Published on Jan 19, 2022 Updated 0 Hours ago

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ আমাদের খুঁড়িয়ে–চলা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে বিপন্ন করবে।

ওমিক্রনের বিপদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি

কোভিড-১৯–এর নতুন ভ্যারিয়ান্ট ওমিক্রন যখন আবারও অর্থনৈতিক কাজকর্ম ব্যাহত করার সম্ভাবনা তৈরি করছে, ঠিক সেই সময়েই ভারতীয় অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপের উদ্বেগজনক প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পাইকারি মূল্য সূচকের (ডব্লিউপিআই) মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২১-এর নভেম্বরে বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১৪.২৩ শতাংশ (প্রাথমিক হিসেব)। ২০২০ সালের নভেম্বরে তা ছিল ২.২৯ শতাংশ। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাটির কারণ মূলত ম্যানুফ্যাকচারিং, জ্বালানি ও শক্তি ক্ষেত্রের পণ্যের ক্রমাগত চড়া দাম (চিত্র ১)।

চিত্র ১: পাইকারি মূল্য সূচকে (ডব্লিউপিআই) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরের মুদ্রাস্ফীতি, শতাংশে

নোট * = প্রাথমিক হিসেব | তথ্য সূত্র: বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক

প্রাথমিক পণ্যগুলির মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২১–এর অক্টোবর পর্যন্ত ৬.০০ শতাংশের নিচে ছিল, কিন্তু নভেম্বরে তা অনেকটা বেড়ে হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। এর কারণ নভেম্বরে সাধারণ ভাবে খাদ্য সামগ্রীর (যা প্রাথমিক পণ্যগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে) ও খাদ্যপণ্যের (যা ম্যানুফ্যাকচারিং গোষ্ঠীতে পড়ে) মূল্যবৃদ্ধি। খাদ্য সূচকে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২০২১ সালের অক্টোবরের ৩.০৬ শতাংশ থেকে অনেকটা বেড়ে নভেম্বরে হয়েছে ৬.৭০ শতাংশ।

অতিমারি-পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর কঠিন আর্থিক পরিস্থিতি পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর নিয়মিত কর বাড়িয়ে আংশিক ভাবে সামাল দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে পেট্রোল এবং ডিজেলের খুচরো মূল্যের মোটের উপর ৫০ শতাংশ হল কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্য বিক্রয় কর (ভ্যাট)। সংগৃহীত রাজস্ব যদিও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের খারাপ–হতে–থাকা ব্যালান্স শিটগুলোর জন্য একটা ভরসার জায়গা তৈরি করে, কিন্তু অন্য দিকে এলপিজি, পেট্রোল ও হাই স্পিড ডিজেলের (এইচএসডি) দামের ক্রমাগত বৃদ্ধি কোনও–না–কোনও সময়ে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতিকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। এখন সেটাই ঘটছে।

সারা দেশে পেট্রোল ও ডিজেলের খুচরো মূল্যের মোটের উপর ৫০ শতাংশ হল কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্য বিক্রয় কর (ভ্যাট)।

সমস্ত পণ্যের ডব্লিউপিআই-তে জ্বালানি ও শক্তির ওয়েটেজ ১৩.১৫ শতাংশ। জ্বালানি ও শক্তি কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং, জ্বালানির মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব ওই পণ্যগুলো ছাপিয়ে গিয়ে পড়ে অন্যান্য শ্রেণীর পণ্যের উপর।

মোট ডব্লিউপিআই-তে উৎপাদিত পণ্যের ওয়েটেজ সবচেয়ে বেশি:‌ ৬৪.২৩ শতাংশ। গত ছয় মাসে এই ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি ১০.০ শতাংশের বেশ উপরে ছিল। গত তিন মাসে উৎপাদিত পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১২.০০ শতাংশ (চিত্র ২)। এটা সত্যিসত্যিই একটা উদ্বেগজনক দিক।

২০২১–এর জুলাই থেকে জ্বালানি ও শক্তি শ্রেণীর পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে। সেপ্টেম্বরের পর বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হয়েছে। উপরন্তু, প্রাথমিক পণ্যে মুদ্রাস্ফীতি অক্টোবরের ৫.২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। এই সবগুলোর কারণে নভেম্বরে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ১৪.০০ শতাংশের স্তর পেরিয়ে গিয়েছে (চিত্র ২)৷

চিত্র ২: পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরের ডব্লিউপিআই–ভিত্তিক গত ৬ মাসের প্রবণতা, শতাংশে

নোট * = প্রাথমিক হিসেব | তথ্য সূত্র: বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক

উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে মৌলিক ধাতু, উদ্ভিজ্জ ও পশুর তেল ও চর্বি, বস্ত্র, কাগজ ও কাগজের পণ্য, রাসায়নিক ও রাসায়নিক পণ্য, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ চড়া মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। উদ্ভিজ্জ ও পশুর তেল ও চর্বির মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২১ সালের জুনে ছিল ৪৩.৫৮ শতাংশ, তারপরে তা নেমে এলেও নভেম্বরেও রয়েছে ২৩.১৬ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে মৌলিক ধাতুগুলোও—জুনে ২৯.০৯ শতাংশ, এবং নভেম্বরে ২৯.০৬ শতাংশ (চিত্র ৩)। মৌলিক ধাতু শ্রেণিতে সেমি-ফিনিশ্‌ড ইস্পাতের মুদ্রাস্ফীতি ২০২১ সালের অক্টোবরে ছিল ২৩.৮৫ শতাংশ, এবং নভেম্বরে ১৯.৪০ শতাংশ। ইস্পাত যে হেতু অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক, তাই এর দামের উপর এই ঊর্ধ্বমুখী চাপ অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর।

চিত্র ৩: নির্বাচিত উৎপাদিত পণ্যগুলিতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরে গত ৬ মাসের জন্য ডব্লিউপিআই–ভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা, শতাংশে

নোট * = প্রাথমিক হিসেব | তথ্য সূত্র: বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক

নভেম্বরে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪.৯১ শতাংশ, আর ভোক্তা খাদ্যমূল্য সূচক (সিএফপিআই) ছিল অনেকটা নিচে, ১.৮৭ শতাংশে। সুতরাং, ডব্লিউপিআই ও সিপিআই মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে। চলতি অর্থবছরেও এই ভিন্নতা বজায় ছিল। ২০২১–এর এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাইকারি মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১২.২ শতাংশ, আর সিপিআই বা খুচরা মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.২ শতাংশ।

পাইকারি মুদ্রাস্ফীতি খুচরা মুদ্রাস্ফীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না কেন?

ডব্লিউপিআই (২৪.৩৮ শতাংশ) থেকে সিপিআই (৫৪.১৮ শতাংশ)–এ খাদ্য ও পানীয়ের ওয়েটেজ বেশি। ২০২১ সালে খাদ্যের দাম ২০২০ সালের তুলনায় ধীর গতিতে বেড়েছে। এর কারণ ২০২০ সালে এই শ্রেণির পণ্যগুলিতে দাম চড়া ছিল (পরিভাষায় ‌হাই বেস এফেক্ট)। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯.৯ শতাংশ;‌ কিন্তু ২০২১ সালের একই সময়ের মধ্যে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ২.৮ শতাংশে।

২০২১ সালের শুরুতে খাদ্যের দাম বেশ চড়াই ছিল। খাদ্যপণ্যের ওয়েটেজ ডব্লিউপিআই-এর তুলনায় সিপিআই–এ দ্বিগুণেরও বেশি। অতএব, এখনও পর্যন্ত সিপিআই-তে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ফ্যাক্টরকে কমিয়ে দিয়েছে হাই বেস এফেক্ট। তবে এটি ডিসেম্বরের থেকে বদলে যেতে চলেছে, কারণ ডিসেম্বর ২০২০–তে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩.৪ শতাংশ।

বর্তমান ডব্লিউপিআই সিরিজ এপ্রিল ২০১২ থেকে শুরু হয়, এবং এখনও পর্যন্ত এই সিরিজের সর্বোচ্চ হল ১৪.২৩ শতাংশ। সিএমআইই–এর একটি সংযুক্ত ডব্লিউপিআই সিরিজ রয়েছে, যা ১৯৮৩–র এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে। ঘটনাক্রমে ২০২১–এর নভেম্বরে ডব্লিউপিআই মুদ্রাস্ফীতি এপ্রিল ১৯৯২–এর (‌যখন তা ছিল ১৩.৮ শতাংশ) পর থেকে এখন‌ সর্বোচ্চ। অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বরে ডব্লিউপিআই মুদ্রাস্ফীতি ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

নতুন কোভিড–১৯ ভ্যারিয়ান্ট ওমিক্রন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় যখন আরও অর্থনৈতিক বিঘ্নের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেই সময় এই মুদ্রাস্ফীতি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য অশুভ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন খুব বেশি রকম নির্ভরশীল সুদের কম হারের উপর, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের জন্য ঋণের সুদের হারের উপর। সুতরাং, যে কোনও রকম মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং তা মোকাবিলা করার জন্য সুদের হার বাড়ানোর ঘটনা ইতিমধ্যেই খুঁড়িয়ে–চলা অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আরও বিপন্ন করবে। এই মুদ্রাস্ফীতিকে যদি অনিত্য ও ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তা হলে ২০২২ সালে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তা এমন এক বোকামি হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে যার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.