূতপূর্ব অশান্তি দেখা দিয়েছে — ইউরোপে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন, উন্নত ও উদীয়মান বাজার অর্থনীতি জুড়ে শক্তি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্কট থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যকার উত্তেজনা এবং দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত বিযুক্তিকরণের গভীরতা পর্যন্ত — সেই সময় ভারত বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের জন্য পরবর্তী ‘আকর্ষণীয় স্থান’[১] হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বব্যাঙ্ক সম্প্রতি এই কথাই তুলে ধরেছে যে ভারত অন্যান্য উদীয়মান বাজারের তুলনায় ‘বৈশ্বিক প্রভাবের মোকাবিলায়’ ভাল অবস্থানে আছে।[২]
যেহেতু ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসাবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে, তাই স্থানীয় বেঞ্চমার্কগুলি ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমরা চিত্র ১–এ দেখতে পাচ্ছি উদীয়মান বাজারের ভিত্তিতে ভারতীয় শেয়ারবাজারগুলি অন্য এমএসসিআই’দের ছাড়িয়ে গিয়েছে, এবং ২০২২ সালে কর্মসক্ষমতার দিক থেকে বিশ্বের সেরা ইক্যুইটি বাজারগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে।[৩]
চিত্র ১: এমএসসিআই ভারত বনাম এমএসসিআই উদীয়মান বাজার: ক্রমবর্ধমান সূচক কর্মসক্ষমতা – নেট রিটার্ন (ইইউআর–এ; নভেম্বর ২০০৭–নভেম্বর ২০২২)
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় ইক্যুইটিগুলিতে অবিচলিত অর্থপ্রবাহ বজায় রেখে এই ধরনের বাজার–সমাবেশকে চালিত করতে ভূমিকা পালন করেছে।[৫] আংশিকভাবে, বিনিয়োগকারীরা পরবর্তী বিরাট বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিস্ময়স্থল হিসাবে ভারতের অবস্থানের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, যেহেতু অর্থনীতিটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিস্থাপক ও শক্তিশালী গার্হস্থ্য ভোক্তা-ভিত্তিসহ কোভিড–১৯ অতিমারি থেকে অচঞ্চলভাবে বেরিয়ে আসছে।[ক],[৬]
জোরালো সামষ্টিক অর্থনীতির গল্পের বাইরে, বৈশ্বিক পুঁজির জন্য এবং প্রকৃতপক্ষে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) আকারে ‘স্টিকি ক্যাপিটাল’ বা ‘অপরিবর্তনশীল’ পুঁজির জন্য ভারতের ভূ–কৌশলগত অবস্থানও একটি লোভনীয় আকর্ষণ। যেমনটি আমরা চিত্র ২–এ দেখতে পাচ্ছি, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতে এফডিআই ক্রমাগত বেড়েছে, আংশিকভাবে ২০১৮ সালে মার্কিন–চিন বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসাবে, এবং সম্ভবত ক্রমবর্ধমানভাবে ‘চায়না অফসেট’–এর একটি ফ্যাক্টর হিসাবে। সে দেশের ধারাবাহিক শূন্য কোভিড নীতির মধ্যে কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী ও নির্বাহী ইতিমধ্যেই মূল চিনা ভূখণ্ড থেকে ভারতে এবং অন্যান্য উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি ও এশীয় অর্থনীতির মধ্যে মূলধনী বরাদ্দ সরিয়ে নিয়েছে।
চিত্র ২: মূল্যের দিক থেকে ভারতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (২০০৫–২০২০)
কিন্তু তবুও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল: ভারত কি একটি আলোছায়া মুহূর্তের কারণে উপকৃত হচ্ছে, এবং শুধু সাময়িকভাবে একটি ‘আকর্ষণীয় স্থান’ হিসাবে এই কারণে চিহ্নিত হয়েছে যে বর্তমান বিশ্ব দিগন্ত অন্যথায় অন্ধকার? সংক্ষেপে, ভারতে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি প্রবাহের এই ভৌগোলিক বিনিয়োগের বিষয়টি কতটা টেকসই?
যেমনটি আমরা দেখতে পাই, ভারতের অনেক নিজস্ব চ্যালেঞ্জও আছে: সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্তরে এবং প্রকৃতপক্ষে ভূ–রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মধ্যেও। তা সত্ত্বেও, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উভয় ধরনের প্রতিকূল হাওয়ার মধ্যেও ভারত তারকাখচিত উজ্জ্বল বিনিয়োগের জন্য অবশ্যই উপযুক্ত। তবে দেশটি ‘পরবর্তী চিন’ নয়। কিন্তু ভারত যেহেতু ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে অতি দ্রুত অগ্রগতির জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিষেবা রপ্তানি বাড়িয়েছে, তাই দেশটি একটি উপভোক্তা বাজারের জন্য বৃদ্ধি নিয়ে এসেছে এবং এখন তা ফুলেফেঁপে ওঠার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।[খ],[৮] আর শক্তি, পরিবহণ, ও কৃষি প্রযুক্তি (অ্যাগটেক)–সহ যে সব ক্ষেত্রের সংস্কার হয়েছে সেগুলিই প্রাইভেট ইক্যুইটি, পরিকাঠামো, ও ভেনচার ক্যাপিটালের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও ধৈর্যশীল পুঁজি বিনিয়োগের খুব ভাল সুযোগ প্রদান করে। উপরন্তু, ঐতিহ্যগত ও অপ্রচলিত উভয় প্রকারের অর্থ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বরাদ্দের জন্য লোভনীয় সুযোগ প্রদান করে চলেছে। পরিশেষে, আমরা দেখতে পাব, ভারতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কোন দেশগুলি ‘ঠিকঠাক কাজ করেছে’ তা বিবেচনা করা হলে অন্য দেশগুলির জন্য জাপান একটি চমৎকার রোল মডেল প্রদান করে, কারণ তারা ভারতে কৌশলগতভাবে জড়িত হতে চায়।
সামষ্টিকছবি
কোভিড–১৯ থেকে উদ্ভূত যুগপৎ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও ভারত আসলে অতিমারি থেকে বেরিয়ে এসেই রেকর্ড জিডিপি বৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে।[৯] ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতিনির্ধারকেরাও ভাইরাসের পরের পর ঢেউ ও সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক স্তব্ধতা চলাকালীন আর্থিক বাজারগুলি মসৃণভাবে সচল রাখতে সফল হয়েছিলেন, কারণ মিউচুয়াল ফান্ডে লিকুইডিটি বজায় রাখার পাশাপাশি বাজারে মার্কিন ডলারের পর্যাপ্ত লিকুইডিটি বজায় রাখতেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।[১০]
অতি সম্প্রতি, বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায়, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কারদের ‘মুদ্রা নীতিতে ভূ–রাজনৈতিক উপচে–পড়া’ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে।[১১] ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে নীতিনির্ধারকদের আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। এভাবে লড়াই চলেছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিবেশের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী ডলারের কর্মসক্ষমতা প্রদর্শনের বিপরীতে ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়নের সঙ্গে, যার কারণ ছিল মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)–এর কড়াকড়ি (যা আবার উচ্চতর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সময়কালে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে মার্কিন ডলারের জন্য ভিড় বাড়িয়েছে)। এই বর্তমান ভারসাম্যহীনতা ২০২৩ সালে কিছুটা লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ মনে হচ্ছে অন্যান্য উন্নত অর্থনীতিতে ফেড বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কাররা মূল্য স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে সফল হতে পারে, এবং সেই সূত্রে মোটের উপর ‘সফট ল্যান্ডিং’–এর দৌলতে সম্ভাব্যভাবে গভীর বা দীর্ঘায়িত মন্দা এড়াতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদের দিকে তাকালে ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে জার্মানি ও জাপান উভয়কে ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।[১২] আগামী নয় বছরের মধ্যে ভারতীয় জিডিপি দ্বিগুণ হবে।[১৩] তা ছাড়া এমনকি কোভিড–১৯ উদ্ভূত আকস্মিক স্তব্ধতার পরেও ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৮.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার ফলে সেই সময়ে এই শ্রেণিভুক্ত মানুষের সংখ্যা ৮০০ মিলিয়নে পৌঁছবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।[১৪] পরবর্তী শতাব্দীর শুরুর দিকে তাকিয়ে ভারত কার্যকরভাবে জার্মানি ও জাপানের অবস্থান প্রতিস্থাপন করে বিশ্বের বৃহত্তম নেট বিদেশি সম্পদের অবস্থান[গ] ধরে রাখতে প্রস্তুত রয়েছে।
এই ধরনের যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক পরীক্ষা বাকি থাকে। এমনই একটি চ্যালেঞ্জ ভারতের ‘গণতান্ত্রিক গোলযোগ’ থেকে উদ্ভূত[১৫]: যেহেতু দেশের নাগরিকেরা ২৮টি রাজ্য ও আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ছড়ানো এবং ১২১টি ভাষা ও ২৭০টি মাতৃভাষা বলেন, কাজেই এই ‘লক্ষ লক্ষ গণতান্ত্রিক দর–কষাকষির’ মধ্যে রাজনৈতিক সংহতির অনুভূতিতে কিছুটা ঘাটতি থাকতেই পারে৷[১৬] শিল্প–বাণিজ্যপন্থী সংস্কারের পরবর্তী প্রজন্মের কাজ করার জন্য,[ঘ] এবং ‘বেসরকারি ব্যক্তিদের সমর্থনের জন্য সরকারি সুবিধা’[১৭] প্রদানের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা মাথায় রাখতে হবে। ভূমি, শ্রম ও মেধা সম্পত্তির পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কারের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন, যা এই মুহূর্তে সম্পূর্ণরূপে দৃশ্যমান নাও হতে পারে। আর মাঝারি মেয়াদে একটি বড় প্রশ্ন হল, দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগের বিকাশের একটি দৃঢ় ভিত্তি প্রশস্ত করার জন্য এই ধরনের ঐকমত্য তৈরির কী কী উপায় আছে।
আঞ্চলিক স্তরের দিকে তাকালে, এবং সমকক্ষ অন্যান্য উদীয়মান বাজারের প্রেক্ষাপটে বা অন্যান্য এশীয় অর্থনীতির সঙ্গে ভারতকে তুলনা করলে, দেশটির তুলনামূলকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অবস্থান স্পষ্ট হয়, যেমন এটি চিনের প্রভাব থেকে স্বাধীন। এই বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ও নির্বাহীদের কাছে ভারতকে লোভনীয় করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন ভূ–রাজনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকারে একক শক্তির, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মতো দুটি শক্তির আধিপত্যের পরিবর্তে, বর্তমান ভূ–রাজনৈতিক মানচিত্র একটি খণ্ডিতকরণ দ্বারা চিহ্নিত। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান আংশিকভাবে তার ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার নির্জোট কৌশলের অনুস্মারক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিমুখী সংঘর্ষের সময় সম্পর্কগত বা আদর্শগতভাবে একটি শিবিরের অনুসারী হওয়ার পরিবর্তে ভারত তার বৈদেশিক নীতিতে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করেছিল।[১৮]
আজও অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তথাকথিত ‘কোয়াড’ আঞ্চলিক সম্পর্কের একটি স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও[১৯] ‘অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো–প্যাসিফিক’-এ ভারতের নিজস্বতা দেশটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেবক হিসাবে পরিচিতির থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সক্রিয় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, রুশ আমদানি কমানোর জন্য বাইডেন প্রশাসনের দাবি সত্ত্বেও [২০] ভারত কিন্তু রেকর্ড পরিমাণে রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল আমদানি করে চলেছে।[২১]
উপরন্তু, ভারত যেহেতু উপরে উল্লিখিত অর্থনৈতিক পূর্বাভাসগুলিতে নিহিত সম্পদ সৃষ্টি এবং সমৃদ্ধির অসাধারণ গতিশীলতা অর্জন করতে প্রস্তুত, তাই দেশটি মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভূ–রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হতে পারে, কারণ ভারতে এইভাবে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা মার্কিন মধ্যবিত্তের ক্রমাগত পতনের বিপরীতে উপস্থাপিত হতে পারে। সহজভাবে বলতে গেলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রায়শই ভুলভাবে একটি শূন্য–সমষ্টির খেলা (জিরো–সাম গেম) হিসাবে দেখেন, যা অনুসারে একটি দেশের লাভকে (পড়ুন: ১৯৮০–র দশকে জাপান এবং ২০০৯–এর দশকে চিন) প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গার্হস্থ্য জনসংখ্যার অংশগুলির জীবিকা হ্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসাবে দেখা হয়।
সুতরাং, যতক্ষণ অব্যাহত বাণিজ্য ও আন্তঃসীমান্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ভারতীয় বৃদ্ধিকে সমর্থন করবে, ততক্ষণ ভারতীয় নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক ও নির্বাহীদের উচিত তাদের মার্কিন (এবং সম্ভবত এমনকি ইউরোপীয়) সমকক্ষদের সঙ্গে ‘আন্তঃনির্ভরতার সুবিধা’ নিয়ে আলোচনায় নিযুক্ত হওয়া।[২২] অন্যথায়, ভারতের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি দেশটিকে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন নীতি–বৃত্তে ক্ষোভের কারণ হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে।
জাপান: অনুকরণীয়বিদেশিবিনিয়োগকারী
যদিও ভারতের অনুকূল ভূ–কৌশলগত অবস্থান বেশিরভাগ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের আলোকে আলোচনা করা হয়, অন্য একটি দেশ কিন্তু ভারতে দীর্ঘমেয়াদি মূল্যসৃষ্টির নতুন দিগন্ত অনুসরণ করার জন্য অন্যদের সামনে একটি আদর্শ উদাহরণ উপস্থাপন করে। সেই দেশটি হল জাপান। প্রকৃতপক্ষে, জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর [২৩] মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্কের একটি দিক ছিল ভারতে দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে পুঁজি করতে জাপানি সংস্থা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা। জাপান ভারতে একটি সক্রিয় পরিকাঠামো বিনিয়োগকারী হয়েছে;[২৪] যখন তার কিছু প্রধান ব্যাঙ্ক ভারতীয় আর্থিক ক্ষেত্রের মধ্যে তাদের অবস্থানকে আরও গভীর করে চলেছে।[২৫] সে দেশের একটি নেতৃস্থানীয় শিল্প সংস্থা বর্তমানে বৃহত্তর সরবরাহ শৃঙ্খল নমনীয়তা তৈরি[২৬] এবং সেইসঙ্গে সম্ভবত ক্রমবর্ধমান গ্রাহক ভিত্তির কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য ভারতে তার বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করছে।
জাপানের সরকারি সংস্থাগুলি এই ধরনের সক্রিয় বিনিয়োগ[২৭], যা সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ও কম–কার্বন পরিকাঠামোর[২৮] মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে করা হচ্ছে, এবং দেশটির নেতৃস্থানীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির বিনিয়োগ দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সুবিধার একটি সত্যিকারের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সুবিধার মধ্যে নিহিত। এই বিনিয়োগের অনেকগুলি ইন্দো–প্যাসিফিক কাঠামোর ভাষায় সাজানো হলেও ভারতে জাপানি কর্পোরেট বিনিয়োগের একটি অংশকে বৃদ্ধির একটি আবেগহীন অনুসরণ হিসাবেও (চিন থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য রাগান্বিত প্রয়াসের বিপরীতে) দেখা যেতে পারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ও মোদীর মধ্যে নতুন করে শাটল ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে এই ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্কগুলির পুনর্নবীকরণ হবে বলে আশা করা যায়, এবং তা ঘটবে ‘বন্দুকের চেয়ে জরুরি মাখন’ মানসিকতা অনুসরণ করে।
সুযোগেরক্ষেত্র: সংস্কারমুখীবিনিয়োগ
ভারতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য উপরে উল্লিখিত উজ্জ্বল ক্ষেত্রগুলির কথা বিবেচনা করে কিছু শিল্প বর্তমানে সুযোগ সদ্ব্যবহারে বৃহৎ সংস্কারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেহেতু ভারতে শস্য উৎপাদনের প্রয়াস বৃদ্ধি পাচ্ছে,[২৯] তাই খাদ্য ব্যবস্থায়, বিশেষ করে খাদ্য সঞ্চয়স্থান ও অ্যাগটেকে, বিনিয়োগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।[৩০]
ভারত জি২০ সভাপতিত্ব গ্রহণ করায় তার কার্বন হ্রাসের[৩১] প্রতি স্বীকৃত মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই শক্তি ও পরিকাঠামোর পরিসরে সুযোগগুলিকে উৎসাহিত করবে, এবং তা করবে দু’ভাবে: শক্তির ঐতিহ্যগত রূপগুলিতে এবং পরিবহণের বিদ্যুদয়নের ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতা স্থাপনের ক্ষেত্রে। প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তিগত উপভোগ এবং কম কার্বন পরিবহণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির সম্মিলনে একটি স্থানীয় বৈদ্যুতিক মোটরবাইক কোম্পানি সম্প্রতি একটি বিশিষ্ট মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল শাখার থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে।[৩২] এইভাবে একটি শিল্প সম্ভবত প্রস্ফুটিত হতে চলেছে, কারণ ভারতের একটি লক্ষ্য রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবহণে বিদ্যুদয়নের ৩০ শতাংশে পৌঁছনো।[৩৩]
শিল্পনীতির প্রত্যাবর্তনের বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবণতার মধ্যে এই ধরনের সংস্কারগুলি স্থাপন করা হয়েছে: অতিমারি থেকে উত্থানের প্রেক্ষাপটে, এবং জ্বালানি সঙ্কট ও মার্কিন–চিন চলতি বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যে রাজনীতিবিদরা অগ্রাধিকার দিয়েছেন বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, উন্নত উৎপাদন, এআই ও ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং শক্তিক্ষেত্রে রূপান্তরের জন্য উদ্ভাবন–সহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে। যেহেতু ভারত প্রযুক্তি উৎপাদন বর্ণালী বরাবর অগ্রসর হচ্ছে, এবং স্পষ্টতই চিন থেকে বেরিয়ে আসা সরবরাহ শৃঙ্খল কার্যকলাপকে আকর্ষণ করছে,[৩৪] তাই মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সরকার–সমর্থিত সংকেতগুলি বিনিয়োগকারীরা অনুসরণ করলে ভাল করবে।
উপসংহার
সংক্ষেপে, ভারত সত্যিই বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান হওয়া যোগ্য। দীর্ঘকালীন পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ভিত্তিগুলি বৃদ্ধি পেয়ে কৃষি কার্যকলাপ থেকে উৎপাদন ও পরিষেবার দিকে সরে যাবে, এবং সেই কারণে অভ্যন্তরীণ উপভোগের ভিত্তিও ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে ও প্রসারিত হবে। কোভিড–১৯–এর যুগ্ম স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি রাশিয়া–ইউক্রেন দ্বন্দ্বের (যার ফলে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে এবং এইভাবে ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে) থেকে ভূ–রাজনৈতিক ঢেউয়ের সময় এই উপভোগের গল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষিত হয়েছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উভয় ক্ষেত্রেই অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেন, তবে কৃষি, জ্বালানি ও পরিবহণ–সহ সংস্কারের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলিই কিন্তু প্রাইভেট ইক্যুইটি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের থেকে দীর্ঘমেয়াদি ও ধৈর্য্যশীল মূলধন আকর্ষণের উপযোগী।
ভারতের শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থান আরও পুষ্ট হয়েছে তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং একটি খণ্ডিত বিশ্বের মধ্যে আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসনের অবস্থান দ্বারা। এশিয়াতে পুঁজি মোতায়েনের কথা বিবেচনা করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতার পটভূমিতে, ভারত দীর্ঘকালীন বিদেশি পুঁজিকে আকর্ষণ করে চলেছে, এবং ক্রমশই বেশি করে তা করছে প্রযুক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এবং এখনও, যখন বিশ্ব প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে মনোনিবেশ করে, সেই সময় প্রকৃতপক্ষে জাপান একটি উদাহরণ স্থাপন করেছে ভারতে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার একটি স্বল্পপাক্ষিক মডেল হিসাবে প্রতিরক্ষা বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে পারস্পরিক সুবিধা ও মূল্যসৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে। এইভাবে, জাপান সরকার ও সে দেশের নেতৃস্থানীয় কর্পোরেশনগুলির বিনিয়োগ থেকে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পথ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির শর্তগুলিকে আরও শক্তপোক্ত করবে, এবং সেইসঙ্গে ভারতে দীর্ঘমেয়াদি মূল্যসৃষ্টিতে আগ্রহী অন্য দেশগুলির জন্য একটি রোল মডেল হিসাবে কাজ করবে।
[ক] ব্যক্তিগত খরচ ভারতে জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ, যা দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির জন্য একটি ইতিবাচক সাড়ার পথ প্রদান করে।
[খ] ভারতের দ্রুতগতির ভোগ্যপণ্যের বাজার ২০২১ সালে ১৬ শতাংশ প্রসারিত হয়েছে, ২০২২ সালে টেকসই দুই অঙ্কের বৃদ্ধির সঙ্গে।
[গ] একটি দেশের কাছে থাকা বিদেশি সম্পদের মূল্য হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, বিদেশিদের মালিকানাধীন নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদের মূল্য কম।
[ঘ] পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) এবং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উৎপাদন প্রচারাভিযানের বাস্তবায়ন সহ, কিন্তু শুধু তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
[১] আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ‘জিপিএ নিয়ে এমডি ক্রিস্টালিনা জর্জিভার অক্টোবর ২০২২–এর প্রেস ব্রিফিং ট্রান্সক্রিপ্ট,’ ১৩ অক্টোবর, ২০২২, আইএমএফ।
[২] বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
[৩] শুও জু, “পারফরমেন্স-লিডারশিপ চেঞ্জ অ্যান্ড মার্কেট ফান্ডামেন্টালস,” এমএসসিআই।
[৪] ‘এমএসসিআই ইন্ডিয়া ইনডেক্স,’ এমএসসিআই।
[৫] আশুতোষ যোশী ও অক্ষয় চিনচালকর, ‘ফরেন ইনভেস্টর বেটস শো ইন্ডিয়ান স্টকস র্যালি হ্যাজ মোর লেগস,’ ব্লুমবার্গ, নভেম্বর ২৮, ২০২২
[৬] মাইকেল দেবব্রত পাত্র, “জিওপলিটিক্যাল স্পিলওভারস অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান ইকনমি” (স্পিচ, নিউ দিল্লি, জুন ২৪, ২০২২), ব্যাঙ্ক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট,https://www.bis.org/review/r220624e.pdf
[১০] কার্লোস ক্যান্টু, পাওলো ক্যাভালিনো, ফিওরেলা ডি ফিওরে ও জেমস ইয়েটম্যান, “কোভিড-১৯-এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আর্থিক প্রতিক্রিয়ার উপর একটি বিশ্বব্যাপী ডাটাবেস,” বিআইএস ওয়ার্কিং পেপারস নং ৯৩৪, মার্চ ২০২১।
[১১] আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ‘জিপিএ নিয়ে এমডি ক্রিস্টালিনা জর্জিভার অক্টোবর ২০২২–এর প্রেস ব্রিফিং ট্রান্সক্রিপ্ট,’
[১২] লি ইং শান, “ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে জাপান ও জার্মানিকে পিছনে ফেলে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে,” সিএনবিসি, ডিসেম্বর ১, ২০২২।
[১৩] শান, “ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে জাপান ও জার্মানিকে পিছনে ফেলে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে,”
[১৪] “চিন বনাম ভারত – ভোক্তা ব্যয়ের গতি কোথায়?” ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাব, ১৬ এপ্রিল, ২০২১।
[২৬] “জাপানের সুমিতোমো মিৎসুই প্রধান ভারতীয় ঋণদাতাকে ২ বিলিয়ন ডলারে কিনবে,” নিক্কেই এশিয়া, ৬ জুলাই, ২০২১।
[২৭] সুভাষ নারায়ণ ও শশাঙ্ক মাট্টু, “জাপানের জাইকা ভারতে বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়,” মিন্ট, ১৯ অক্টোবর, ২০২২।
[২৮] আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য জাপান ব্যাঙ্ক।
[২৯] মাইকেল দেবব্রত পাত্র, “জিওপলিটিক্যাল স্পিলওভারস অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান ইকনমি” (স্পিচ, নিউ দিল্লি, জুন ২৪, ২০২২), ব্যাঙ্ক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.