Published on Sep 02, 2021 Updated 0 Hours ago

ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির গঠনতান্ত্রিক ও পদ্ধতিগত গতিশীলতা বোঝা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এগুলিই ওই সব দলের কাজকর্মের ভিত্তি।

ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি

ভারতীয় গণতন্ত্র পৃথিবীর শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রগুলির অন্যতম যা বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিগত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে। এবং যে কোনও আধুনিক গণতন্ত্রের মতোই এ দেশেও রাজনৈতিক দলগুলিই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সরকারি ক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি। তাই ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির গঠনতান্ত্রিক ও পদ্ধতিগত গতিশীলতা বোঝা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এগুলিই ওই সব দলের কাজকর্মের ভিত্তি। এই প্রসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চরিত্র খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতীয় সংবিধানের কোনও ধারাতেই রাজনৈতিক দলগুলির আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কোনও সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। আইনসভায় অনুমোদিত বিধিবদ্ধ আইনেও রাজনৈতিক দলগুলির কোনও উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল অ্যাক্ট, ১৯৫১-এর ধারা ২৯ (এ)-তে রাজনৈতিক দলগুলির নিবন্ধীকরণের নির্দেশ দেওয়া আছে। রাজনৈতিক দলগুলির কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশন বা ইসিআই-এরও নেই।

২০০২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বনাম ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড আদার্স-এর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ছিল, দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের নীতি লঙ্ঘন করার জন্য রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। দলগুলির নিবন্ধীকরণ খারিজ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে, এ কথা স্বীকার করেও সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে, অন্যান্য ধরনের নিবন্ধীকরণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির নিবন্ধীকরণের ফারাক আছে। এই রায় রাজনৈতিক দলগুলির আচরণবিধি ও কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে এবং এর ফলে দলগুলির গণতান্ত্রিক ভাবে কাজ করার সম্ভাবনাও কমেছে।

মুখ্য প্রতিবন্ধকতা

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলি ভারতীয় গণতন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই তাদের গণতান্ত্রিক ভাবে কাজ করার সঙ্গে দেশের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও প্রাণবন্ততা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। দলগুলির ভেতরে গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির অভাব প্রধানত দু’টি মৌলিক ক্ষেত্রে বোঝা যায়।

প্রথমত, দলগুলির নেতৃত্ব নির্ধারণ ও সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি স্বচ্ছ ও সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নয়। এর ফলে দেশের সমস্ত নাগরিকের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে সমান সুযোগের মতো সাংবিধানিক অধিকারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলির কাজের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং ১৯৮৫ সালের কঠোর দলত্যাগ বিরোধী আইনের ফলে দলীয় বিধায়করা জাতীয় ও রাজ্য আইনসভায় নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী মত দিতে পারেন না। দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে আইনসভার ভোটে মত দানের সময়ে দলীয় নেতৃত্বের আদেশ (হুইপ) কঠোর ভাবে মেনে চলতে হয়। এই নিয়ম না মানলে আইনসভার সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়।

নেতৃত্ব নির্ধারণ এবং সদস্য নির্বাচন

অধিকাংশ বড় রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন স্তরের সাংগঠনিক পদগুলিতে নির্বাচনের পদ্ধতিটি নানাপ্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। দেখা গেছে, বিভিন্ন পদে নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন দলীয় কর্মকর্তাদের এমন একটি গোষ্ঠী, দলীয় প্রশাসন যাদের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি নির্বাচনের সময়েও যখন জাতীয় স্তরের সাংগঠনিক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন, তখনও দলের ক্ষমতাধরদের মনোনীত করে রাখা প্রার্থীরাই অন্য সদস্যদের দ্বারা সমর্থিত হন।

অধিকাংশ সময়েই দলীয় নেতাদের নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি সর্বসম্মতিক্রমে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়ে থাকে। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিক শিলমোহর দেওয়ার মতো নিছক আনুষ্ঠানিক এই সাংগঠনিক নির্বাচনগুলি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হয়। এবং তার মধ্যেও প্রচুর গোলমাল থাকে।

রাজনৈতিক দলে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর উপস্থিতি ভারতের পক্ষে বড় উদ্বেগের কারণ। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, দলগুলির কেন্দ্রীভূত ও গোলমেলে কাজকর্মের ফলে নির্বাচনে লড়ার টিকিট নির্দিষ্ট একদল মানুষই পান এবং বাকিরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে, নির্বাচনে লড়ার টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান সেই সমস্ত দলীয় সদস্য, যাঁরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী।

এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক কালে দলের মনোনীত বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর ক্ষেত্রে পূর্ব অপরাধের ইতিহাস সামনে উঠে এসেছে। ভারতীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপকতার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টেরও নজরে এসেছে। বর্তমানে দলগুলির ওপর আইনত প্রয়োগযোগ্য কোনও প্রক্রিয়া না থাকায় সমাজের এক বৃহৎ অংশের মানুষ দলের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির অভাবে নেতৃপদ এবং নির্বাচনী মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিধায়কদের স্বাধীনতা

দলীয় কর্মীদের মধ্যে কারা প্রতিনিধিত্বের জন্য নির্বাচিত হবেন শুধু সে ক্ষেত্রেই নয়, গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব দেখা গিয়েছে দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেও। ১৯৮৫ সালের দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী দলের নির্বাচিত বিধায়কদের দলের নির্দেশ (হুইপ) মেনে চলতে হয় যা স্থির করে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্লজ্জ ভাবে বিধায়ক কেনা-বেচার মাধ্যমে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার হেরফের ঘটিয়ে সরকার ভাঙ্গাগড়া ঠেকানো। যদিও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, আইনটি এখনও পর্যন্ত তার মূল লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ সফল হয়নি।

বরং এই আইনের ফলে দলগুলির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিবেশের আরও অবনতি হয়েছে। কারণ, “হুইপ’ মেনে চলার বাধ্যবাধকতার যে বোঝা এই আইন দলীয় বিধায়কদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, তার ফলে আইনসভায় তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ একজন বিধায়কের সিদ্ধান্তের বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের খামখেয়ালের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।“ এই অবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলীয় নেতৃত্বের কাছে নিজেদের কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকছেন। যদিও এ ব্যাপারে তাঁদের স্ব স্ব নির্বাচন কেন্দ্রের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা উচিত যাঁরা প্রার্থীটিকে নির্বাচিত করে আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দিয়েছেন।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা

ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতিতে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অভাব দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থিতিশীল ভাবে কাজ করার উপরে গভীর প্রভাব ফেলেছে। দলের ভেতরে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের অভাব, দলের হয়ে নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনয়ন পদ্ধতির অস্বচ্ছতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীর সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব এবং সর্বোপরি নির্বাচনী প্রচারে দলগুলির খরচ করা বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস সন্ধানে অবিলম্বে রাজনৈতিক দলগুলির সংস্কার সংক্রান্ত জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন

ইতিমধ্যেই ভারতে নির্বাচন সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলির সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকার দ্বারা গঠিত একাধিক কমিটি, যেমন — দীনেশ গোস্বামী কমিটি, তারকুন্ডে কমিটি এবং ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত কমিটি, দেশে রাজনৈতিক দলগুলির কার্যপদ্ধতির স্বচ্ছতার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছে। ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলির ভেতরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা ও দলগুলির সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক বা নিয়ন্ত্রক কাঠামো চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে ২০১১ সালে পলিটিক্যাল পার্টিজ (রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অ্যাফেয়ার্স)অ্যাক্ট শীর্ষক একটি আইনের খসড়াও কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রকে জমা দেওয়া হয়।

এই খসড়াটিতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যার সদস্যরা দলের রাজ্যশাখার স্থানীয় কমিটির সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধা থেকেই বিভিন্ন পদাধিকারী নির্বাচন করবেন এবং সে ক্ষেত্রে কোনও মনোনয়ন জমা নেওয়া হবে না।

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলিই প্রশাসনের মূল চালিকাশক্তি। তাই দলগুলির ভেতরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার অকাট্য নির্বাচনী দাবি থেকে উদ্ভূত সুদৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই ভারতকে তার রাজনৈতিক দলগুলির গণতন্ত্রীকরণের পথে এগিয়ে দেবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.