পূর্ব লাদাখে টহল সংক্রান্ত ব্যবস্থার বিষয়ে চিন-ভারত চুক্তি নয়াদিল্লির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ২০২০ সালে চিনা পদক্ষেপের শুরু থেকে – ছ’টি বিন্দুতে অবরোধ স্থাপন এবং সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি - ভারত একটি পরিমিত পদ্ধতিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে। এক দিকে, ভারত অবরুদ্ধ বিন্দুগুলিতে চিনের মোকাবিলা করেছে এবং সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে, যা আক্রমণাত্মক অভিপ্রায়ের পরিবর্তে একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাকেই দর্শায়। অন্য দিকে, ভারত দৃঢ় ও অবিচলিত কূটনীতির মাধ্যমে বেজিংকে তার আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য চাপ দিয়েছে।
এ ভাবে এবং স্পাংগুর সো-মুখী কৈলাস পর্বত দখল করে সামরিক চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে নয়াদিল্লি ২০২২ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ছ’টি অবরোধ বিন্দুর মধ্যে চারটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই বিন্দুগুলিকে বাফার জোনে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, যেখানে কোনও পক্ষই আর টহল দেবে না। ডেপসাং বালজ এবং ডেমচকের চার্ডিং নালায় দু’টি অবরোধ বিন্দু কঠিনতর বলে প্রমাণিত হয়েছে। দু’বছর ধরে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাতেও সুফল মেলেনি। তার পর হঠাৎই কয়েক মাস আগে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং কূটনৈতিক উদ্যোগের পরে এমন এক মীমাংসায় পৌঁছনো গিয়েছে, যেগুলি অন্যান্য অবরোধ বিন্দু সংক্রান্ত আলোচনার ঊর্ধ্বে।
সম্প্রতি নয়াদিল্লির কর্মকর্তাদের বিবৃতি দর্শায় যে, চিন ও ভারত ডেপসাং বালজ এবং চার্ডিং নালার সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে।
সম্প্রতি নয়াদিল্লির কর্মকর্তাদের বিবৃতি দর্শায় যে, চিন ও ভারত ডেপসাং বালজ এবং চার্ডিং নালার সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে। ২১ অক্টোবর ঘোষিত চুক্তিটি একটি বহু-স্তরীয় পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে, যা বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকরী হতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ অনুযায়ী, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে একটি শীর্ষ সম্মেলনের সময় বলেছিলেন যে, ‘চিনের সঙ্গে সংঘাত সমাপ্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।’ বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি একটি বিবৃতির মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে, ‘ভারত-চিন সীমান্ত এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর টহল ব্যবস্থার বিষয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে।’ দুই ব্যক্তিত্বই বলেছিলেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে পূর্ব লাদাখে ২০২০ সালে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার সমাধান করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর সূত্র দর্শিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘সোমবার কোর কম্যান্ডার পর্যায়ে বিচ্ছিন্নকরণের পাশাপাশি টহল দেওয়ার পদ্ধতির রূপরেখা নিয়ে একটি বিশদ চুক্তি সমাপ্ত হয়েছে।’ ফলস্বরূপ, দ্রুতই চিনা অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে এবং উভয় পক্ষই ডেপসাং বালজ এবং ডেমচকে সমন্বিত ভাবে টহল শুরু করবে। তাই ডেপসাং-এ, তথাকথিত ওয়াই-জংশনে অবরুদ্ধ ভারতীয় পক্ষ এখন পিপি১০, ১১, ১১এ, ১২ এবং ১৩-তে টহল দিতে সক্ষম হবে, যেখানে তারা ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে আর টহল দিতে সক্ষম ছিল না। চিন অবশ্য কোন নির্দিষ্ট এলাকায় টহল দেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
চিত্র ১. ডেপসাং অবরোধ
উত্স: লেখকের নিজস্ব, গুগল আর্থ ইমেজের মাধ্যমে তৈরি
এ কথা বলা জরুরি যে, অক্টোবর মাসের শেষে শুরু হওয়া টহলদারিতে দুই পক্ষই নজর রাখবে এবং খেয়াল রাখবে যাতে সেনারা কোনও ভাবেই মুখোমুখি না আসে। সূত্র অনুযায়ী, ‘টহল এমন ভাবে দেওয়া হবে, যাতে কখনওই দুই পক্ষ সামনাসামনি না আসে।’ অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চুক্তিটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষ পূর্বনির্ধারিত ছাউনি ও তাঁবুগুলি ভেঙে ফেলতে শুরু করে, যেগুলি যানবাহন এবং সেনাদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় এবং চিনা সেনাদের ২৮-২৯ অক্টোবরের মধ্যে দু’টি ক্ষেত্রে তাদের অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসার কথা।
২০২০ সালে চিন ছ’টি স্থানে ভারতকে অবরোধ করেছিল এবং সেগুলি হল প্যাংগং সো-র উত্তর তীর, গোগরা পোস্টের কাছে পিপি১৭এ, পিপি১৫-র গোগরা-হটস্প্রিংস এলাকা, গলওয়ান নদী (পিপি১৪), ডেপসাং বালজ ও চার্ডিং নালার মধ্যে ওয়াই-জাংশন।
২০২০ সালে চিন ছ’টি স্থানে ভারতকে অবরোধ করেছিল এবং সেগুলি হল প্যাংগং সো-র উত্তর তীর, গোগরা পোস্টের কাছে পিপি১৭এ, পিপি১৫-র গোগরা-হটস্প্রিংস এলাকা, গলওয়ান নদী (পিপি১৪), ডেপসাং বালজ ও চার্ডিং নালার মধ্যে ওয়াই-জাংশন। শেষ দু’টি বাদে, অন্য সমস্যাগুলি ২০২০ সালের জুলাই মাসে (গলওয়ান) এবং ২০২২ সালের জুলাই মাসে পিপি ১৫ অঞ্চল সংক্রান্ত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অঞ্চলগুলিতে উভয় পক্ষই ৩-১৯ কিলোমিটার গভীরতার মধ্যে বিভিন্ন বাফার জোন তৈরি করেছে এবং সেই অংশ কোনও পক্ষই টহল দিতে পারেনি। বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী বিচ্ছিন্নতা এবং টহল… উভয়ই সম্পৃক্ত। অন্য ভাবে বলতে গেলে, ডেপসাং বালজ এবং চার্ডিং নালায় চুক্তিটি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং চিনা অবরোধগুলি সরানো হয়েছে। এটি অন্যান্য অবরোধ বিন্দু সংক্রান্ত পদক্ষেপ থেকে পৃথক, যা বর্তমানে ‘টহলবিহীন’ বাফার জোন হিসাবে থাকবে।
কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার পুরো সময়কালে ভারত জোর দিয়েছিল যে, প্রথমে ‘যুদ্ধবিরতি’ এবং পরে ‘উত্তেজনা হ্রাস’-এর মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি যেন সম্পন্ন করা হয় এবং তার পরে এই অঞ্চলে আনা অতিরিক্ত বাহিনীকে ‘অপসারণ’ করা হয়। যাই হোক, এই চুক্তিটিকে এক ধরনের অগ্রগতিই বলা চলে। কারণ এই চুক্তিটি আসলে ২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ডেপসাং বালজ এবং চার্ডিং নালা এলাকায় যে স্থিতাবস্থা ছিল, তা পুনরুদ্ধার করারই সমান। সমস্যাজনক অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও অনুরূপ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলে ভারত এবং চিন এলএসি বরাবর স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা পুনরায় চালু করতে পারে।
ভারত ও চিন ব্যাপক ভাবে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৫ এবং ২০১২ সালের একগুচ্ছ আত্মবিশ্বাস-নির্মাণ চুক্তির সাহায্যে এলএসি বরাবর শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল, যা মূলত এলএসি বরাবর তাদের সামরিক আচরণ নির্ধারিত করেছিল।
তবে অতীতের অবস্থায় ফিরে যাওয়া এত সহজ কাজ নয়। ভারত ও চিন ব্যাপক ভাবে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৫ এবং ২০১২ সালের একগুচ্ছ আত্মবিশ্বাস-নির্মাণ চুক্তির সাহায্যে এলএসি বরাবর শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল, যা মূলত এলএসি বরাবর তাদের সামরিক আচরণ নির্ধারিত করেছিল। ১৯৯৬ সালের সিবিএম চুক্তির মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে গলওয়ান সংঘর্ষে বন্দুক ব্যবহার না করে লাঠি ও পাথরের লড়াই হয়েছিল। তা সত্ত্বেও চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি চিনারা লঙ্ঘন করেছে।
আধিকারিকদের মন্তব্যে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, চুক্তির উপাদানগুলি পূর্বের দিকে ইয়াংৎসের মতো অঞ্চলেও প্রসারিত করা যেতে পারে, যেখানে ভারতীয় ও চিনা সেনারা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। সর্বোপরি সমন্বিত টহল দেওয়ার মতো উদ্ভাবন - যা প্রথম বার পূর্ব অংশে চালু করা হয়েছিল - এ বার অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে যেখানে ভারত ও চিনের অভিন্ন সাধারণ দাবি রয়েছে এবং তাই উভয়েই সেই অঞ্চলে টহল দিতে চায়।
আস্থা পুনরুদ্ধারের মধ্যেই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি নিহিত। চুক্তির ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছিলেন যে, চুক্তির মূল বিষয়টি হল দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিশ্বাস’ পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব। ২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ভারতকে এর পরে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যুদ্ধবিরতি, উত্তেজনা হ্রাস এবং স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা’র বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। এটি বেশ কিছুটা সময় ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে করা হবে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ভারতকে এর পরে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যুদ্ধবিরতি, উত্তেজনা হ্রাস এবং স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা’র বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
যুদ্ধবিরতি, তীব্রতা হ্রাস ও সেনা অপসারণ প্রক্রিয়া শান্তির দিকে চালিত করলেও বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে আরও সময় লাগবে। এমনটা করার জন্য অতীতের সিবিএম চুক্তিগুলির পুনর্গঠন এবং পুনর্লিখনের প্রয়োজন হতে পারে। অক্টোবরের শেষে কাজানে মোদী-শি বৈঠকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল এই যে, তাঁরা চিন-ভারত সীমান্ত ইস্যুতে তাঁদের বিশেষ প্রতিনিধিদের (এসআর) অর্থাৎ এনএসএ অজিত ডোভাল এবং তাঁর চিনা প্রতিপক্ষ বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই–কে দ্রুত সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এসআর-এর শেষ বৈঠকটি ২০১৯ সালে হয়েছিল। আশা করা হচ্ছে যে, এই বিশেষ প্রতিনিধিরা চিন-ভারত পুনর্মিলনের প্রক্রিয়াকে অভিমুখ দেবেন, যা আগামী সময়ে তাদের সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের অবসান ঘটাবে।
মনোজ জোশি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.