Image Source: Getty
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রত্যাবর্তন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে তাঁর প্রশাসনের নীতির রূপরেখা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
ইতিহাস বলে, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা তাঁদের দ্বিতীয় মেয়াদে আরও উচ্চাভিলাষী হন। আর এমনটা যদি এ বারও ঘটে, তা হলে ট্রাম্প ২.০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন নীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এর কারণ হল, তাঁর প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প বেজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের মৌলিক সম্পর্কের পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিকাশ ঘটে। ট্রাম্প ডি-কাপলিং বা বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার অর্থ দুই দেশের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করা।
চিন স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির শর্তাবলির অধীনে, এটি মার্কিন পণ্যের ক্রয় বাড়ানো, মেধা সম্পত্তি সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বেশি বাজারের প্রবেশাধিকার দিতে সম্মত হয়েছিল।
তিনি বাণিজ্য, ভূ-রাজনীতি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করারও চেষ্টা করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চিনা আমদানির উপর শুল্ক আরোপ করার দরুন চিন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। চিন স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির শর্তাবলির অধীনে, এটি মার্কিন পণ্যের ক্রয় বাড়ানো, মেধা সম্পত্তি সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বেশি বাজারের প্রবেশাধিকার দিতে সম্মত হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন শি জিনপিংয়ের চিনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ভাবে, জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ সর্বোপরি হয়ে ওঠে এবং এর ফলে সংবেদনশীল খাতে চিনা বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা, হুয়াই এবং জেডটিই-র মতো চিনা সংস্থাগুলির উপর বিধিনিষেধ এবং টেলিকম নেটওয়ার্ক, সেলফোন অ্যাপ বাস্তুতন্ত্র এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এ চিনা প্রভাব মোকাবিলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন চিনে সংবেদনশীল প্রযুক্তি, বিনিয়োগ ও মানব পুঁজির প্রবাহকে সঙ্কুচিত করে এই ভিত্তি তৈরি করেছে। এটি অর্ধপরিবাহীগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার পাশাপাশি তার মিত্রদেরও ধরে রাখতে চাইছে। যেহেতু শি-র চিন বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো প্রযুক্তির ফলে অনেক সঞ্চয় করেছে, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করে চিনের উপর পাল্টা আঘাত হানতে চাইছে। এ ভাবে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট প্রশাসন জুড়ে এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে, যেটিকে চিন নিয়ন্ত্রণমূলক বলে মনে করছে।
প্রচারাভিযানের সময়ে ট্রাম্প উৎপাদন ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন এবং শি-র নেতৃত্বে চিনের সেই উৎপাদনের উদ্যোগকে খর্ব করতে চেয়েছিলেন, যা উন্নত তথ্য প্রযুক্তি, উচ্চসম্পন্ন সংখ্যাসূচক নিয়ন্ত্রণমূলক যন্ত্রপাতি, রোবোটিক্স, বিমান চলাচলের সরঞ্জাম, সামুদ্রিক প্রকৌশল প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক রেল সরঞ্জাম, শক্তি-সাশ্রয়ী যানবাহন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কৃষি যন্ত্রপাতি, বায়োফার্মাসিউটিক্যালস এবং উচ্চ-কার্যক্ষমতা সম্পন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আধিপত্য তৈরি করতে চায়। তিনি চিনা পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্পের চিন সংক্রান্ত ধারণাটিও এই ধারণা দ্বারা আকার পেয়েছে যে, কোভিড-১৯-এর শি-র অব্যবস্থাপনা ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের কারণ হয়েছিল। এই বিরক্তি একটি চাপানউতোরমূলক সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা ও অবনতিশীল সম্পর্ক মার্কিন সংস্থাগুলির জন্য একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসাবে বেজিংয়ের আকর্ষণ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
চিনের জন্য ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন চিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। শি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, প্রশাসনিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করা হতে পারে; এই ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যেও অনুরণিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা অনুমান করছেন যে, দেশটি প্রায় ৫%-এর উদ্দিষ্ট মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন না-ও করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা ও অবনতিশীল সম্পর্ক মার্কিন সংস্থাগুলির জন্য একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসাবে বেজিংয়ের আকর্ষণ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। চিনে পরিচালিত ইউরোপীয় শিল্পগুলি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, বিনিয়োগকৃত মূলধনের অনুপাতে মুনাফার হ্রাস চিনা বাজারে পরিচালনার ঝুঁকিকে ন্যায্যতা দেয় না। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, চিনা বাজারে সমস্যাগুলি অমীমাংসিতই থাকবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রক সমস্যা, সরকারি সংগ্রহে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসার অগ্রাধিকার, বাজারে প্রবেশে বাধা এবং অতিরিক্ত ক্ষমতার কারণে চিনে বিনিয়োগ করার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলি চিন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
ভারতের উচিত এ হেন মন্থনটিকে নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগানো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই সকল নেতার মধ্যে প্রথম, যিনি ট্রাম্পের বিজয়ের পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে ফের কাজে লাগাতে চান মোদী। এখন প্রশ্ন হল, ভারত কি আরও বেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চিনের প্রতি পশ্চিমীদের বিতৃষ্ণাকে কাজে লাগাতে পারে? ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদে সামরিক সহযোগিতার বিকাশ ঘটেছিল, যা একাধিক ভিত্তিগত চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সুস্পষ্ট। যখন ভারত ও চিন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর সামরিক সংঘাত মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন দিল্লিকে অবশ্যই তার প্রতিরক্ষা-শিল্পের উন্নতি ঘটাতে হবে যাতে, ভারত নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য ছিল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ‘ক্ষুদ্রপাক্ষিক’-এর উত্থান। ট্রাম্পের অধীনে ২০১৭ সালে কোয়াড পুনরুত্থিত হয়েছিল। যখন পাকিস্তানের অবনমন ঘটছে এবং কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন ভারতকে অবশ্যই ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে, যিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে ভারতীয় উদ্বেগের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। ভারতের প্রতিবেশী এলাকায় ওয়াশিংটন এবং নয়াদিল্লির মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা হতে পারে, যেখানে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বিভাজন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.