বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত এবং বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর নির্বাচন হতে চলেছে। এই নির্বাচন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন উভয় গণতন্ত্রই একটি ‘মুক্ত এবং অবাধ’ ইন্দো-প্যাসিফিক বজায় রাখতে এবং দৃঢ় ও আগ্রাসী চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দক্ষিণ এশিয়ায় (এসএ) তাদের আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। এই সহযোগিতার বেশির ভাগই ২০২২ সালের মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। এই কৌশলটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির তরফে সমালোচনার উদ্রেক করেছে। কারণ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে’ এই অঞ্চলটিকে দেখার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। যদিও এ কথা সত্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় যে, ভারত এই অঞ্চলে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক। তা সত্ত্বেও এই ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা বাস্তবে জটিলতর হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পর্কে ধারণা
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলটি বিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পথ খুঁজে নেওয়ার জন্য পথনির্দেশিকার রূপরেখা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক মনোযোগ প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি প্রতিহত করার মধ্যে নিহিত, যেখানে চিন তার অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ব্যবহার করে এক প্রধান শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, চিনের এই ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং প্রভাব আইন, মূল্যবোধ ও নীতিগুলিকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং তা বিশ্ব ব্যবস্থাকে অন্য আকার প্রদান করছে।
ভৌগোলিক পরিসরের কারণে দক্ষিণ এশিয়া এই ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলটি চিনের প্রতিবেশে থাকা হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এখানেই ভারত মহাসাগরে সি লাইনস অব কমিউনিকেশনস (এসএলওসি) বা যোগাযোগের সামুদ্রিক পথ অবস্থিত। শতাব্দীর ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে এবং ২০১৩ সালের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলে চিনা উপস্থিতি এবং প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভৌগোলিক পরিসরের কারণে দক্ষিণ এশিয়া এই ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলটি চিনের প্রতিবেশে থাকা হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ভারত মহাসাগরে সি লাইনস অব কমিউনিকেশনস (এসএলওসি) বা যোগাযোগের সামুদ্রিক পথে অবস্থিত।
এই ‘মূল্যভিত্তিক ব্যবস্থা' বজায় রাখার জন্য তিনটি কৌশল বা নীতি রয়েছে। একটি হল চিনকে পিছু হঠাতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে এই অঞ্চলে ভারতের নেতৃত্বকে সমর্থন করা এবং তার পরিপূরক হয়ে ওঠা। এর ফলস্বরূপ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ, সমন্বয় ও সহযোগিতা করছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা যাতে তারা চিনা প্রভাব এবং জবরদস্তিমূলক কৌশলগুলির প্রতি স্থিতিস্থাপক হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, এই দেশগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করা। প্রতিরক্ষা, প্রশাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক সক্ষমতা, উন্নয়ন সহায়তা ইত্যাদি-সহ বিভিন্ন খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং এই দেশগুলির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
কৌশল নিয়ে সমস্যা
চিনকে প্রতিহত করার জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন সাধারণ কৌশলগত স্বার্থ সত্ত্বেও দেশ দু’টি ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরিখে অগ্রাধিকার এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরস্পরের চেয়ে আলাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিনকে প্রতিহত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার বিষয়টি স্বতন্ত্র, যখন অন্য দিকে ভারত চিনা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আরও বেশি উদ্বিগ্ন। বাস্তবে দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলিকে চাপ দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ব্যবহার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
চিনকে প্রতিহত করার জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন সাধারণ কৌশলগত স্বার্থ সত্ত্বেও দেশ দু’টি ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরিখে অগ্রাধিকার এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরস্পরের চেয়ে আলাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিনকে প্রতিহত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার বিষয়টি স্বতন্ত্র, যখন অন্য দিকে ভারত চিনা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আরও বেশি উদ্বিগ্ন।
এর ফলস্বরূপ, ভারত এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যধিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক এবং এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে, ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে যে কোনও ভুল পদক্ষেপ গ্রহণের পরিণতি ভারতকেই বহন করতে হবে। এ ছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে উপস্থিতি এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার আগ্রহ রয়েছে, যা কখনও কখনও এই অঞ্চলে ‘নেতা’ হিসাবে ভারতকে সমর্থন করার নীতির বিরোধিতা করতে পারে।
বিস্তৃত ভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার নীতির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে তিনটি বিন্যাসে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে।
ভারতের সঙ্গে সমন্বয়
প্রথম ক্ষেত্রটি হল যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের কৌশলগত স্বার্থ ও নীতি সমন্বিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপদেশের অভ্যন্তরে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, বিশেষ করে যখন রাজাপক্ষে (প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষে) ক্ষমতায় ছিলেন। উভয় দেশই রাজাপক্ষে-দ্বয়কে অন্যদের চেয়ে বেশি চিনাপন্থী বলে মনে করত।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের সূত্রপাতের দরুন ‘ঋণ ফাঁদে ফেলা’র জন্য চিনের সমালোচনা করা এবং চিনা উপস্থিতি ও প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল, যাতে ভারত শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বের করে আনতে পারে। ভারত সহায়তা প্রদানের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপদেশটিতে একটি সম্পূরক ভূমিকা পালন করে। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। একই ভাবে ভারতের সঙ্গে একযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বেলআউটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়াও দুই দেশ চিনা গুপ্তচর জাহাজের নোঙর করা নিষিদ্ধ করার জন্য প্রায়শই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স কর্পোরেশন (ডিএফসি) ভারতের আদানি বন্দর দ্বারা নির্মিত ওয়েস্ট কন্টেনার টার্মিনালের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের সূত্রপাতের দরুন ‘ঋণ ফাঁদে ফেলা’র জন্য চিনের সমালোচনা করা এবং চিনা উপস্থিতি ও প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল, যাতে ভারত শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বের করে আনতে পারে।
ভারত থেকে স্বতন্ত্র ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দ্বীপদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৃষি ও দুগ্ধ খামারে সহযোগিতা ও সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, সমঝোতা ও মানবাধিকার নিয়েও শ্রীলঙ্কাকে চাপ দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক ভাবে বিষয়টি উত্থাপন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন কিছু প্রাক্তন ও কর্মরত প্রতিরক্ষা কর্মীদেরও নিষেধাজ্ঞার আওতায় রেখেছে। তা সত্ত্বেও তারা সে দেশের সরকারের তীব্র সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, অর্থনৈতিক ভাবে পুনরায় সশক্ত হতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে চিনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য না করেও তার উপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা তেমন কোনও মতপার্থক্য ছাড়াই ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উন্নততর সহযোগিতায় অবদান রেখেছে।
পরস্পরবিরোধী ধারণা ও কৌশল
দ্বিতীয় বিন্যাসটিকে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নীতি অগ্রাধিকার এবং ধারণা ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি বাংলাদেশকে ভারত ও চিন থেকে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনে সহায়তা করেছে। তবে তিনি ভারতের সংবেদনশীলতাকে সম্মান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছেন এবং দেশের কট্টরপন্থী ও চরমপন্থীদের দমন করেছেন, যারা প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির মদতপুষ্ট ছিল। এর ফলস্বরূপ, ভারত শেখ হাসিনাকে এমন একজন নেতা বলে মনে করে, যিনি দেশ ও অঞ্চলটিতে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছেন।
অন্য দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে শেখ হাসিনাকে একজন কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্ব বলে মনে করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনে করে, শেখ হাসিনা এমন এক জন নেত্রী, যিনি বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন, বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করছেন এবং এর ফলে চিনা প্রভাবের জন্য তা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছে। তারা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অনুমোদন দিয়েছে এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী পক্ষকে বিদ্রুপ করেছে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে।
একাধিক সময়ে ভারত ব্যক্তিগত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার গণতন্ত্র সম্পর্কিত বাগাড়ম্বর হ্রাস করতে বলেছে, যাতে শেখ হাসিনা চিনপন্থী না হয়ে পড়েন। নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে সে দেশে চিনা প্রভাব সীমিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বলে মনে করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন পক্ষ সমর্থন করেছিল। শেখ হাসিনার বিজয়ের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনী অনুশীলন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময় স্থিতাবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এবং চিনকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তাকেই দর্শায়। কিন্তু জনপ্রিয় আখ্যানের বিপরীতে, ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া এবং দিল্লি ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকার ও নীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছে এবং কিছুটা হলেও নয়াদিল্লির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
একটি সুবিধাবাদী নীতি
তৃতীয় বিন্যাস হল সেই ক্ষেত্র, যেখানে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত স্বার্থ এবং নীতিতে একত্রিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন নীতি অনুসরণ করাই লাভজনক বলে মনে করে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারওই মলদ্বীপের গণতন্ত্রের বিষয়ে প্রশাসনের পূর্ব ইতিহাসকে সমস্যাজনক বলে মনে হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারের বিপরীতে – যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইত যে, ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক – বর্তমান প্রশাসন মনে করে যে, বিশেষ করে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুইজ্জুর বিদেশনীতির লক্ষ্য যখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করা, অংশীদারিত্বে বৈচিত্র্য আনা এবং চিনের সঙ্গে সহযোগিতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা-- এর প্রেক্ষিতে দিল্লির কম সুবিধা রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ভাবে মলদ্বীপের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক উন্নত করার জন্য একটি সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করেছে এবং চিনের উপর মলদ্বীপের ব্যাপক নির্ভরতাকে কিছুটা হলেও সীমিত করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (এআইডি) অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সামান্থা পাওয়ার, ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড-এর কম্যান্ডার অ্যাডমিরাল জন অ্যাকুইলিনো, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ফর সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স ডোনাল্ড লু এবং ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস রিচার্ড পাওয়ারের মতো একাধিক উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক মলদ্বীপ সফর করেছেন।
উভয় দেশ বাণিজ্য, পর্যটন, উন্নয়ন, জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মলদ্বীপে একটি ইউএস এড কার্যালয় স্থাপন করবে এবং ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানে চারটি টহলদারি নৌকা প্রদান করবে। একটি বিমান প্রদান এবং দ্বীপদেশে সম্ভাব্য মার্কিন ডিএফসি বিনিয়োগের বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। যদিও এ কথা স্পষ্ট নয় যে, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার বিষয়ে উত্সাহ জোগাচ্ছে বা পরামর্শ প্রদান করছে কি না। তবে এ কথা অবশ্যই স্পষ্ট যে, বিশেষ করে মুইজ্জুর অধীনে মলদ্বীপে ভারতের প্রধান ভূমিকা নেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধৈর্য সহকারে আর অপেক্ষা করছে না।
উপসংহার
জনপ্রিয় আখ্যানের বিপরীতে হেঁটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে’ দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে না। উভয় দেশেরই চিনকে প্রতিহত করার জন্য একটি সাধারণ কৌশলগত আগ্রহ থাকলেও তাদের কৌশল এবং অগ্রাধিকার ভিন্ন ভিন্ন। এমনটা বলা হলেও এ কথা সত্য যে, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতে একে অপরকে প্রয়োজন হবে। ভারত এই অঞ্চলে আরও ভাল উন্নয়ন অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চাইবে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে অন্যত্র তার সংস্থান সীমাবদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ভারত যাতে নিজের উপস্থিতি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে। এই সহযোগিতা কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে তাদের পারস্পরিক সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা এবং একে অপরের সংবেদনশীলতা ও স্বার্থকে শ্রদ্ধা করার ক্ষমতার উপর।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য মর্নিং-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.