Published on Sep 03, 2024 Updated 0 Hours ago

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের উপরেই এখন দেশকে স্থিতিশীল করার দায়িত্ব বর্তায়।

অন্তর্বর্তী সরকার: বাংলাদেশে পরিবর্তনের মুখ

দেড় দশকের সরকারের শেষ রেশটুকু ঝেড়ে ফেলে নতুন সূচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। নোবেলবিজয়ী মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এখন এমন একটি দেশকে স্থিতিশীল করার দায়িত্বে রয়েছে, যা এখনও বিশৃঙ্খলা ও হিংসায় জর্জরিত। অন্তর্বর্তী সরকারের চিফ অ্যাডভাইজার বা প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ছাত্রদের দ্বারা মনোনীত - একজন প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য ভূমিকাসম্পন্ন – খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে ১৬ সদস্যের সমন্বয়ে নিজের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছেন। ইউনূস যেহেতু বাংলাদেশকে আবার উঠে দাঁড়ানো’র আহ্বান জানিয়েছেন, তাই এই নতুন মন্ত্রিসভা আসলে কী প্রতিনিধিত্ব করে তা বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর উপর অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশীয় দেশটির সঞ্চারপথ নির্ভর করবে।

নোবেলবিজয়ী মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এখন এমন একটি দেশকে স্থিতিশীল করার দায়িত্বে রয়েছে, যা এখনও বিশৃঙ্খলা ও হিংসায় জর্জরিত।

নতুন মন্ত্রিসভায় রয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান কার্যনির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; নারী অধিকারকর্মী ফরিদা আখতা; মানবাধিকার কর্মী ও অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা আদিলুর রহমান খান; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশী দেওবন্দী ইসলামী চিন্তাবিদ এএফএম খালিদ হোসেইন; গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টি নুরজাহান বেগম; মানবাধিকার সংস্থা ব্রতীর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ; বীর প্রতীকে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম; ছাত্রকর্মী এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুতকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠক নাহিদ ইসলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠক আসিফ মাহমুদ; বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাপক আসিফ নজরুল; প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী হাসান আরিফ; বাংলাদেশের প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার (২০০৭-২০১২) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন; পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা; মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক বিধানরঞ্জন রায় এবং প্রাক্তন বিদেশসচিব তৌহিদ হোসেন এই নতুন মন্ত্রিসভার নির্বাচন কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। সেগুলি নিম্নরূপ:

  • আওয়ামী লীগ (আ.লীগ) থেকে দূরত্ব বজায় রাখা: প্রথমত, উপদেষ্টাদের এই পরিষদটি পূর্বের ক্ষমতাসীন দল আ. লীগের কোন প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গড়ে উঠেছে। এই দলের ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই তৈরি হয়েছে। দলটি তার ৫৩ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশকে শাসন করেছে এবং সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত দেশে একটি বড় সমর্থন পেয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এখন আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার ও অঙ্গীকার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউনূস সরকার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার স্মরণে বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে বিবেচিত ১৫ অগস্টের ছুটি বাতিল করেছে। শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তিনি বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টও ছিলেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বিবেচিত ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করেছে ইউনূস সরকার।

উপরন্তু, ছাত্রদের বিক্ষোভের জবাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত মন্ত্রিসভায় দুই ছাত্র প্রতিনিধির অন্যতম আসিফ মাহমুদের ডাকা ছাত্র বিক্ষোভের জবাবে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান-সহ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ছজন শীর্ষ বিচারপতি ইউনূস সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিক্ষোভকারীদের মতে, এই বিচারকরা পূর্ববর্তী সরকারের প্রতি  পক্ষপাতদুষ্ট’ তাঁদের প্রস্থান নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করার এই প্রচেষ্টাস্বরূপ। দেশের প্রতি অবদানের কারণে আওয়ামী লীগকে এখন নিষিদ্ধ করা হয়নি এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

  • অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া: ইউনূস-সহ তিন সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা আর্থিক প্রেক্ষিতে একটি অর্থনৈতিক জোর প্রদর্শন করে। নোবেলবিজয়ী ইউনূস নিজে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক তৈরির জন্য প্রশংসিত এবং ক্ষুদ্র-অর্থায়ন ও ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। এর পাশাপাশি অন্যরা হলেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর যিনি ব্যাঙ্কের কার্যক্রম আধুনিকীকরণের জন্য কাজ করেছেন। এই খাতে বাংলাদেশ বেশ কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে দেশের মুদ্রাস্ফীতি বছর প্রতি বছর শতাংশ অর্থাৎ দশকের সর্বোচ্চে পৌঁছেছিল এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত টানা ১৩ মাস ধরে মুদ্রাস্ফীতি শতাংশের বেশি ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশের ঋণের বোঝাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিগত পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার চাপের মধ্যে রয়েছে, যেখানে প্রকৃত জিডিপি-র প্রবৃদ্ধি কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪.৮ শতাংশে। উপরন্তু, ভারসাম্য পরিশোধের ঘাটতি, বাজেট ঘাটতি, ক্রমহ্রাসমান রেমিট্যান্স বা অর্থপ্রেরণ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য এবং জ্বালানি খাতে চাহিদা সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছিলআজকের দিনে বাংলাদেশে জন্য সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরামর্শ অতি প্রয়োজন।
  • মানবাধিকারের উপর জোর দেওয়া:মনটা লক্ষ করা যেতে পারে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনটি বাংলাদেশের কিছু মূল উদ্বেগকে মোকাবিলা করার জন্য পরিকল্পিত হয়েছে এবং এই উদ্বেগগুলি প্রাক্তন সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষের মূলে প্রোথিত। এই বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা এবং ন্যান্য কারণের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের অবক্ষয় উল্লেখযোগ্যশেষোক্ত বিষয়টি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলির প্রাথমিক সমালোচনার বিষয়ে অন্যতম কারণ। জানুয়ারি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের ১২তম সাধারণ নির্বাচনের সময় এই অভিযোগগুলি চরম আকার ধারণ করেছিল। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় ২৫০০০ বিরোধী নেতা ও সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় ৫৬ জন নিহত হয়েছিলেন। কথিত নির্যাতন, রাজনৈতিক বন্দিদের ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রাখা এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অত্যধিক বলপ্রয়োগের কথাও উঠে আসে। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং হাসিনা সরকার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসে। এই নির্বাচনে সর্বকালীন নিম্ন মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ, নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরপর তৃতীয় বারের মতো হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার সময়েও এমনটা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, যখন বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করেছিল। বাংলাদেশ তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাগুলি দ্বারা আন্তর্জাতিক ভাবে সমালোচিত হয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিষদীয় উপদেষ্টাদের মধ্যে তাই দুজন মানবাধিকার কর্মী, একজন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ, একজন নারী অধিকারের পক্ষে সওয়ালকারী এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের জন্য মনোবিজ্ঞানের একজন বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

বাংলাদেশ তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাগুলি দ্বারা আন্তর্জাতিক ভাবে সমালোচিত হয়েছে।

আগামিদিনের পথ

ঢাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন অবশ্যই বাংলাদেশের সংস্কারের প্রচেষ্টার প্রতিফলন। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব নিয়মিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তিন মাসের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সুনিশ্চিত করা হলেও মহম্মদ ইউনূস ও তাঁর মন্ত্রিসভা যদি ঢাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনের সুবিধা প্রদান করতে পারে, তা নিঃসন্দেহে একটি বড় কৃতিত্ব হবে। তবে কোন দল নির্বাচনে লড়বে তা নিয়ে এখন বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি, অর্থাৎ দেশের প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেও জনসমর্থন অর্জনের জন্য দলটির প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। জামাত-ই-ইসলামি আসলে সেই সর্ববৃহৎ ইসলামি দল যাকে প্রায়ই তৎকালীন হাসিনা সরকার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। গত বছর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর এই দলটিও রাজনৈতিক ক্ষমতার নিশ্চিত প্রতিদ্বন্দ্বী। দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আ.লীগেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু নতুন ছাত্রদলের সামনের সারিতে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের উপর মনোনিবেশ করছে, তাই নির্বাচন ঘোষণার সময় এখনও আসেনি। শেষ পর্যন্ত যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বাংলাদেশের মূল উদ্বেগগুলিকেই অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সমাধান করতে হবে, যেমনটা পরিষদীয় উপদেষ্টা নির্বাচনে  প্রতিফলিত হয়েছে

 


সোহিনী বোস অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।

অনসূয়া বসু রায়চৌধুরী অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.