তিন মাস, পার্লামেন্টে দুটি আস্থা ভোট, এবং একজন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার পর নেপালের ২০২২ নির্বাচন–উত্তর সরকার অবশেষে আকার নিয়েছে। নেপালি কংগ্রেসের (এনসি) সঙ্গে প্রাক–নির্বাচন জোট থাকা সত্ত্বেও মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল ‘প্রচণ্ড’ কিন্তু ইউএমএল নেতা কেপি ওলি ও রাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির মতো অন্য দলগুলির সমর্থনে ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর তৃতীয় মেয়াদ শুরু করেন। ইউএমএল–মাওবাদী জোট প্রায় অবিলম্বে সমস্যায় পড়েছিল: প্রথমে এনসি জানুয়ারির আস্থা ভোটে দহলের পক্ষে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, তারপর ফেব্রুয়ারিতে নেপালের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট কে হবেন তাই নিয়ে। দহল এনসি প্রার্থী রামচন্দ্র পাউডেলকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ওলি সরকার থেকে সরে আসেন, কিন্তু এনসি’র সমর্থনে মাওবাদী নেতা সহজেই মার্চ মাসে দ্বিতীয় আস্থা ভোটে জয়লাভ করেন।
নির্বাচন–পরবর্তী ইউএমএল–মাওবাদী জোটকে বেজিং উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। তারা খোলাখুলিভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল নেপালে একটি বামপন্থী সরকারই তাদের পছন্দ। চিন অনেক ধুমধাম করে কেরুং–রসুওয়াগধি স্থল সীমান্ত পয়েন্ট খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল; একটি চিনা দল তিব্বত থেকে বহুপ্রত্যাশিত ট্রেনের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে নেপালে পৌঁছেছিল; এবং চিন এমনকি নতুন পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে (পিআইএ) ‘চিন–নেপাল বিআরআই সহযোগিতার অগ্রণী প্রকল্প’ হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিল। যাই হোক, প্রতিবেদনগুলি থেকে জানা যায় যে দহল তাঁর নতুন সরকারকে নিয়ে চিনের উচ্ছ্বাসে খুব বেশি খুশি ছিলেন না। সরকারি কর্মকর্তারা এ কথা অস্বীকার করেছেন যে পিআইএ একটি বিআরআই প্রকল্প, এবং দহল আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও বোয়াও ফোরামে অংশগ্রহণ না করে চিনা উৎসাহ কমাতে চেয়েছিলেন।
বিগত কয়েক বছরে ভারতের নেপাল নীতি যত্নসহকারে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে দিল্লি কোনও ঢক্কানিনাদ ছাড়াই নেপালে সংযোগের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বাণিজ্যে, নেতৃত্ব দিয়েছে।
নেপালে সরকারগুলি কুখ্যাতভাবে অস্থির ছিল, এবং জোট রাজনীতির টানাপড়েনের কারণে দহল প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও এক সময়ে আরও ১৬টি বিভিন্ন মন্ত্রক নিজের হাতে রেখেছিলেন। তবে তাঁর তৃতীয় প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদের একটি ধ্রুবক ছিল দহলের জেদ যে তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ভারতে হবে। সম্ভবত, এমসিসি চুক্তি বাস্তবায়নের পর নেপালে মার্কিন–চিন প্রতিযোগিতা বাস্তবে উন্মোচিত হতে থাকায় একটি জটিল বাহ্যিক পরিবেশের কারণে এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ভারতের নেপাল নীতি যত্নসহকারে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে দিল্লি কোনও ঢক্কানিনাদ ছাড়াই নেপালে সংযোগের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বাণিজ্যে, নেতৃত্ব দিয়েছে। নেপাল এখন তার জলবিদ্যুৎ সম্পদের মাধ্যমে উন্নয়নের দীর্ঘপ্রতীক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে; এবং বিদ্যুৎ বাণিজ্য নিয়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি ও তৃতীয় দেশ থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি হবে দহলের দিল্লি সফরের প্রাথমিক অ্যাজেন্ডাগুলির একটি।
নেপালের জলবিদ্যুতে ভারত
ঐতিহাসিকভাবে, ভারত নেপালের জলবিদ্যুৎ সম্পদের উন্নয়ন থেকে দূরে সরে থেকেছে। এই ক্ষেত্রটিতে দিল্লির তেমন কোনও মনে–রাখার যোগ্য প্রকল্প না-থাকলেও তার পরিবর্তে নেপালের অন্যান্য পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছিল। যাই হোক, গত কয়েক বছরে এর পরিবর্তন হয়েছে। শতদ্রু জল বিদ্যুৎ নিগম (এসজেভিএন)–এর একটি সহায়ক সংস্থা ৯০০ মেগাওয়াটের অরুণ ৩ প্রকল্প রূপায়িত করছে। এর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে, যদিও প্রকল্প থেকে বিহারের সীতামারিতে ২৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্সমিশন লাইনের নির্মাণ জমি অধিগ্রহণের সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। এনএইচপিসি লিমিটেডের সঙ্গে নেপাল ৭৫০ মেগাওয়াট পশ্চিম শ্বেতী প্রকল্প এবং একই নদীতে অতিরিক্ত ৪৫০ মেগাওয়াট শ্বেতী নদী ৬ প্রকল্প উন্নয়নের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রথম প্রকল্পটি আর্থিকভাবে কার্যকর নয় বলে জানিয়ে দিয়ে চিনের থ্রি গর্জেস কর্পোরেশন তা থেকে সরে গিয়েছিল। ভারতীয় কর্পোরেট জিএমআর গ্রুপকে ৯০০ মেগাওয়াট আপার কর্নালি প্রোজেক্ট উন্নয়নের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে; তবে, সংস্থাটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আর্থিক সমাপ্তি অর্জন করতে না–পারায় প্রকল্পটি সমস্যায় পড়েছে।
এই ক্ষেত্রটিতে দিল্লির তেমন কোনও মনে–রাখার যোগ্য প্রকল্প না-থাকলেও তার পরিবর্তে নেপালের অন্যান্য পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছিল। যাই হোক, গত কয়েক বছরে এর পরিবর্তন হয়েছে।
উপরন্তু, নেপালের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য বিআরআই উদ্যোগের অধীনে তালিকাভুক্ত দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প — ৪৮০ মেগাওয়াট ফুকোট কর্নালি প্রকল্প ও ৭৫৬ মেগাওয়াট তামোর নদী স্টোরেজ–টাইপ প্রকল্প — যথাক্রমে এনএইচপিসি ও এসজেভিএম–কে দেওয়া হয়েছে বলে কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৷ বেশ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত ট্রান্সমিশন লাইনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ধলকেবার–মুজফফরপুর ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষমতা বর্তমান ৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৮০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে ঐকমত্য হয়েছে। বিহারের ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট ৭.২১ ভারতীয় রুপি প্রতি ইউনিট হারে নেপালি বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য মার্চ মাসে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
যা নেপালের বহুপ্রতীক্ষিত জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে পারে তেমন সব চেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি হল, ২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে ১১ বিলিয়ন নেপালি রুপি (৬.৮ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি) মূল্যের বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হয়েছে ৷ নেপাল বর্তমানে ১০টি প্রকল্প থেকে উৎপাদিত ৪৫২.৬ মেগাওয়াট ভারতের ডে–অ্যাহেড ইলেকট্রিসিটি মার্কেটে (যে বাজারে আজকের দামে পরের দিনে কেনাবেচা করা যায়) বিক্রি করার অনুমতি পেয়েছে। দহলের দিল্লি সফরের মূল অ্যাজেন্ডাগুলির মধ্যে একটি হল বর্তমান বার্ষিক পুনর্নবীকরণের পরিবর্তে, যা নেপালি কর্মকর্তাদের মতে বাণিজ্যে ‘অনিশ্চয়তা’ এনেছে, বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য প্রস্তাবিত ২৫ বছরের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করা। এমন উদ্বেগ রয়েছে যে ভারতের আন্তঃরাজ্য সংবহন ব্যবস্থার (আইএসটিএস) অভ্যন্তরীণ প্রকল্পগুলির চার্জ মকুব করার সিদ্ধান্ত নেপালি বিদ্যুৎ রপ্তানিকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে, এবং কাঠমান্ডুও তার বিদ্যুৎ রপ্তানিতে একই রকম ছাড় চাইবে। একইভাবে, নেপালি বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিও হয়তো শীঘ্রই তাদের বিদ্যুৎ সরাসরি ভারতীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে।
বৃদ্ধির জন্য একটি রেসিপি
ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহার করে বাংলাদেশে নেপালি বিদ্যুৎ রপ্তানি ত্বরান্বিত করলে ভারতের আঞ্চলিক সংযোগে বাড়তি গতি আসবে। কাঠমান্ডু ও ঢাকা উভয়ই এই প্রস্তাবের বিষয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক, এবং এটি দিল্লির সবুজ সঙ্কেতের পরে বিশ্বব্যাপী ত্রিপক্ষীয় শক্তি সহযোগিতার অল্প কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে একটি হয়ে উঠবে। এটি বৃহত্তর বিবিআইএন সংযোগ এবং ভারতের জি২০ আকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করবে, আর সেইসঙ্গে এপ্রিল ২০২২–এ জারি করা নেপাল ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রীয় সহযোগিতার জয়েন্ট ভিশন স্টেটমেন্টে গতি এনে দেবে।
কিন্তু যে কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মতোই এ ক্ষেত্রেও কয়েকটি সমস্যা দূর করতে হবে। ভারত–চিন প্রতিযোগিতার প্রতিধ্বনি নেপালে অনুভূত হয়েছে, যেহেতু ভারত তার বাজারে চিনের বিকশিত বা অর্থায়নে নির্মিত পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে। এটি নেপালি বেসরকারি ক্ষেত্রের পাওয়ার ডেভেলপারদের মধ্যে উদ্বেগের একটি বড় মাত্রা তৈরি করেছে, যারা সম্ভাব্য রপ্তানির বাজার হিসাবে ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে। বাজারে প্রবেশাধিকার বন্ধ করা নেপালের জন্য চিনের দিকে না–তাকানোর একটি কারণ হয়ে উঠতে পারে ঠিকই, তবে নীতিটি চিনকে নেপালি বাজারে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, যেখানে আগে তার প্রবেশ সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন, চিন জড়িত আছে এমন প্রকল্পগুলিতে বিস্ফোরক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত শেষ–ব্যবহারকারীর শংসাপত্র চাওয়ার কারণে নেপাল এখন কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিস্ফোরক চিন থেকে আমদানি করেছে। ভারতের পদক্ষেপ সেই প্রকল্পগুলিতেও প্রসারিত করা হয়েছে যেখানে ভারতীয় ও চিনা ঠিকাদার উভয়ই জড়িত ছিল, যেমন ৪৫৬ মেগাওয়াট আপার তামাকোশি প্রকল্প অথবা এডিবি–র মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান অর্থায়িত ভৈরহাওয়ার গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো প্রকল্প, যা একটি চিনা ঠিকাদার তৈরি করেছিল।
ভারত–চিন প্রতিযোগিতার প্রতিধ্বনি নেপালে অনুভূত হয়েছে, যেহেতু ভারত তার বাজারে চিনের বিকশিত বা অর্থায়নে নির্মিত পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে।
দহলের সফরের সময় বাজারে প্রবেশাধিকার এবং বিদ্যুতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা আলোচ্যসূচিতে গুরুত্ব পাবে। সেইসঙ্গে ভারতীয় বাজারগুলি উদ্বৃত্ত নেপালি শক্তি রপ্তানির পাশাপাশি ভৈরহাওয়া ও পোখরাতে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর তৎকালীন নেপালি সমকক্ষ সুশীল কৈরালা এক যৌথ বিবৃতিতে ছয় মাসের মধ্যে নেপালে তিনটি অতিরিক্ত বিমান প্রবেশ সুবিধার ব্যবস্থা করতে সম্মত হয়েছিলেন। তার প্রায় নয় বছর পরে অতিরিক্ত বিমান রুটের দীর্ঘকালের অমীমাংসিত প্রশ্নটির সমাধান অবশ্যই এই সফরের সময় হওয়া প্রয়োজন। কালাপানি বিরোধের পরে নেপালের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিরক্তিকর বিষয় হয়েই থাকবে, যতক্ষণ না তার সমাধান করা হয়। তবে এমন সম্ভাবনাই বেশি যে দহল তাঁর সফরের সময় বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করবেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগ দীর্ঘকাল ধরে একটি মরীচিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের ঘটনাবলি আশা জাগিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিকভাবে সদৃশ কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সংযোগহীন এই অঞ্চলটিতে এই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে। দ্বিপাক্ষিক ইউপিআই পেমেন্ট ইন্টারফেসের মতো সমস্যাগুলি, যা এই মুহূর্তে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এই সংযোগ প্রয়াসকে বাড়িয়ে তুলবে। তবে মূল বিষয় হবে প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের আশ্বাস যে দিল্লির জি২০ প্রেসিডেন্সি বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সংযোগ প্রকল্পগুলোকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.