ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তাদের ২+২ বার্ষিক স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগ গত ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন এবং সেক্রেটারি অব ডিফেন্স লয়েড জে. অস্টিন ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মন্ত্রী-পর্যায়ের আলাপ-আলোচনার পঞ্চম দফার জন্য নয়াদিল্লিতে এসেছিলেন। ভারতীয় তরফে নেতৃত্বে ছিলেন বিদেশমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
আলোচনার এই দফার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, সব কিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত এই আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব ক্রমশ গভীরতর হলেও উভয় পক্ষই বর্তমানে একাধিক অন্যান্য সঙ্কটে জর্জরিত।
গাজা যুদ্ধের পাশাপাশি ইউক্রেনের অব্যাহত যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট ব্যস্ত। গাজা নিয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিস্তৃত চুক্তি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েলে হামাসের তরফে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার সমালোচনা করেন, যে হামলায় ১২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং হামাস প্রাথমিক হামলায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে আটক করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ভাবে বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বামপন্থী দলের তরফে উল্লেখযোগ্য ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও ইজরায়েলকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দুই দেশই গাজায় সংঘাতের মধ্যে আটকে থাকা প্যালেস্তাইনি নাগরিকদের সমর্থন করে। কারণ ইজরায়েল নিরলস ভাবে হামাসকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
একই সময়ে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে জোরালো ভাবে সমর্থন করে চলেছে, যখন ভারত রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে পশ্চিমী সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনও সাফল্য আসার আগেই ইউক্রেনের সাম্প্রতিক আক্রমণ থেমে গিয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এই ঘটনা এই ইঙ্গিতই দেয় যে, যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য এবং সম্ভবত এই বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরেও অব্যাহত থাকবে।
মতবিরোধের এ হেন ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন এই ধরনের সমস্যাগুলিকে একপাশে সরিয়ে রেখে নিজেদের মধ্যকার কৌশলগত সহযোগিতাকে গভীরতর করার জন্য একটি উপায় খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু এই একাধিক সঙ্কটের বিষয়ে চুক্তি ও মতবিরোধের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, অন্যান্য তাৎক্ষণিক চাপের সঙ্কট সত্ত্বেও ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগকে বিপথে যেতে দেয়নি।
উভয় দেশের জন্যই তাদের নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিকের বৃহত্তর আঞ্চলিক গতিশীলতার প্রেক্ষিতে যুদ্ধরত চিনের কৌশলগত চ্যালেঞ্জের হার উচ্চ ও স্পষ্ট। উভয় পক্ষের তরফে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে চিনের নাম উল্লেখ না-করা হলেও রাজনাথ সিং সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্টতই বলেন যে, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত বিষয়ে ‘চিনের আগ্রাসনের মোকাবিলা-সহ’ নানা প্রেক্ষিতে একই পরিস্থিতিতে রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতিটি তাঁর বক্তব্যের তুলনায় ও তাঁর উদ্দেশ্যের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হলেও এ কথা লক্ষ করা জরুরি যে, এই বিবৃতিকে লঘু করে দেওয়ার জন্য কোনও পরবর্তী সংশোধন বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। দুই দেশই কোয়াড-এর মতো অংশীদারিত্ব-সহ একটি অবাধ, উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিককে সুনিশ্চিত করার জন্য তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২+২ আলাপ-আলোচনার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রেক্ষিত হল দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, মহাকাশ বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করা ও সেমিকন্ডাক্টর প্রসঙ্গ। মন্ত্রীরা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথা বলেছেন। বিশেষ করে ‘ভারতে জিই এফ-৪১৪ জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) অ্যারোস্পেস এবং হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের (এইচএএল) মধ্যে একটি বাণিজ্যিক চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু হয়েছে। মন্ত্রীরা আরও যোগ করেছেন যে, এটি এমন ধরনের এক অংশীদারিত্ব, যা বিকাশের জন্য দুই দেশই উন্মুখ। কারণ দুই দেশই একসঙ্গে উৎপাদন ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা-সহ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতায় আগ্রহী।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় অস্টিন বলেন, ‘বর্তমানে আমরা সাঁজোয়া যান উৎপাদনের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছি। আমরা আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলের নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং মার্কিন ও ভারতীয় সংস্থাগুলি থেকে পণ্য ও পরিষেবার বিধানকে সমন্বিত করতে যে পদক্ষেপ করতে পারি, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।’ এর পাশাপাশি ভারত চিন-ভারত সীমান্ত এলাকা এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সার্বিক নজরদারি বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ৩১টি এমকিউ-৯বি সশস্ত্র ড্রোন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কেনার পরিকল্পনা করছে।
ভারত-মার্কিন কৌশলগত আলাপ-আলোচনার অধীনে ‘মহাকাশ বাণিজ্য’-এর উপর মনোযোগ দিয়ে ইন্ডিয়া-ইউএস সিভিল স্পেস জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আওতায় একটি পঞ্চম সাব-ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দুই পক্ষই হাত মিলিয়েছে এবং মহাকাশ সহযোগিতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ওয়ার্কিং গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মহাকাশ সংস্থা নাসা এবং ইসরো। উভয় পক্ষই ওয়ার্কিং গ্রুপের অধীনে ‘গ্রহের প্রতিরক্ষা’কে সংযুক্ত করার পাশাপাশি ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বহুপাক্ষিক স্পেস মিশন প্ল্যানিং অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (এসপিএজি) এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্টরয়েড ওয়ার্নিং নেটওয়ার্ক-এর (আইএডব্লিউএন) সঙ্গে সংযোজনের বিষয়টির প্রশংসা করেছে।
যৌথ বিবৃতিতে ‘ভারতের ক্রমবর্ধমান রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সর্বস্তরীয় (এমআরও) ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে উভয় পক্ষের আগ্রহের কথা তুলে ধরা হয়েছে, যা বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও মার্কিন নৌযানের ভ্রমণকালীন মেরামতকেও অন্তর্ভুক্ত করে।’ তারা ভারতের এমআরও সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য - যার মধ্যে বিমান ও মানববিহীন আকাশযানের মেরামতও অন্তর্ভুক্ত – মার্কিন শিল্পের প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানিয়েছে।
তবে এত সব কিছুর পাশাপাশি এই উদ্বেগও বিদ্যমান যে, একাধিক আন্তর্জাতিক সঙ্কট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগকে ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে সরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু ইন্ডিয়া-ইউএস ২+২ স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগ দর্শিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে ব্যস্ত থাকলেও, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার যা করা দরকার, সেই সদিচ্ছা সম্পূর্ণ রূপে হারায়নি।
এই নিবন্ধটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.