Published on Jan 25, 2022 Updated 0 Hours ago

ভারত-রুশ সম্পর্কের অনেকগুলি ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা ধারা যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চিন এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করলে এই দিকগুলির উপরে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা উচিত হবে না।

আন্তর্জাতিক স্তরে শক্তি সমীকরণের জটিলতা সত্ত্বেও ভারত এবং রাশিয়া ২০২২ সালে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর মস্কো এবং নয়াদিল্লির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু নীতিগত দূরত্ব অতিক্রম করতে সাহায্য করলেও গঠনগত সমস্যা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বার বার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে বাধ্য করবে। এর ফলে উভয় দেশকেই এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটিতে অত্যন্ত হিসেবি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দুই দেশের সম্পর্কে যে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, তাতে অস্থির আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা গঠনগত সমস্যাগুলি প্রতিফলিত। ভারত এবং রাশিয়া তাদের সম্পর্কের পুনর্গঠনে যখন ব্যস্ত, তখন তাদের প্রধান অংশীদার দেশগুলি যেমন, ভারতের জন্য আমেরিকা এবং রাশিয়ার জন্য চিন, বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতেছে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে চিনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত এবং পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিকূল সম্পর্কের ভিত্তিতে। এ সব কিছুর পাশাপাশি ভারত-রাশিয়া অর্থনৈতিক সম্পর্কের দুর্বলতা এবং ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমেরিকার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের কথা মাথায় রাখলে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, এ হেন নৈরাশ্যবাদী ধারণাও অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না।

এই সংযোগস্থাপক প্রকল্পগুলির ফলে রাশিয়ার দূর প্রাচ্যে যৌথ কর্মসূচিগুলি উৎসাহ পাবে। পাশাপাশি হাইড্রোকার্বন, অসামরিক পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশ, এমনকি আর্থিক ক্ষেত্রেও আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে পুতিনের আলোচনার পরে উভয় পক্ষই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তাঁরা তাঁদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সামনে উপস্থিত বাধাগুলি সম্পর্কে সচেতন এবং এই বাধাগুলি দূর করার পথ খুঁজতে উভয় পক্ষই সক্রিয় ভাবে কাজ করছে।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে না পারা যে এই জোটের সামনে প্রধান বাধা, তা উভয় দেশই মেনে নিয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের প্রধান লক্ষ্য হল সংযোগস্থাপক কর্মসূচিগুলি, যেমন- চাবাহারকে উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডর বা নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডরের (আই এন এস টি সি) সঙ্গে এবং চেন্নাইকে ভ্লাদিভস্তক সামুদ্রিক করিডর বা বাণিজ্যপথের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এই সংযোগস্থাপক প্রকল্পগুলির ফলে রাশিয়ার দূর প্রাচ্যে যৌথ কর্মসূচিগুলি উৎসাহ পাবে। পাশাপাশি হাইড্রোকার্বন, অসামরিক পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশ, এমনকি আর্থিক ক্ষেত্রেও আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।

দুই দেশই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রের অংশগ্রহণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিকে আরও বেশি করে সংযুক্ত করার কাজে রাশিয়ার দূর প্রাচ্যের একাধিক প্রকল্পে ২০১৯ সালে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণদানে মোদীর ঘোষণা এই লক্ষ্য পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে।

ভারতও দেশের মাটিতে যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে সামরিক চুক্তির সঙ্গে অভিনব উপায়ে অর্থনৈতিক চুক্তির বাস্তবায়নে তৎপর হচ্ছে। ভারতের জন্য অস্ত্রসংক্রান্ত নির্মাণকার্যে রাশিয়ার বহু দশকের অভিজ্ঞতা বর্তমান এবং তারা প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী। ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য এ কে ২০৩ রাইফেল ও ফ্রিগেট বা রণতরী নির্মাণের চুক্তি এই আগ্রহকেই দর্শায়।

ভারতের জন্য অস্ত্রসংক্রান্ত নির্মাণকার্যে রাশিয়ার বহু দশকের অভিজ্ঞতা বর্তমান এবং তারা প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী।

সামরিক বিষয়ে আন্তঃসহযোগিতার চুক্তির সময়সীমা বৃদ্ধির পরে এ ধরনের আরও একাধিক নতুন যৌথ কর্মসূচি উঠে আসতে পারে। চুক্তির মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়ানোর তাৎপর্য হল এই যে, দুই দেশই একে অন্যের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যৌথ ভাবে আরও কয়েক বছর— সম্ভবত দশক— আন্তঃসহযোগিতার কাজ করবে। এর পাশাপাশি, রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অব লজিস্টিকস এগ্রিমেন্ট (রেলোস) দ্রুতই স্বাক্ষরিত হতে চলেছে দুই দেশের মধ্যে। যদিও অনেকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ভারত আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয় দেশের সঙ্গে একই রকমের চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না।

রেলোস চুক্তি ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্টের (লেমোয়া) সমতুল্য যা উভয় পক্ষের স্বীকৃত সামরিক পরিকাঠামোর প্রয়োজনগুলির পরিপূরকের কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিটি ‘পরিভাষাগত পার্থক্যের’ জন্য শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয়নি, যা অনুবাদের ফারাকের জন্য সম্ভব হয়নি বলে একাধিক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে।

যৌথ বিবৃতি এবং সরকারি ঘোষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, উভয় পক্ষই আফগানিস্তান, ইন্দো-প্যাসিফিক, কোয়াড এবং চিনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের মতো আপাতবিরোধী বিষয়গুলি নিয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য কমিয়ে এনেছে। সর্বশেষে এটা বলা যায় যে, ২০২০ সালের ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার অবস্থান ভারতের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। তাই শুধু নয়, ভারত এ বিষয়ে রাশিয়ার ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়েও স্বস্তিতে রয়েছে। এবং এ সব কিছুর ফলেই পুতিনের পক্ষে রাশিয়া-ভারত-চিনের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখোমুখি বৈঠকের ইঙ্গিত দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় মোদী বলেছিলেন যে, সীমান্তে চিনের আগ্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ না হলে এ নিয়ে কথা দেওয়া সম্ভব নয়। না। পুতিনের বিদেশনীতি উপদেষ্টা ইউরি উশাকভের বক্তব্য অনুযায়ী, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে এই ধরনের শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইতিবাচক দিকের ইঙ্গিত দেবে।

সর্বশেষে এটা বলা যায় যে, ২০২০ সালের ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার অবস্থান ভারতের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

কিন্তু এই ইতিবাচক দিকগুলি থাকা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা ধারা যেমন প্রধান বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চিন এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করলে এই দিকগুলির উপরে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা উচিত হবে না। চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রতিকূল প্রকৃতি আগামী কয়েক বছরেও উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হবে, এমন কোনও সম্ভাবনা নেই।

ভারত আশা রাখতে পারে যে, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে শীর্ষত্বের লড়াইয়ে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকবে। এর জন্য অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, ইউরোপের নিরাপত্তা, নিজের সীমান্তের ভিতরে ও বাইরে একাধিক অঞ্চলকে প্রভাবিত করার রাশিয়ার ইচ্ছার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার সমঝোতায় আসা জরুরি।

পরিস্থিতি যে দিকেই গড়াক, ভারত ও রাশিয়ার একটি বহু মেরু বিশ্ব গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা তাদের আগামী বছরগুলিতেও একটি শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী করে তুলবে। মোদী-পুতিন শীর্ষ সম্মেলন এই বোঝাপড়া এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই পথ অনুসরণ করার সংকল্পকেই প্রতিফলিত করছে।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় মানি কন্ট্রোলে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.