বিশ্বক্রম বিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শক্তিগুলি প্রতিক্রিয়া হিসাবে নিজেদের নীতিগুলির পুনর্মূল্যায়ন করছে। আন্তর্জাতিক শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে অভ্যন্তরীণ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হওয়ার কারণে পশ্চিমী দেশগুলি অভ্যন্তরীণ ভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, এমনকি আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। চিনকে পশ্চিমী শক্তি এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হিসাবে মনে করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিশ্চিত করেছে যে, বেশির ভাগ পশ্চিমী প্রচেষ্টা এবং সংস্থান বর্তমানে ইউরোপীয় পরিধির মধ্যেই একটি সঙ্কট ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপীয় নীতি অভিজাতদের চেতনায় রাশিয়া আবারও একটি গুরুতর হুমকি হিসাবে ফিরে এসেছে।
আন্তর্জাতিক শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে অভ্যন্তরীণ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হওয়ার কারণে পশ্চিমী দেশগুলি অভ্যন্তরীণ ভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, এমনকি আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে।
পশ্চিমীরা প্রায় একই সময়ে রাশিয়া এবং চিনের মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে বেজিং এবং মস্কোর মধ্যে সম্পর্কও একটি ধীর অথচ স্থির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দুই দিনের চিন সফরের সময় জারি করা ৭০০০ শব্দের যৌথ বিবৃতিতে এটি যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যেখানে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘রুশ-চিন সম্পর্ক বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনের পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং শক্তি ও স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করছে এবং একই সঙ্গে উভয়েই তাদের দেশের ইতিহাসের সর্বোত্তম সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে।’ মে মাসের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন মেয়াদ শুরু করার পর পুতিনের প্রথম বিদেশ সফরের জন্য চিনকে বেছে নেওয়ার প্রতীকী অর্থ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। বেজিংয়ের উপর ইউক্রেন সঙ্কটের সময় থেকেই মস্কোর আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার অন্য দিকে পশ্চিমের জন্য এই ক্রমবর্ধমান সমন্বয়কে এক গুরুতর হুমকি বলে দেখা হচ্ছে।
‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্ব
ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তাঁর নিজের বেজিং সফরের সময় রাশিয়ার সঙ্গে চিনের ক্রমাগত সহযোগিতার বিষয়ে প্রকাশ্যে চিনকে সতর্ক করার কয়েক দিন পর পুতিনের এই সফরটি ঘটে। ব্লিঙ্কেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটির জন্য চিনের সমর্থন সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, এই সমর্থন অব্যাহত থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০০টিরও বেশি চিনা সংস্থা এবং ব্যক্তির উপর বর্তমান নিষেধাজ্ঞার বাইরে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। রাশিয়ার ট্যাঙ্ক, যুদ্ধাস্ত্র এবং সাঁজোয়া যানের বর্ধিত উৎপাদনের সুবিধার্থে পশ্চিমী রাজধানীগুলিতে চিনা সহায়তাকে একটি মূল কারণ হিসাবে দেখা হয়, যার ফলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত এবং ক্রমবর্ধমান সফল আগ্রাসন সক্ষম হয়েছে।
বেজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকের সময় পুতিন ও শি জিনপিং একটি ‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্ব ঘোষণা করার কয়েক সপ্তাহ পরে রাশিয়া ইউক্রেনে তার আক্রমণ শুরু করে। চিন তার দিক থেকে ইউক্রেন সংঘাতের প্রেক্ষিতে ক্রমাগত ভাবে নিরপেক্ষতার দাবি করে এসেছে এবং সংঘাতে নিজেকে একটি সম্ভাব্য শান্তি মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে এবং এমনটা চিন করেছে, যখন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। মে মাসে পুতিনের সফরের সময় বেজিং এবং মস্কো যৌথ মহড়া ও যুদ্ধ প্রশিক্ষণ বাড়ানো, নিয়মিত যৌথ সমুদ্র ও বিমান টহল পরিচালনা এবং তাদের ‘ক্ষমতা এবং যৌথ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য একটি রেজোলিউশন গ্রহণ করার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ ও হুমকি মোকাবিলায় সামরিক ‘আস্থা ও সহযোগিতা’ ‘গভীরতর’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পুতিনের প্রতিনিধি দলে প্রধান নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতাকেই দর্শায়।
চালকের আসনে চিন
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক সহযোগিতা এবং কৌশলগত সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন দেখা গিয়েছে। ‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্বের ঘোষণা পশ্চিমী প্রভাব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিহত করার জন্য তাদের পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষার উপর জোর দেয়। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চিন নিরপেক্ষতার দাবি করা সত্ত্বেও, পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দেশটি রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামরিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ রাশিয়ার উপর গুরুতর খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে এবং এর সামরিক ক্ষেত্রে ও অর্থনীতিতে দুর্বলতাকে প্রকাশ্যে এনেছে।
তবে এটি এখন এমন একটি সম্পর্ক, যেখানে চিন চালকের আসনে রয়েছে। ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ রাশিয়ার উপর গুরুতর খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে এবং এর সামরিক ক্ষেত্রে ও অর্থনীতিতে দুর্বলতাকে প্রকাশ্যে এনেছে। রাশিয়ার অর্থনীতি যখন পশ্চিমী স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, তখন অন্য দিকে চিন অর্থনীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক ঘটনাপ্রবাহের সামনে পড়ে পুনর্ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করেছে। পুতিন এমন একটি যুদ্ধের অর্থায়নে চিনের সাহায্য চাইছেন, যে যুদ্ধটি তাঁর হিসেবের বাইরে দীর্ঘায়িত হয়েছে। পুতিন শি-র প্রতি গুণমুগ্ধ এবং শি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে ‘ভাইয়ের মতো ঘনিষ্ঠ’ ও চিনের অর্থনীতিকে ‘দ্রুত গতিতে উন্নয়নশীল’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শি জিনপিং অবশ্য তাঁর মন্তব্যে অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন এবং সফরের সময় কোনও বড় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এই সফরের আড়ম্বর এবং পরিস্থিতির লক্ষ্য ছিল বেজিংয়ের অপ্রতিরোধ্য মনোভাবকে তুলে ধরা এবং দেখানো যে, বেজিং সাবধানতার সঙ্গে হলেও এমন এক নেতার ঘনিষ্ঠ হতে ইচ্ছুক, যিনি পশ্চিম দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে আকার দেওয়ার লক্ষ্যে এই অংশীদারিত্ব তাই অভিন্ন সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়। এই ক্রমবিবর্তিত সম্পর্কের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমী নীতির বিরুদ্ধে দেশ দু’টির সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণের প্রেক্ষাপটে।
ভারতের জন্য এক দোলাচলের অবস্থান
নয়াদিল্লির জন্য এই রাশিয়া-চিন অক্ষকে পরিচালনা করা আগামী বছরগুলিতে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে। এটি মৌলিক উপায়ে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। রুশ সামরিক শক্তির উপর ভারতের ক্রমাগত নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে ঘনিষ্ঠ চিন-রাশিয়া সম্পর্ক এই লেনদেনের শর্তাবলিকেও প্রভাবিত করতে পারে, সম্ভাব্য ভাবে উন্নত প্রযুক্তিতে ভারতের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে পারে অথবা সামরিক সহায়তার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে। এ ছাড়াও, জ্বালানি রফতানির জন্য রাশিয়া চিনের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ভারত রাশিয়ার তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে বর্ধিত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে, যা দাম এবং সরবরাহের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে।
রুশ সামরিক শক্তির উপর ভারতের ক্রমাগত নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে ঘনিষ্ঠ চিন-রাশিয়া সম্পর্ক এই লেনদেনের শর্তাবলিকেও প্রভাবিত করতে পারে, সম্ভাব্য ভাবে উন্নত প্রযুক্তিতে ভারতের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে পারে অথবা সামরিক সহায়তার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে।
উপরন্তু, একটি শক্তিশালী চিন-রুশ অর্থনৈতিক সমন্বয় আঞ্চলিক অবকাঠামো প্রকল্প এবং বাণিজ্য পথের নিরিখে ভারতকে পিছনে ফেলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে চিন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এবং ব্রিকস-এর মতো আঞ্চলিক মঞ্চে ভারতীয় প্রভাবকেও খর্ব করবে। এই উদীয়মান পুনর্বিন্যাসের ফলস্বরূপ আপাতদৃষ্টিতে বহুমুখী বিশ্বে নয়াদিল্লির পথ খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা পরীক্ষার মুখে পড়বে। একই সঙ্গে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার পাশাপাশি প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভারতের বিদেশনীতির একটি সতর্কতামূলক পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.