মলদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চিরাচরিত ধারা মেনেই ঘটেছে যেখানে প্রতিটি নির্বাচন একটি নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য নয়া সুযোগ প্রদান করে। মলদ্বীপের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম ছিল না, যেখানে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের মোহাম্মদ মুইজ্জু – যা কিনা প্রোগ্রেসিভ পার্টি অব মলদ্বীপ (পিপিএম) এবং পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর (পিএনসি) একটি জোট - মলদিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) ক্ষমতাসীন মোহাম্মদ ইব্রাহিম সোলি-কে পরাজিত করেন। দেশটির বিদেশনীতি এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য মুইজ্জুর বিজয় কী অর্থ বহন করে, তা নিয়ে কৌতূহল বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর জয় চিনকে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ প্রদান করতে পারে। যদিও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা এবং ভারত ও চিনের মধ্যে পদ্ধতিগত প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি কূটনৈতিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিতে হবে।
প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স তার জাতীয়তাবাদী আদর্শ, ভারতের সঙ্গে নেতৃস্থানীয়ের মতপার্থক্য এবং দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিকতার প্রতি বিরোধের দরুন চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভারত মহাসাগর নিয়ে এই উদ্বেগ মলদ্বীপের বিদেশনীতির ক্রমবর্ধমান পক্ষপাতমূলক প্রকৃতি থেকেই উদ্ভূত। এমডিপি ভারতকে একটি চিরাচরিত অংশীদার এবং গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবেই মনে করে, যে দেশটি ভৌগোলিক ভাবে দ্বীপরাষ্ট্রের কাছাকাছি অবস্থিত এবং নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটিকে সহায়তা করার কাজে এক পক্ষপাতবিহীন অংশীদারের ভূমিকা পালন করেছে। অন্য দিকে, প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স তার জাতীয়তাবাদী আদর্শ, ভারতের সঙ্গে নেতৃস্থানীয়ের মতপার্থক্য এবং দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিকতার প্রতি বিরোধের দরুন চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনের অধীনে (২০১৩-২০১৮) মলদ্বীপ চিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেশটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ (বিআরআই) যোগদান করেছে, ব্যাপক হারে ঋণ গ্রহণ করেছে, দ্বীপগুলিকে লিজ (বা দ্বীপ ব্যবহার করার অনুমতিপত্র) দিয়েছে, একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) স্বাক্ষর করেছে এবং চিনের সঙ্গে একটি যৌথ সমুদ্র পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ওশন অবজার্ভার সেন্টার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্ববর্তী মাসগুলিতে ইয়ামিন নয়াদিল্লিকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার দোষে অভিযুক্ত করেছিল এবং দিল্লির তরফে মালেকে উপহার দেওয়া হেলিকপ্টারগুলি ফিরিয়ে নিতে বলে। ইয়ামিনের উত্তরসূরি এমডিপি-র ইব্রাহিম সোলি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। তাঁর ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি নয়াদিল্লির সঙ্গে দেশের উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের বৃদ্ধি ঘটানোর পাশাপাশি ভারতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর চিনা প্রকল্পগুলি এড়িয়ে যায়। উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ৫০টিরও বেশি সম্প্রদায়ের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে এবং এমনকি গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট শুরু করেছে। প্রতিরক্ষার নিরিখে ভারত উথুরুথিলা ফালহুতে একটি নৌবন্দর নির্মাণ করছে, হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা পরিচালনা করছে এবং একটি ডর্নিয়ার বিমান প্রেরণ করেছে।
উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ৫০টিরও বেশি সম্প্রদায়ের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে এবং এমনকি গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট শুরু করেছে।
প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অবশ্য তার ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারের মাধ্যমে এই নীতির সমালোচনা করেছে। সমাবেশ, গুজব এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রচারটি ভারতের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নমূলক সহায়তাকে রাজনীতিকরণ করেছে, জাতীয়তাবাদী আবেগকে তীব্রতর করেছে এবং ভারত ও এমডিপি সরকারকে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। এই প্রচার মুইজ্জুকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাঁর প্রথম বক্তৃতায় মুইজ্জু জোর দিয়েছিলেন যে, তিনি ‘মলদ্বীপপন্থী’ নীতি বজায় রাখবেন এবং ভারত থেকে ব্যাপক ভাবে ঋণ নেওয়ার জন্য সরকারের সমালোচনাও করেন। তিনি আবারও বলেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে চুক্তিগুলির পর্যালোচনা করবেন এবং কূটনৈতিক শৃঙ্খলের মাধ্যমে মলদ্বীপ থেকে সমস্ত বিদেশি (পড়ুন ভারতীয়) সৈন্যদের সরিয়ে দেবেন। ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে তাঁর প্রথম বৈঠকে মুইজ্জু আবার সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এবং ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। দলের উপর ইয়ামিনের শক্ত অবস্থানের অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা এবং তাঁর নির্বাচনী এলাকাকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে মুইজ্জু সম্ভবত কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারেন। অন্য দিকে, চিনপন্থী সরকারের বিজয় বেজিংকে নতুন সুযোগের পরিসর প্রদান করেছে। মলদ্বীপ ভারত মহাসাগর এবং বিবর্তিত ইন্দো-প্যাসিফিক ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। দেশটি সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক শৃঙ্খল দ্বারা বেষ্টিত এবং কৌশলগত ভাবে ভারত ও দিয়েগো গার্সিয়ার মধ্যে অবস্থিত, যা একটি সামরিক ঘাঁটি এবং সামুদ্রিক নজরদারি পরিচালনার জন্য একটি পছন্দসই বিকল্পে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের নিরিখে চিন গত পাঁচ বছর যাবৎ দৃশ্যত বিচলিত থেকেছে, যখন ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মলদ্বীপে নিজেদের জায়গা সুদৃঢ় করেছে। বেজিং সম্ভবত এই সুযোগটি ব্যবহার করে মলদ্বীপ এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার প্রভাব পুনরুদ্ধার করবে। মুইজ্জু ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে সঙ্গে বেজিং বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলিতে তার সমর্থন পুনরায় চালু করতে পারে, এফটিএ-র পুনরায় সূচনা করতে পারে এবং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রসার ঘটাতে পারে।
এই ধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের নিরিখে চিন গত পাঁচ বছর যাবৎ দৃশ্যত বিচলিত থেকেছে, যখন ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মলদ্বীপে নিজেদের জায়গা সুদৃঢ় করেছে।
তার মানে এই নয় যে, ভারত সে দেশে তার জমি হারিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই প্রথম নেতা, যিনি মুইজ্জুকে তাঁর বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের একজোটে কাজ করার সদিচ্ছার ইঙ্গিত দেন। একই ভাবে প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের শীর্ষ নেতৃত্ব এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বিদেশ সফরের জন্য ভারতই সম্ভবত মুইজ্জুর প্রথম গন্তব্য এবং একটি পছন্দসই অংশীদার হতে পারে। অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য সত্ত্বেও মলদ্বীপের কাছে এই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, ভারতই এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তামূলক অংশীদার এবং মালের অপ্রতুল সামুদ্রিক নজরদারি ক্ষমতা ও দক্ষতা পূরণ করতে পারে। এ কথা মোটেও কাকতালীয় নয় যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সবচেয়ে কঠিন পর্যায়েও ইয়ামিন ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। এ ছাড়াও ভারত মলদ্বীপের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, রফতানির একটি শীর্ষ গন্তব্য এবং একটি চিরাচরিত দাতাদেশও বটে। এ ছাড়া, শ্রীলঙ্কার সঙ্কট নবাগত সরকারকে ঋণ পুনর্গঠন ও আর্থিক সহায়তার জন্য চিনের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করার বিষয়েও সতর্ক করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের কাছে মালের ঋণ পরিষেবার পাশাপাশি বৈদেশিক ভাণ্ডারও ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। তাই মলদ্বীপ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে।
ভারত মলদ্বীপের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, রফতানির একটি শীর্ষ গন্তব্য এবং একটি চিরাচরিত দাতাদেশও বটে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আদর্শগত এবং অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার কারণে মুইজ্জু চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে প্রলুব্ধ হতে পারেন। তবে তিনি আরও ক্ষমতা প্রকাশে এবং দেশের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূ-রাজনৈতিক দলাদলির সুযোগ নিতে দ্বিধা করবেন না। ভারত ও চিনের মধ্যে প্রতিযোগিতা কোনও নির্বাচন বা একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উভয় দেশই এই অঞ্চলে একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার এবং একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাবে। তার দিক থেকে ভারত নিজের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা এবং দিল্লির বিরুদ্ধে গিয়ে বেজিংকে সহায়তা করার প্রবণতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছে। ভারতও মলদ্বীপ প্রশাসনের সঙ্গে বাস্তববাদী এবং নমনীয় মনোভাব পোষণ করতে পারে, যত দিন পর্যন্ত নবাগত সরকার ভারতের সংবেদনশীলতা এবং নিরাপত্তামূলক উদ্বেগকে সম্মান করে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.