গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জইশ উল-আদল (জইশ আল-জোলম নামেও পরিচিত, ইংরেজিতে ‘আর্মি অফ জাস্টিস’ এবং পূর্বে যা ‘জুন্দুল্লা’ নামে পরিচিত ছিল) এমন একটি সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী, যারা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান অঞ্চল এবং ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশব্যাপী বালোচ বিদ্রোহ উস্কে দিচ্ছে এবং ইরানের ছোট শহর রাস্কের একটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা গুলিযুদ্ধে ১২ জন ইরানি পুলিশ নিহত হয়েছেন। রাস্কের উপর হামলার ঘটনা অনেক বছর ধরে জইশ উল-আদলের তরফে চালানো হামলার ঘটনার অন্যতম।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বালোচ জঙ্গিবাদ এবং তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত জাতিগত উত্তেজনা আসলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পার্থক্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলি কেবল আঞ্চলিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গেও সম্পর্কিত। পাকিস্তান ইরানের কার্যকলাপের নিন্দা করেছে এবং পাকিস্তানে অবস্থানরত ইরানের শার্জ দ্যফেয়ার-কে তলব করেছে। ইরানি সংবাদমাধ্যমের মতে, জইশ উল-আদল বেলুচিস্তানের দুর্গম পাহাড়ে তাদের ঘাঁটিতে হামলার বিষয়টি স্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বালোচ জঙ্গিবাদ এবং তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত জাতিগত উত্তেজনা আসলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পার্থক্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, ইরানের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান এবং পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার উল হক ককর হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে সুইজারল্যান্ডের দাভোস অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলনে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং আফগানিস্তানে ইরানের বিশেষ প্রতিনিধি হাসান কাজেমো কামি পরামর্শের জন্য পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরের সময় আফগান সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে কামি বলেন যে, ‘ইসলামাবাদ এবং তেহরান কাবুলের সঙ্গে আলাপচারিতার বিষয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে।’ এমনটা হওয়ার আগে তেহরান ইসলামাবাদকে জইশ উল-আদলের উপর হামলা চালানোর কথা বলেছিল কি না তা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি), ইসলামিক স্টেট খোরাসান-এর (আইএসকেপি) তরফে গুরুতর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এবং বহু দশক ব্যাপী পাকিস্তান দ্বারা আশ্রিত আফগান তালিবানের সঙ্গে তার ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের পাশাপাশি ইরানের তরফে প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের মোকাবিলা করা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বালোচ জঙ্গিবাদ নিয়ে ইরান, পাকিস্তান ও তালিবানের মধ্যে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। প্রায়শই ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করা এবং আরও প্রকাশ্য ভাবে জইশ উল-আদলের মতো গোষ্ঠীকে অস্বীকার করার জন্য পাকিস্তান আফগান তালিবানকে দায়ী করেছে। জটিলতা শুধু মাত্র এই ভৌগোলিক পরিসরেই থেমে থাকেনি। জইশের প্রতিষ্ঠাতা নেতা সালাউদ্দিন ফারুকিও এর আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রতি ইরানি সমর্থনের বিরোধিতা করেছেন। দুই দেশের সীমান্তের আশেপাশে জইশের কার্যকলাপ নিয়ে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা ২০১১-১২ সাল থেকে চলছে। তখন থেকেই ইরান এই ধরনের গোষ্ঠীগুলির বিষয়ে নরম মনোভাব পোষণ করার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। ইরান একই সঙ্গে ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো অন্য শত্রুদেশকে এ বিষয়ে মদত দেওয়ার জন্য দায়ী করেছে।
কিছু বিশ্লেষক পাকিস্তানে ইরানের পদক্ষেপকে মধ্যপ্রাচ্যে তার বিদ্যমান কৌশলগত আঙ্গিকে বিচার করলেও সেই অনুমান আরও কিছুটা প্রসারিত হতে পারে। গাজায় বিদ্যমান যুদ্ধ বা লোহিত সাগরে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগে থেকেই জইশের মতো গোষ্ঠী এবং বালোচ জঙ্গিবাদ নিয়ে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ইরান প্রায়শই বলেছে যে, তারা বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জইশের নিরাপদ স্থানগুলিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাবে এবং দুই দেশের সীমান্তে সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় তখন থেকেই এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনাটি স্বতন্ত্র ভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়ক, যা ২০২১ সালে কাবুলে আফগান তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে বর্তমানে আরও জটিল হয়ে পড়েছে। জইশের আদর্শগত প্রকৃতি রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক উত্থানের বিনিময়ে তালিবানদের স্বার্থ সিদ্ধির কাজে জইশকে ব্যবহার করার পথে বাধা হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, জইশ প্রাথমিক ভাবে একটি ইসলামি আদর্শগত আন্দোলন এবং তার পর একটি রাজনৈতিক সত্তা (যেমনটা দেশে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তালিবানের মধ্যে ক্রমাগত টালবাহানার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে)।
ইরান প্রায়শই বলেছে যে, তারা বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জইশের নিরাপদ স্থানগুলিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাবে এবং দুই দেশের সীমান্তে সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় তখন থেকেই এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তানের জন্য এই নতুন সংঘাত ক্ষেত্র তার রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ প্রচারের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যর্থ নীতির জন্য আর একটি বড়রকম ধাক্কা। যেহেতু দেশের অর্থনীতি ক্রমশ ধসে পড়ছে এবং দেশটি নিজেই নিজের কৌশলগত সম্পদগুলিকে দেশের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন অন্যান্য দেশ এবং স্বার্থ ইতিহাসের এই সময়টিকে একতরফা ভাবে এই বাস্তুতন্ত্রকে পর্যবেক্ষণ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বলে মনে করছে। শুধু মাত্র তত্ত্বাবধায়করাই এই ডামাডোল সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, যেখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত সীমিত এবং সামরিক বাহিনীও প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলা অর্থাৎ ইমরান খানের ব্যাপক জনপ্রিয়তার মতো সমান্তরাল নাগরিক চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মতো ঘটনাকে ঘিরে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগজনক তথ্য হল এই যে, পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে একটি পারমাণবিক শক্তি। পারমাণবিক প্রতিরোধ স্পষ্টতই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ ছিল না। কারণ তেহরান বেলুচিস্তানে জইশ বাস্তুতন্ত্রকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। এই সব কিছুই এই প্রশ্নের জন্ম দেয় যে, ক্ষমতার অলিন্দে কোন ধরনের কৌশলগত চিন্তাভাবনা ঘোরাফেরা করবে, যদি দেশটি বিশ্বের গুটিকয়েক পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশের অন্যতম হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনাপ্রধান টিটিপি-র হুমকি মোকাবিলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্যের অনুরোধ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তবে ওয়াশিংটনের তরফে এ হেন সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আখ্যানকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। পাকিস্তান বর্তমানে তার পারমাণবিক অস্ত্রকে শুধু মাত্র এই ভয় সৃষ্টির কাজেই ব্যবহার করতে পারে যে, জঙ্গিদের হাতে এই পরমাণু শক্তি পড়লে তার ফল কেমন হবে। বিখ্যাত গবেষক স্টিফেন পি কোহেন যেমনটা একবার বলেছিলেন, পাকিস্তান তার নিজের মাথায় বন্দুক রেখে বিশ্বের সঙ্গে আলোচনায় বসে।
অবশেষে, এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই সত্যকেই প্রকাশ্যে এনেছে যে, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সমস্যা একেবারেই মিটে যায়নি এবং সেই সমস্যাকে আর কোনও মতেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তালিবানের সঙ্গে ইরানের চরম মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও দেশটি এক দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে প্রশাসনিক স্তরে কাজ করছে এবং সেই লক্ষ্যটি হল এ কথা সুনিশ্চিত করা, কোনও পশ্চিমী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন সামরিক শক্তি যেন আর কখনও তার সীমানার কাছে ফিরে না আসে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.