Published on Jul 12, 2022 Updated 0 Hours ago

ভারত–নর্ডিক অংশীদারি বছরের পর বছর ধরে রূপান্তরিত হয়ে এখন কৌশলগত সমকেন্দ্রিকতা চিহ্নিত করছে, যা দ্বিপাক্ষিক ও বৈশ্বিক ভূ–রাজনীতিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাবিত করে

ভারত–নর্ডিক সম্পর্ক: একটি পারস্পরিক যোগাযোগের আখ্যান

ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, আইসল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত নর্ডিক দেশগুলি ও ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পারস্পরিক আস্থা, স্থায়ী বন্ধুত্ব এবং অভিন্ন অগ্রগতির মনোভাবের ভিত্তিতে বহুমাত্রিক কৌশলগত সহযোগিতার পথ চলা শুরু করেছে। উভয় পক্ষকে প্রাকৃতিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ তারা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নীতি, বহুত্ববাদ ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ভাগ করে নেয়। নর্ডিক দেশগুলি যেমন সর্বোত্তম উদ্ভাবন, সবুজ প্রযুক্তি, পরিচ্ছন্ন শক্তি, জলবায়ু সক্রিয়তা এবং শক্তি বৈচিত্র্য নিয়ে আসে, তেমনই ভারতও হল একটি দ্রুত গতিশীল অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র, যার হাতে আছে স্থিতিশীল ও প্রভাবশালী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদের একটি বড় মজুদ, উপমহাদেশীয় মাত্রার একটি বিস্তীর্ণ বাজার, অত্যন্ত কার্যকর ট্যালেন্ট পুল, এবং একটি উদ্দীপক উদ্ভাবনী বাস্তুতন্ত্র। ভারত–নর্ডিক সমকেন্দ্রিকতার ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলা যেতে পারে যে এই ধরনের ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন, কৌশলগত উচ্চতায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই ধরনের সম্পর্ক কোভিড-১৯ অতিমারির পরে জোটগুলির দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক ফাটল, আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ইউক্রেন সংঘাতের ফলে উদ্ভূত নিরাপত্তা ও মানবিক উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে উদীয়মান ভূ-কৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেও সাহায্য করতে পারে।

২০২২ সালের মে মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর নর্ডিক সমকক্ষদের মধ্যে ব্যক্তিগত উপস্থিতির বিন্যাসে দ্বিতীয় ভারত–নর্ডিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন চলতি সহযোগিতামূলক সংলাপকে আরও জোরালো ভাবে কৌশলগত উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক ভরবেগ প্রদান করেছে। পারস্পরিক প্রয়োজন পূরণকারী অংশীদারি আরও গভীর করার জন্য নেতৃবৃন্দকে এই শীর্ষ সম্মেলন নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও রোডম্যাপ দিয়েছে। ভারতের কিছু বিশিষ্ট উদ্যোগ যেমন “‘‌মেক ইন ইন্ডিয়া’‌, ‘‌ডিজিটাল ইন্ডিয়া, ‘‌স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া’‌, এবং ক্লিন গঙ্গা মিশন নর্ডিক দেশগুলির সক্রিয় ভাবে ভারতে বিনিয়োগ এবং অংশগ্রহণ করার জন্য একটা বড় সুযোগ দেয়। আবার ভারত–নর্ডিক ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক ভারতকে তার আর্কটিক নীতির প্রচারে আরও সক্ষম করে তোলে, যে নীতি সেই অঞ্চলে কৌশলগত উপস্থিতির জন্য নয়াদিল্লির দৃঢ় সংকল্পের প্রতিফলন ঘটায়। একই সঙ্গে, এই সম্পর্ক সহায়ক হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ই ইউ) সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক একত্রীকরণে, যা ইতিমধ্যেই গতি অর্জন করছে।

ভারত–নর্ডিক ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক ভারতকে তার আর্কটিক নীতির প্রচারে আরও সক্ষম করে তোলে, যে নীতি সেই অঞ্চলে কৌশলগত উপস্থিতির জন্য নয়াদিল্লির দৃঢ় সংকল্পকে প্রতিফলিত করে।

নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় দায়বদ্ধতা, বিশেষ করে কোভিড-১৯ আখ্যানের পরে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের বর্ধিত দক্ষ কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সমর্থন জোগানো, এবং সেই সঙ্গে উদীয়মান ভূ–রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক শাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চেতনার মতো বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া সঠিক পথে পদক্ষেপ। সেই প্রেক্ষাপটে উভয়পক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে (ইউ এন এস সি)‌ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, দ্রুত প্রতিক্রিয়া দিতে সক্ষম, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করার জন্য সংস্কারের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার দৃঢ় সংকল্প প্রদর্শন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, ভারত এবং নর্ডিক দেশগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান অংশীদারির এই দৃঢ় বিশ্বাস, আস্থা ও স্থিতিস্থাপকতার মূল্যায়ন এই ঘটনা থেকে করা যেতে পারে যে ভারত ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যার সঙ্গে নর্ডিক দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন স্তরে এমন একান্ত সহযোগিতা রয়েছে। ভলভো, এরিকসন  আই কে ই এ, টেট্রা পাক, কোন, আহলস্ট্রম, ওয়ার্টসিলা এবং নোকিয়ার মতো বেশ কয়েকটি নর্ডিক বহুজাতিক সংস্থা বর্তমানে বিশাল ভারতীয় বাজার–ভিত্তিকে কাজে লাগাচ্ছে, এবং একই সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, প্রযুক্তি অংশীদারি ও কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে। একই সঙ্গে, নর্ডিক দেশগুলির স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং ভারতের উচ্চাভিলাষী স্মার্ট সিটি প্রকল্পের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতারও  উভয়ের যৌথ অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা আছে। একই ভাবে, বছরের পর বছর ধরে নর্ডিক দেশগুলিতে ভারতের বিনিয়োগও বেড়েছে। এখন সুইডেনে ৭০টিরও বেশি ভারতীয় সংস্থা রয়েছে, এবং ভারতীয় সংস্থাগুলি বর্ধিত গতিতে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নরওয়েতে তাদের উপস্থিতি তৈরি করছে, বিশেষ করে আই টি, অটোমোবাইল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রে। এই ধরনের পারস্পরিক ব্যবসা ও বিনিয়োগ ক্রমবিকাশমান অংশীদারিকে কৌশলগত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গভীর ভূমিকা পালন করছে। গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, অদূর ভবিষ্যতে যা সফল ভাবে সম্পাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে সেই ভারত–ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পরিসরে নর্ডিক রাষ্ট্রগুলির ক্রমবর্ধমান আগ্রহ উভয় পক্ষের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে আরও উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি রাখে।

ভারত ও নর্ডিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উদ্ভাবন ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বর্ধিত সহযোগিতার ফলে ভারতের সমৃদ্ধ প্রতিভার ভিত্তি ও ডিজিটালাইজেশন প্রয়াসকে নর্ডিক রাষ্ট্রগুলির উদ্ভাবন ও সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়টি ক্রমশ বেশি করে গতি পাচ্ছে৷ ‘‌উদ্ভাবনী ও স্থিতিশীল সমাধানে’‌ বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অভিন্ন আগ্রহ, এবং সেই সঙ্গে ‘‌খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষি, স্বাস্থ্য প্রকল্প ও জীবন বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ শনাক্তকরণ’‌ প্রয়াসকে” অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

ভারত ও নর্ডিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উদ্ভাবন ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বর্ধিত সহযোগিতার ফলে ভারতের সমৃদ্ধ প্রতিভার ভিত্তি ও ডিজিটালাইজেশন প্রয়াসকে নর্ডিক রাষ্ট্রগুলির উদ্ভাবন ও সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়টি ক্রমশ বেশি করে গতি পাচ্ছে৷

জ্বালানি সহযোগিতা ও জলবায়ু সক্রিয়তার ইস্যু দুটিতেও ভারত ও নর্ডিক দেশগুলি একযোগে কাজ করার জন্য দায়বদ্ধ। এর লক্ষ্য স্থিতিশীল সবুজ প্রযুক্তির স্তরের উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সহযোগিতায় প্রেরণা জোগানো। এই উদ্দেশ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির অন্বেষণ ও ব্যবহারের জন্য ভারতের বড় ধরনের প্রয়াস কিন্তু বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পারস্পরিক স্বার্থের নিখুঁত মিলন ঘটায়। ভারত ও নর্ডিক দেশগুলির প্যারিস চুক্তির বিধানগুলি বজায় রাখা এবং মেনে চলার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি, এবং জলবায়ু সক্রিয়তার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে অনুমোদিত সীমাতে হ্রাস করতে ত্বরান্বিত প্রচেষ্টার কথা বারবার বলা, এ সবের মধ্যে দিয়ে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাকে আকার দেওয়ার প্রশ্নে পরিকল্পনা ও নির্দেশনার অভিন্নতা প্রতিফলিত হয়। একই সঙ্গে ভারত–ফ্রান্স নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সৌর জোটকে নর্ডিকরা পুরোপুরি সমর্থন করেছে। সুইডেন ইতিমধ্যেই এর সদস্য হয়েছে এবং নরওয়ে সম্প্রতি এতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধরনের সমস্ত ঘটনার ভবিষ্যতে  শক্তিশালী প্রভাব পড়বে জলবায়ু সক্রিয়তা, পরিচ্ছন্ন শক্তি সহযোগিতা, এবং কার্যকর ভাবে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলার উপযোগী শক্তিশালী নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নে সমন্বিত ভাবে কাজ করার উপর ।

ভারত–নর্ডিক কৌশলগত অংশীদারির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল সামুদ্রিক সহযোগিতার উপর জোর দেওয়া। অভিন্ন  অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীল অর্থনীতিতে বর্ধিত বিনিয়োগকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারত এবং নর্ডিক রাষ্ট্রগুলি সমুদ্রের জলের বিস্তীর্ণ অংশ দ্বারা বেষ্টিত। নর্ডিকদের সঙ্গে সামুদ্রিক সহযোগিতাকে আরও গভীর করার বিষয়টিকে ভারত বেশি করে গুরুত্ব দেওয়ায় পারস্পরিক দক্ষতা বিনিময়, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য উদ্যোগ বৃদ্ধি, সমুদ্র শিল্পে বিনিয়োগের উপর জোর দেওয়া, এবং উভয় পক্ষের সুবিধার জন্য অভিন্ন সামুদ্রিক ঐতিহ্য ভাগ করে নেওয়ার  প্রচুর সুযোগ দেবে। ২০২২–এর মে মাসে ভারত–নর্ডিক শীর্ষ সম্মেলনের পরে জারি করা যৌথ বিবৃতি অনুসারে, প্রধানমন্ত্রীরা ‘‌ভারত ও নর্ডিক দেশগুলিতে সামুদ্রিক, উপকূলীয়, এবং উপকূল–দূরবর্তী বায়ুশক্তি ক্ষেত্র–সহ টেকসই সামুদ্রিক শিল্পে ব্যবসায়িক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগকে উদ্দীপিত করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন’‌। এগুলি বৈদেশিক নীতিতে নয়াদিল্লির কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যার লক্ষ্য সামুদ্রিক ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ এবং বৃহত্তর সক্রিয়তা। পাশাপাশি, নর্ডিকদের সঙ্গে বৃহত্তর সামুদ্রিক সহযোগিতা ভারতের আর্কটিক নীতিকে শক্তিশালী করার পরিসর তৈরি করে, যার মধ্যে আছে স্থিতিশীল উন্নয়ন, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্ভাবন ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা–নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য একটি কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি । সেই প্রেক্ষাপটে শিপিং শিল্পকে ভবিষ্যতে কম–কার্বন শিল্পে রূপান্তরিত করতে অংশীদারির জন্য উভয় পক্ষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সঠিক দিকে একটি পদক্ষেপ।

সামগ্রিক ভাবে, ভারত–নর্ডিক কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, বহুত্ববাদী সমাজ, স্থিতিশীল নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সহযোগিতা, উদ্ভাবন এবং জলবায়ু ন্যায়বিচারের শক্তিশালী ভিতের উপর। একবিংশ শতকের বিশ্বব্যবস্থার বিবর্তনে আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য উচ্চতর ভারত–নর্ডিক অংশীদারির গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান ভাবে স্বীকৃত হয়েছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.