গ্লাসগো অধিবেশনে ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনা বা নেট জিরোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ভারত অতিক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সময়সীমা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। উন্নত অর্থনীতিসম্পন্ন দেশগুলির প্রায় সকলেই ২০৫০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাসে বা প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনতে দেশগুলির প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের উপযোগী।
চিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা ‘২০৩০ সালের আগে’ শীর্ষে পৌঁছনোর কথা বললেও নেট জিরো বা নিঃসরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে ‘২০৬০ সাল পর্যন্ত’ সুদীর্ঘ অতিক্রমণ পর্ব নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা চিনের এক উন্নয়নশীল দেশের তকমা এবং প্রতিযোগিতামূলক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে স্থির করা হলেও এটি পৃথগীকৃত দায়িত্ব বা ‘ডিফারেনশিয়েটেড রেসপনসিবিলিটি’ নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ইন্দোনেশিয়াও চিনের দেখানো পথে হেঁটেছে।
নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার দীর্ঘমেয়াদি ভারতীয় লক্ষ্যমাত্রার মূল কারণ যথাযথ অতিক্রমণের সুনিশ্চিতকরণ হলেও এ কথা ঠিক যে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিগুলি স্বল্পমেয়াদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসনকালের সঙ্গে অধিকাংশ সময়েই সাযুজ্যপূর্ণ হয় না। সুদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে এমন অপেক্ষাকৃত কঠিন প্রতিশ্রুতির দায় সাধারণত ভবিষ্যৎ প্রশাসনের ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতে সরাসরি নির্বাচিত লোকসভার ৮৮% সদস্য চল্লিশোর্ধ্ব এবং দেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বয়স ৩৫ বছরের বেশি। বর্তমানে সক্রিয় এই কর্মীদের অধিকাংশকেই শক্তি অতিক্রমণ প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হবে না। কিন্তু ভারত এক নবীন দেশ এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পদক্ষেপের ফলে ৩৫ বছরের কম বয়সি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ মানুষের জীবিকা, উপার্জন এবং ভাল ভাবে বেঁচে থাকার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে।
গ্লাসগোয় প্রশংসিত ‘কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা’-র মতো জলবায়ু সংরক্ষণ সংক্রান্ত পদক্ষেপের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক টানাপড়েনের দুশ্চিন্তা দূর করতে বিশ্বব্যাপী দেশগুলির সমন্বয় কি যথেষ্ট শক্তিশালী? এ ক্ষেত্রে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলির সঙ্গে চিন ও তার মিত্র দেশগুলির ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতের কথাও মনে রাখা জরুরি। এরই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অস্ত্রায়ণের দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই সব কিছুর ফলে নিয়মভিত্তিক মুক্ত বিশ্ব অর্থনীতির যে সুবিধেগুলি বিগত তিন দশক ধরে উপভোগ করা গেছে, সেগুলি আগামী তিন দশক স্থায়ী হবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকছে।
যদিও বিশ্ব শান্তি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ দুটি এমন জ্বলন্ত উদাহরণ যে বিষয়গুলিতে দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক সমন্বয়, ফলাফলের সুদক্ষ বিশ্লেষণ এবং বহুস্তরীয় আলাপ-আলোচনার মঞ্চগুলি উন্নয়নের এক প্রলম্বিত যুগের সূচনা করেছে।
এ কথা ঠিক যে স্থানীয় বা অভ্যন্তরীণ হিংসার ব্যাপারটি একাধিক ক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে এবং এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। এ রকমটা ঘটার দুটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল মায়ানমার এবং ইথিওপিয়া। এ রকম প্রায় ২২টি সংঘর্ষপ্রবণ দেশ আছে এবং এর পাশাপাশি আছে আরও ১৭টি দেশ যারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ভঙ্গুর। কিন্তু আন্তর্জাতিক পণ্য রফতানির পরিমাণ ১৯৭০ সালের গ্লোবাল জি ডি পি অর্থাৎ ১৯.৪% থেকে দ্বিগুণ হয়ে ২০২০ সালে ৪১.৬%-এ পরিণত হয়েছে। এর ফলে বিশ্বস্তরে দারিদ্র্য দূরীকরণ ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়েছে। ২০১১ সালের পি পি পি বা পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি, যা ছিল ১.৯ মার্কিন ডলার / প্রতি দিনের চেয়েও কম, তার প্রেক্ষিতে বিশ্বস্তরে দারিদ্র্য ১৯৮১ সালের ৪২.৭% থেকে কমে ২০১৭ সালে ৯.৩%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতে হেড কাউন্ট পভার্টি লেভেল — একই মাপকাঠিতে — ১৯৭৭ সালের ৬৩.১% থেকে ২০১১ সালে ২২.৫%-এ নেমে এসেছে। এস ডি জি বা স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বর্তমানে ২০৩০ সালকে সময়সীমা স্থির করা হয়েছে।
একই রকম ভাবে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশগুলির প্রতিশ্রুতি মাফিক ২০২০ সালের মধ্যে শক্তির অতিক্রমণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বার্ষিক ১০০০ কোটি মার্কিন ডলারের (দ্বিপাক্ষিক) সহায়তা প্রদানে গড়িমসি করা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এই অর্থাভাব পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিনিয়োগকারী খুঁজতে হবে।
একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো আপাতবিরোধী দুই লক্ষ্যপূরণের পথে যে একক ভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলা করতে হতে পারে সে বিষয়ে মোদী সরকার সচেতন। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংস্থানগুলি নিয়ন্ত্রণের বাঁধন আলগা করে দেওয়ার পক্ষে ছিল, তখনও ম্যাক্রো ইকোনমিক ক্রেডিবিলিটি বজায় রাখার মাধ্যমে যে আর্থিক শুদ্ধির পথে ভারত সরকার হেঁটেছিল তা থেকেই উপরোক্ত বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তানের তালিবানিকরণের প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের নীরব থাকা — যা নতুন মিত্র পাকিস্তান এবং চিনের মুকুটে ভূক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা অর্জনের এক নতুন পালক — চিন এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চল থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য উস্কানিমূলক আচরণের প্রতি তার আগাম সতর্ক মনোভাবকেই দর্শায়। আমেরিকার সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখার জন্য ‘কোয়াড’-এর মতো সংযুক্ত সৌহার্দ্য চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হওয়া ভারতের এ হেন মনোভাবের ফলাফল।
বিশ্বের সাম্প্রতিক আর্থ রাজনৈতিক অবস্থাকে নিজেদের সুবিধের জন্য ব্যবহার করতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের সীমিত আর্থিক ক্ষমতার কথা মাথায় রাখলে পারতপক্ষে তা প্রায় অসম্ভব এক কাজ। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বিশ্বের দরবারে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাই। কিন্তু যত দিন না আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কগুলিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে, তত দিন আমরা ‘সিদ্ধান্ত মেনে নিতে’ বাধ্য হব, ‘সিদ্ধান্ত নিতে’ সমর্থ হব না — যেমনটা গ্লাসগো সম্মেলনে ঘটতে দেখা গেছে। উচ্চ এক অঙ্কের আর্থিক বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে পাঁচ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি গড়ে তোলাই ভারতের প্রধান লক্ষ্য। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য যে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গ্লাসগোয় সশরীরে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন মনে করেননি এবং নিয়ম ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা যে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে, এই মতে তিনি অটল। বর্তমানে চিনের মাথা পিছু জাতীয় আয় ১০৬১০ মার্কিন ডলার (২০২০), আমেরিকার মাথা পিছু জাতীয় আয়ের ছ’ভাগের এক ভাগ। কিন্তু চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দ্বিগুণ হারে হওয়ার ফলে বিশ্বজনীন সিদ্ধান্ত তারা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এ হেন কূটনৈতিক স্বাধীনতা ভারতের কাছে নেই।
ইতিমধ্যেই সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার, ভূপৃষ্ঠে চলাচলকারী যানবাহনের বৈদ্যুতীকরণ, শিল্পাঞ্চলে এবং আবাসিক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সাশ্রয় ও অধিক দক্ষতার সঙ্গে বনাঞ্চল সংরক্ষণের মতো কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে সুকৌশলী হলেও এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণের মাত্রা শীর্ষে পৌঁছনোর পরে ক্রমহ্রাসমান হয়ে নেট জিরো বা শূন্য নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বর্তমান লক্ষ্যপূরণে যে মাত্রায় অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনতে হবে তা ১৯৯১ সালের উদারীকরণের তুলনায় অনেক বেশি। সেই সময়ে — ইংল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি — যারা আন্তর্জাতিক স্তরে একই রকম অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েও উন্নতি করতে পেরেছে, তারা ভারতের মতো দেরিতে শুরু করা দেশগুলিকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, দুঃসহ অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন না হয়ে এবং নিজের সার্বভৌমত্ব না খুইয়েও অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব।
বর্তমানে ‘লো কার্বন গ্রোথ’ বা অত্যন্ত কম মাত্রায় গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণকারী অর্থনীতিগুলির অংশ নয় এমন দেশগুলিকে এ হেন আশ্বাস দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। এখন জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত নির্দিষ্ট দক্ষতার ভাল বেতনযুক্ত নির্মাণকার্য এবং ইনটারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন চালিত পরিবহণ ব্যবস্থা আগামী দু’দশকের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরিবর্তে মোটর / যানবাহনের নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের নতুন সুবিধে, ব্যাটারি নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের নতুন পথ খুলে যাবে। তবে এ কথা এখনও স্পষ্ট নয় যে, ডিজিটাইজেশন, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কর্মরত রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) ত্রিমুখী সমন্বয়ের ফলে শিল্পাঞ্চলে ব্যয় হ্রাসের সুযোগ এবং একই সঙ্গে করনীতির মাধ্যমে শ্রম / মজুরিতে পুঁজি বিনিয়োগের প্রবণতা প্রতিযোগিতামূলক খরচ সাপেক্ষ মানবিক প্রচেষ্টার জন্য যথেষ্ট সুযোগ রাখতে সক্ষম হবে কি না। এর পাশাপাশি ভারতে উচ্চ মানের সরকারি শিক্ষা পাওয়ার সীমিত সুযোগের ব্যাপারটিও উল্লেখযোগ্য। জাতীয় স্তরে দক্ষতা বৃদ্ধির অবশ্যম্ভাবী প্রচেষ্টা এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক টানাপড়েন থেকে অদক্ষ কর্মীদের সুরক্ষা জোগানোর বিষয়টি প্রশাসনিক স্তরে সরকারের সক্ষমতার পরিচায়ক হয়ে উঠতে চলেছে — যেমনটা বর্তমানে মোটেও সুলভ নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আমেরিকার ‘মিড সেঞ্চুরি স্ট্র্যাটেজি’ বা ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণের পরিমাণ ২০০৫ সালের তুলনায় ৮০% কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাকে মাথাপিছু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে তিন টনেরও নিচে, যা ভারতের ২০১৮ সালের নিঃসরণের তুলনায় সামান্যই বেশি। এই লক্ষ্য অর্জনে শুধু মাত্র প্রযুক্তির ব্যবহারই যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি, মৃত্তিকা এবং জমি সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিগত উদ্যোগ, নির্মাণ সংক্রান্ত বিধি, স্থানিক পরিকল্পনার পাশাপাশি কার্বন শোষণ, তার ব্যবহার অথবা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে পৃথক করে তরল বা কঠিন আকারে সঞ্চয়ের মতো ঋণাত্মক নিঃসরণকারী প্রক্রিয়াগুলির বাস্তবায়নও সমান তাৎপর্যপূর্ণ। আমেরিকা তার ল্যান্ড কার্বন সিঙ্ক ৪৫% বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রায় ১৮৫০ সালের পরবর্তী সময়ে নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে হারিয়ে যাওয়া অরণ্যাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ জমি পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে নিঃসৃত কার্বনের ১৪% শোষিত হবে।
দুঃখজনক ভাবে উচ্চ জনঘনত্ব বিশিষ্ট ভারতের ক্ষেত্রে এমনটা করা সম্ভব নয় যে হেতু এ দেশে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ আমেরিকার তুলনায় এক চতুর্থাংশেরও কম। তবুও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণকে বিশ্বের মাথা পিছু গড় নিঃসরণের পরিমাণের মধ্যে আনতে ব্যয়ের সর্বাত্মক কৌশল প্রণিধানযোগ্য।
একটি তিন দফার কর্মসূচি
প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে এবং সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি ক্লাইমেট চেঞ্জ কাউন্সিল বা সি সি সি-র আইনি নির্মাণ করতে হবে, যে কাউন্সিলটি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক কর্তৃত্বের অধিকারী হবে। এই কাউন্সিলে সক্রিয় ভাবে রাজ্য, শহর এবং গ্রামীণ প্রশাসনিক সমিতিগুলির অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা সুনিশ্চিত করতে কাউন্সিলটির বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া নিতান্তই প্রয়োজনীয়। এটিকে এমন এক সর্বজনীন মঞ্চ হয়ে উঠতে হবে যার উপস্থিতি সব রাজ্যের রাজধানী এবং সব কটি স্মার্ট সিটিতে পরিলক্ষিত হবে। এবং যৌথ ভাবে এই কাউন্সিলটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে শক্তি, পরিবেশ, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ও বিদেশ মন্ত্রকগুলি। এ ক্ষেত্রে জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে এক দশক আগে নির্ধারিত জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি আরও প্রত্যক্ষ ভাবে কার্যকর প্রশমন পদ্ধতি এবং গ্রিন হাইড্রোজেনের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহারের সোপান হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সহায়তামূলক অভ্যন্তরীণ উৎসাহ এবং সহযোগিতার সুযোগসুবিধার মাধ্যমে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সফল ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ছাড়াও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পদক্ষেপে কর্পোরেট, বাণিজ্যিক সংস্থান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ আবশ্যিক যাতে নেট জিরো বা শূন্য নিঃসরণের লক্ষ্যে কর্মরত সংশ্লিষ্ট দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয়গুলিতে তাদেরও যুক্ত করা যায়।
নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে ভারতের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ব্যাপক ভাবে অসম। ব্যুরো অফ এনার্জি এফিশিয়েন্সির স্টার রেটিং প্রোগ্রামে যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহারের সুনির্দিষ্টকরণ সংস্থাভিত্তিক বা খুচরো কেনাকাটার ক্ষেত্রে এক জনপ্রিয় মাপকাঠি। ই ই এস এল লিমিটেড — যা সরকারি ক্ষেত্রের আওতাধীন একটি যৌথ মালিকানাভিত্তিক সংস্থা — সরকারি ক্ষেত্রে অঢেল পরিমাণ কেনাকাটার প্রসঙ্গে স্কেল এফেক্টের প্রভাব দর্শিয়েছে এবং দাম কমানোর মাধ্যমে এল ই ডি বালবের চাহিদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। একই রকম ভাবে স্কেল এফেক্টের ফলে বৈদ্যুতিন যানবাহন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কৃষি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং নির্মাণ কাজের চাহিদা / সম্ভাব্য বাজারের প্রসার ঘটাতে পারে।
পরিশেষে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে বাধা এবং সুযোগের ধরনধারণ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণভিত্তিক নীতি প্রণয়ন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, চাকরি, শিক্ষা, দক্ষতার অভিযোজন এবং কর্মসংস্থানে বিপুল পরিবর্তন থেকে কর্মীদের সুরক্ষা জোগানোর ক্ষেত্রে এবং নিম্ন কার্বন নিঃসরণ সংশ্লিষ্ট ভয় দূরীকরণে এবং ঐকমত্য গঠনে সাহায্য করবে।
এক আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এবং তার অব্যবহিত পরে ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া এক অর্থনৈতিক রূপান্তর আজ তিন দশক পরেও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এটি ছিল একটি টপ-ডাউন ব্যবস্থা, যার অনুমান ছিল তৃণমূল স্তরে আরও রাজনৈতিক ভাবে বিতর্কিত অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসবে। দুঃখজনক ভাবে বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারটি এখনও অধরা থেকে গেছে যা বর্তমানে চলতে থাকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক মন্দা থেকে স্পষ্ট। নেট জিরো অতিক্রমণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে আমরা এখন অনেকটা সময় পেয়েছি যা তাকে আরও বেশি করে সুসংহত এবং রূপান্তরধর্মী করে তুলবে। নিম্নতম স্তর থেকে উপরের দিকে একটি ‘ন্যায়সঙ্গত’ জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে জনস্বার্থের কথা মাথায় রাখার পাশাপাশি এ কাজের ভিত্তি সুদৃঢ় করা সম্ভব হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.