এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ভারত ও চিনের মধ্যে দু’টি বৈঠক হলেও দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া সম্ভব নয়। বৈঠকের পর এ কথা স্পষ্ট যে, দুই দেশের সম্পর্কে কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি।
প্রথম বৈঠকটি ছিল ভারত-চিন কোর কম্যান্ডার স্তরের আলোচনা, যা ২৩ এপ্রিল সীমান্তের অচলাবস্থা মোকাবিলার জন্য আয়োজিত হয়েছিল। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮তম বৈঠকটি শেষ বৈঠকের প্রায় চার মাস পর অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বৈঠকটি ছিল ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং চিনা সমকক্ষ জেনারেল লি শাংফুর মধ্যে, যিনি ২৭-২৮ এপ্রিল সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন-এর (এসসিও) প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন।
সীমান্তে সামরিক কম্যান্ডারদের বৈঠকের বিষয়ে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সাংবাদিক বিবৃতি এবং আড়ালে-থাকা অফিসারদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভারত ও চিন তাদের সামরিক বাহিনীর ব্যবহার বিরত রাখা থেকে শত যোজন দূরে রয়েছে। দুই দেশের বাহিনীই গত তিন বছর ধরে অভূতপূর্ব শক্তি এবং উচ্চ সতর্কতা-সহ সীমান্তে বহাল হয়েছে। সামরিক আলোচনার বিষয়ে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সাংবাদিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, উভয় পক্ষ ‘সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি খোলাখুলি এবং গভীর আলোচনা’ করেছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, সামরিক আলোচনার সময় দুই পক্ষ ‘প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাব’ বিনিময় করেছে এবং ভারতীয় পক্ষ ‘কৌশলগত ভাবে অবস্থিত ডেপসাং বালজ এলাকা এবং ডেমচকের চার্ডিং নিংলুং নালা (সিএনএন) ট্র্যাক জংশনে বাহিনী ব্যবহার বিরত রাখার জন্য চাপ দিয়েছে, যা সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র পূর্ব লাদাখে ৫০,০০০ সেনা মোতায়েন করা থেকে বিরত থাকতে ও উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।
অন্য একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, বৈঠকটি ‘পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর ডেপসাং সমভূমির বিতর্কিত বিষয়ে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ভারতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংস্থার সূত্রগুলিও গণমাধ্যমকে জানিয়েছে যে, বর্তমান পর্যায়ে ‘কোনও অগ্রগতি’ই হয়নি। ভারতীয় পক্ষ এলএসি বরাবর উত্তেজনা হ্রাস এবং ‘ডেপসাং সমভূমিতে উত্তেজনা কমানোর’ জন্য চাপ দিয়েছিল।
সরকারি সূত্রের কথা উল্লেখ করে অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘ডেপসাং সমভূমি এবং ডেমচকের মতো এলএসি বরাবর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।’ সামরিক পর্যায়ের আলোচনায় ‘আত্মবিশ্বাস তৈরির পদক্ষেপ এবং আগামী মাসে সীমান্তে সংঘর্ষ এড়ানো’র উপর নজর দেওয়া হয়েছিল। আত্মবিশ্বাস তৈরির পদক্ষেপগুলি সংঘাত কমাতে কার্যকর হলেও এ ক্ষেত্রে বোঝাপড়া বা চুক্তি বা প্রতিশ্রুতির অভাব ছিল না, যা গলওয়ান সংঘাতের দিকে চালিত করেছিল। এ কথা স্পষ্ট নয় যে, স্থিতাবস্থায় ফিরে যেতে বা সংঘাতের সম্ভাবনা কমানোর জন্য আরও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে কি না।
সামরিক পর্যায়ে আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ার পর সকলেরই নজর ছিল ২৭ এপ্রিল রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের দিকে। দুই মন্ত্রী যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেননি, বরং তাঁরা বৈঠক সংক্রান্ত নিজ নিজ স্বাধীন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, যা আলাপ-আলোচনার আসল গতিপ্রকৃতিকেই দর্শায়।
ভারতীয় বিবৃতি অনুসারে, ভারতের মন্ত্রী বলেছিলেন যে, ‘এলএসি-তে সকল সমস্যা বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি অনুসারে সমাধান করা দরকার।’ আরও স্পষ্ট ভাবে রাজনাথ সিং ‘পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, বিদ্যমান চুক্তির লঙ্ঘন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সম্পূর্ণ ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছে’ এবং ‘সীমান্তে সেনার উপস্থিতি হ্রাস যৌক্তিক ভাবে ডি-এস্কেলেশনকে ত্বরান্বিত করবে।’ মন্ত্রী এই শর্তও দর্শান, ‘ভারত-চিন সম্পর্কের বিকাশ সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে’, যে বিষয়টির উপর গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় পক্ষ থেকে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বারবার একই কথা জানিয়েছেন।
অন্য দিকে, চিনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক বিবৃতি থেকে মনে করা হচ্ছে, বৈঠকটি আর পাঁচটি সাধারণ বৈঠকের মতোই সংঘটিত হয়েছে। এটিতে দাবি করা হয়েছে যে, ‘প্রধান প্রতিবেশী দেশ এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে চিন এবং ভারতের মধ্যে বিপরীত মনোভাবের চেয়ে অভিন্ন সাধারণ স্বার্থের পরিমাণ অনেক বেশি।’ লি বলেন যে, ভারত ও চিনের ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং একে অপরের উন্নয়নকে একটি ব্যাপক, দীর্ঘমেয়াদি এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা উচিত’ এবং উভয় দেশই ‘আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য যৌথ ভাবে জ্ঞান এবং শক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।’ উল্লেখযোগ্য ভাবে, তিনি ভারত-চিন সীমান্তের পরিস্থিতিকে ‘সাধারণত স্থিতিশীল’ বলে দাবি করেন এবং বলেন, উভয় পক্ষই কূটনৈতিক এবং সামরিক… দুই মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রেখেছে।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, চিন সীমান্ত প্রসঙ্গকে আমল না দেওয়া ও সম্পর্কের অন্য দিকগুলিতে মনোনিবেশ করার পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি করছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে যে, দুই দেশের ‘দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমান্ত প্রসঙ্গটিকে একটি উপযুক্ত অবস্থানে রাখা উচিত এবং সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা উচিত।’ চিন স্পষ্টতই সীমান্ত সংঘর্ষের মীমাংসা করার জন্য কোনও তাড়াহুড়ো দেখাচ্ছে না এবং বৃহত্তর সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে রাখার জন্য ভারতের কৌশল তার উপর কোনও প্রভাব ফেলছে না।
এলএসি বরাবর যে কয়েকটি স্থানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে, সেখানে সাঁজোয়া এবং কামানের সরঞ্জামে সজ্জিত উভয় পক্ষেরই ৫০,০০০-৬০,০০০ সৈন্য-সহ বৃহৎ আকারের সেনা মোতায়েন অব্যাহত রয়েছে। এ হেন পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষের সম্ভাবনা ছাড়াও স্থানীয়রা অঞ্চলগুলি বেদখলের অভিযোগ তুলছেন। লাদাখ পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদে চুশুলের প্রতিনিধিত্বকারী স্থানীয় রাজনীতিবিদ কনচোক স্ট্যানজিনের মতে, এই শীতকালে ‘ফুর্তসগ কার্পো, ফুরস্তুগ নাকপো, হেলমেট টপ, গুরুং হিল, মাগার হল, রেজাং লা, রিচেন লা এবং মুকপা রে কার্যত নাগালের বাইরে ছিল।’ তিনি কথিত ভাবে একটি জার্নালে বলেছেন যে, ‘এই স্থানগুলির বেশির ভাগই ২০২০ সালের অগস্ট মাসে একটি আক্রমণাত্মক অভিযান (অপারেশন স্নো লেপার্ড) চলাকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে ছিল, কিন্তু পিএলএ-এর সঙ্গে প্যাংগং সো সংক্রান্ত বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন তা ছেড়ে দিতে হয়।’ তিনি দাবি করেন যে, ‘এটি জীবিকা নির্বাহের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কারণ স্থানীয় জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই গবাদি পশুর উপর নির্ভরশীল। তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।’ ভারতের সঙ্গে চিন যে আক্ষরিক ভাবেই সন্তর্পণে ধীরে ধীরে স্বল্প পরিমাণে অঞ্চল দখলের কৌশল গ্রহণ করেছে, তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় মানুষদের।
ভারত ও চিনের মধ্যে সীমান্ত প্রসঙ্গে কোনও অগ্রগতি লক্ষ না করার দরুন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক পরিকাঠামোগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। মার্চ মাসের শুরুতে রাজনাথ সিং সমস্ত অংশীদারদের মধ্যে একটি বৈঠক আহ্বান করেন, যাতে শীর্ষ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান, এয়ার চিফ মার্শাল ভি আর চৌধুরী এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পাণ্ডে-সহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন। উত্তরাখণ্ড, লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশ-সহ চিনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে এমন ভারতীয় রাজ্যগুলির সরকারি কর্মকর্তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটিতে লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত পরিকাঠামো উন্নয়নের উপর মনোনিবেশ করে, বাস্তব সংযোগ এবং যোগাযোগ শৃঙ্খলের সংযোগসূত্র-সহ এই অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের জন্য আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা চালানোর কথা বলা হয়। উভয় পক্ষই দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.