সেল-বেসড বা কোষভিত্তিক মাংস, যা কালচারড মিট, ল্যাব-গ্রোন মিট (ল্যাব-জাত মাংস) বা ক্লিন মিট (দূষণহীন মাংস) নামেও পরিচিত, তা আসলে একটি পরীক্ষাগারে উৎপন্ন প্রাণী কোষ থেকে উৎপাদিত মাংসকেই বোঝায়। এ কথা অনেকেই মনে করেন যে, কোষভিত্তিক মাংসের উত্পাদন পশুপালন এবং মাংসের জন্য পশুহত্যা করার চিরাচরিত পদ্ধতির তুলনায় বেশি পরিবেশবান্ধব, নৈতিক এবং স্থিতিশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেটসঅ্যান্ডমার্কেট নামের অ্যানালিটিক্স ফার্ম ২০২১ সালের রিপোর্টে অনুমান করেছে যে, বিশ্বব্যাপী কোষভিত্তিক মাংসের বাজার ২০২৭ সালের মধ্যে বার্ষিক ৬১.৪ শতাংশের যৌগিক বৃদ্ধির উপর ভর করে ২১৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। প্রতিবেদনটিতে পশুকল্যাণ, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এবং প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে বাজারের বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি বলে তুলে ধরা হয়েছে। ফার্মটি সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ফুড এজেন্সির কাছ থেকে তার কালচারড মিট থেকে প্রস্তুত ‘চিকেন বাইটস’ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পেয়েছে। এটি খাদ্যের ভবিষ্যতের নিরিখে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ল্যাব-জাত মাংস আমিষাশী মানুষদের কাছে লোভনীয় করে তোলার জন্য নির্মিত হয়েছে। বাজারে এটি যত সহজে ও ব্যাপকভাবে লভ্য হবে, মানুষ ততই বাণিজ্যিক পশুপালনের নৈতিক এবং পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে দুশ্চিন্তা না করেই মাংস খেতে পারবেন।
সুস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই ‘কৃত্রিম’ মাংসের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং পুষ্টির গুণাগুণ মূল্যায়ন করার জন্য পুষ্টি গবেষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা এখনও বিষয়টি সম্পর্কে গবেষণা চালাচ্ছেন। কালচারড মিট এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কী কী জানি, সে দিকেই আলোকপাত করা যাক।
ইতিবাচক দিকগুলি কী কী?
সুইস গবেষণা প্রকাশক ফ্রন্টিয়ার্স দ্বারা প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় কোষভিত্তিক মাংস উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুসারে, এটি গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নির্গমন ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত এবং ভূমি ব্যবহার ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। এসিএস পাবলিকেশন্সের আর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, কোষভিত্তিক মাংস উৎপাদন ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত জিএইচজি নির্গমন কমাতে পারে এবং চিরাচরিত গরুর মাংস উৎপাদনের নিরিখে ভূমি ব্যবহার ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।
কোষভিত্তিক মাংস একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উত্পাদিত হওয়ার দরুন এটি প্রচলিত মাংসের তুলনায় রোগজীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে দেয়। গবেষকদের একটি দল ২০১৮ সালে সায়েন্স ডিরেক্ট-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেন যে, কোষ-ভিত্তিক মাংস উৎপাদন ই কোলাই এবং সালমোনেলার মতো ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারে। পশুহত্যা ও পশুপালনে অ্যান্টিবায়োটিকের উপর নির্ভরতা অপসারণ করার দরুন এমনটা করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, কোষ-ভিত্তিক মাংস স্বল্প মাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট-সহ উৎপাদন করা সম্ভব, যা এটিকে একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প করে তোলে। এ ছাড়াও, কালচারড মিট উৎপাদনে ন্যূনতম জল ও জমি লাগার দরুন এটি স্থিতিশীলও বটে।
ল্যাব-জাত মাংস গ্রোথ হরমোন মুক্তও। বাণিজ্যিক পশুপালনের কারখানাগুলি খামারের পশুদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এই হরমোনগুলি ব্যবহার করে। সেগুলির অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা নিযুক্ত একটি গবেষণা কমিটি গবাদি পশুপালনে ব্যবহৃত ছ’টি গ্রোথ হরমোন পরীক্ষা করে দেখেছে। তারা এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, গ্রোথ হরমোনগুলির ‘বৃদ্ধিগত, নিউরোবায়োলজিক্যাল (স্নায়ুজৈবিক), জিনোটক্সিক (জিনগত দূষণ) এবং কার্সিনোজেনিক (ক্যানসারের সম্ভাবনা) প্রভাব ছিল।’
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
স্বাস্থ্যের উপর কালচারড মিটের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব এবং বৈচিত্র্যের অভাব একটি বহুমুখী চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। বেশিরভাগ ভোক্তাই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক পণ্য পছন্দ করেন এবং অপ্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার বর্জন করেন।
গবেষকরা বলছেন যে, ল্যাব-জাত মাংস উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত কালচার মিডিয়াম তৈরি করা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে কালচার মিডিয়াম হিসেবে ফেটাল বোভাইন সিরাম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটি মৃত বাছুরের রক্ত থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা ব্যয়বহুল এবং এই প্রক্রিয়া ল্যাব-জাত মাংসের নৈতিক গুণমানের বিরুদ্ধাচরণ করে। বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত রক্তনালীর একটি সুসংগঠিত শৃঙ্খল-সহ ট্রু মাসল বা আদর্শ পেশি নির্মাণ করতে পারেননি। এর ফল স্বরূপ, ভোক্তারা মাংসের বিভিন্ন ধরন বা কাট উপভোগ করতে অসুবিধায় পড়েন। বিভিন্ন প্রজাতি থেকে প্রাপ্ত মাংসের আসল গন্ধ এবং স্বাদের প্রতিলিপিকরণ থেকে আমরা এখনও কয়েক যোজন দূরেই আছি।
ল্যাব-জাত মাংসের ধারণা সাম্প্রতিক এবং স্বাস্থ্যের উপর এর ফলাফল এখনও অজানা। সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনায় স্ঘাইর ক্রিকি এবং জঁ ফ্রঁসোয়া হোকেত উল্লেখ করেছেন যে, দ্রুত কোষের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে, কালচার মিটের আস্তরণে ডিসরেগুলেশন বা এক ধরনের বিপাকীয় অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে। গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, এই কোষের আস্তরণগুলি ক্যান্সারের বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে এবং সেগুলি খেলে মানবদেহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে নির্দিষ্টভাবে কী প্রভাব পড়তে পারে তা এখনও অজানা।
কালচারড মিটই হতে পারে ভবিষ্যতের খাদ্য। এটি অ্যান্টিবায়োটিক-মুক্ত, জীবাণুমুক্ত এবং জিএইচজি নিঃসরণ করে না। কার্যকরভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হলে এটি বিশাল সংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে। এই মাংসের পুষ্টি-প্রোফাইলে পরিবর্তন এনে একে আরও স্বাস্থ্যকর করে তোলা যেতে পারে। যদিও নতুন সেল লাইন তৈরি এবং চিরাচরিত মাংসের মতো গঠন, স্বাদ ও পুষ্টিগত গুণমানসম্পন্ন মাংস উৎপাদনের জন্য বৃদ্ধির অবস্থার উন্নতির উপর এর সাফল্য নির্ভর করে।
নিরাপত্তা হল দ্বিতীয় বিবেচ্য গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। বিপর্যস্ত কোষের আস্তরণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিপদগুলি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। উচ্চ নিরাপত্তা গুণমান পূরণের জন্য ক্রমাগত পরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রক তদারকির প্রয়োজন। যদিও এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, কোষ-ভিত্তিক মাংস চিরাচরিত মাংস উৎপাদনের তুলনায় কম সম্পদ ব্যবহার করবে, কিন্তু প্রকৃত স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করার জন্য কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা শেষ পর্যন্ত কোষ-ভিত্তিক মাংসের সাফল্য নির্ধারণ করবে। এ সম্পর্কে ভোক্তাদের শিক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে এবং নিরাপত্তা, গুণমান এবং স্থিতিশীলতা সম্পর্কে তাদের সমস্ত উদ্বেগের সমাধান করতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য প্রিন্ট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.