ভূ-রাজনীতি ভারতীয় রান্নাঘরের সংমিশ্রণে প্রভাব ফেলবে এমন আশা করা যায় না, কিন্তু ভারতে সূর্যমুখী তেলের ক্ষেত্রে এমনটাই মনে হয়। উদ্ভিজ্জ তেলের বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক হিসাবে, ভারত তার চাহিদার ৭০ শতাংশ আমদানি করে। পাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, নারকেল, জলপাই, জোজোবা ও সরিষার তেল বিভিন্ন দেশ ভারতে সরবরাহ করে। সবচেয়ে বড় উপাদান হল পাম তেল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসে, প্রাথমিকভাবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তাইল্যান্ড থেকে; সয়াবিন তেল মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ের মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ থেকে, এবং অল্প পরিমাণে রাশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া থেকে আসে; বাণিজ্য ঝুড়ির পরেরটি হল সূর্যমুখী তেল, যার বড় অংশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আসে।
পাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, নারকেল, জলপাই, জোজোবা ও সরিষার তেল বিভিন্ন দেশ ভারতে সরবরাহ করে।
২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইউক্রেন অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় ভারতে সূর্যমুখী তেল বেশি রপ্তানি করেছে, এবং বেশ বড় ব্যবধানে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর, ইউক্রেনের সূর্যমুখী তেলের মোট রপ্তানি পরের বছর ২০ শতাংশেরও বেশি কমে যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ, ভারতে ইউক্রেনের রপ্তানি ২০২১ সালে ১.৫ মিলিয়ন টন থেকে নাটকীয়ভাবে কমে ২০২২ সালে ৬৩৩,৬২৩ টন এবং ২০২৩ সালে মাত্র ৩৭৪,৬১৯ টন হয়েছে৷ ফলে সূর্যমুখী তেলের প্রচুর চাহিদা মেটাতে ভারত অন্য কোথাও দেখতে বাধ্য হয়েছিল৷ এই সময়ে আর্জেন্টিনার প্রবেশ ঘটে। ভারতে সয়াবিন তেলের নিয়মিত সরবরাহকারী আর্জেন্টিনা তার বেশিরভাগ সূর্যমুখী তেল ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে, বিশেষ করে প্রতিবেশী চিলি ও ব্রাজিলে রপ্তানি করত। ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার সূর্যমুখী তেলের মাত্র ১৪ শতাংশ ভারতে এসেছিল, আর বড় অংশ চিলি, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও পেরুতে রপ্তানি হয়েছে। ২০২২ সালে, ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর, আর্জেন্টিনা ভারতে ৪০৫,৫৭৩ টন সূর্যমুখী তেল রপ্তানি করেছিল, যা তার বিশ্বব্যাপী ৫১৯,৯০০ টন রপ্তানির প্রায় ৭৮ শতাংশ; ২০২৩ সালে, এই রপ্তানি বেড়ে ৫৪২,৩৬৬ টন হয়েছে। [১]
ভারতে সূর্যমুখী তেলের রপ্তানিতে আর্জেন্টিনার দ্রুত বৃদ্ধির গল্প অর্থনৈতিক কূটনীতির উদাহরণ। এটি আর্জেন্টিনার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত স্রোত। ভারত-আর্জেন্টিনা সম্পর্ক মতাদর্শ, রাজনীতি বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিয়ে ভারাক্রান্ত নয়। ফলে ব্যবসাই প্রাধান্য পায়। প্রকৃতপক্ষে, আর্জেন্টিনার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে অর্থনৈতিক কূটনীতির ভূমিকা এই প্রথম নয়। ২০১০ সালে, বুয়েনস আইরেস চিনা শিল্প পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করায় আর্জেন্টিনা চিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, এবং বেজিং আর্জেন্টিনার সয়াবিন তেল আমদানি বন্ধ করে প্রতিশোধ নেয়। মঞ্চের পাশে অপেক্ষা করছিল ভারত। একই বছরে, ভারত তার আর্জেন্টিনার সয়াবিন তেলের আমদানি প্রায় দ্বিগুণ করে ২০০৯ সালের ৬০০,০০০ টন থেকে ২০১০ সালে ১ মিলিয়ন টন করে, এবং তারপর কখনও পিছনে ফিরে তাকায়নি। প্রতি বছর ভারত সয়াবিন তেলের জন্য আর্জেন্টিনার বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসাবে থেকে গিয়েছে।
ভারত-আর্জেন্টিনা সম্পর্ক মতাদর্শ, রাজনীতি বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিয়ে ভারাক্রান্ত নয়।
যদিও আর্জেন্টিনার উদ্ভিজ্জ তেলের রপ্তানি এখনও ভারত-আর্জেন্টিনা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি, গত দুই দশকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মাউরিসিও ম্যাক্রির ভারত সফরের সময় ভারত ও আর্জেন্টিনা তাদের সম্পর্ককে 'কৌশলগত অংশীদারি' হিসাবে অভিহিত করেছিল। ভারতের বিদেশনীতির পর্যবেক্ষকদের কাছে এটা কিছুটা কষ্টকল্পিত মনে হয়েছিল—কারণ কৌশলগত শব্দটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা জার্মানির ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়—কিন্তু এটা খুব কম জানা সত্য যে ভারত ও আর্জেন্টিনার মধ্যে কার্যকরী সম্পর্ক রয়েছে প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক শক্তি, ও সাম্প্রতিককালে অতি-গুরুত্বপূর্ণ খনিজে। এর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনার বিমানবাহিনী এবং ভারতের হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) দ্বারা স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি, যেখানে পরেরটি আর্জেন্টিনাকে হেলিকপ্টার খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে এবং রক্ষণাবেক্ষণ পরিষেবা প্রদান করে। ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনা তার দাসাউ মিরাজ জেট বাতিল করার পর থেকে সেটি প্রতিস্থাপনের জন্য সংস্থা খুঁজছে, এবং ভারতের বহুমুখী যুদ্ধবিমান তেজস সম্ভাব্য সরবরাহকারীদের দৌড়ে রয়েছে। এ ছাড়া দৌড়ে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ এবং চিন ও পাকিস্তানের যৌথভাবে উৎপাদিত চেংডু/পিএসি জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক ৩। এই উন্নয়নগুলি ভারত ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ক্রমাগত প্রতিরক্ষা বিনিময়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়: উভয় দেশ নিয়মিতভাবে একে অপরের দূতাবাসে ডিফেন্স অ্যাটাশে রাখে, এবং ভারত আর্জেন্টিনা থেকে বেশ কিছু উচ্চ-পর্যায়ের সফর দেখেছে, যার মধ্যে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আর্জেন্টিনার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরও ছিল। তার আগে ২০২২ সালে আর্জেন্টিনার উচ্চস্তরের সামরিক কর্মকর্তারা দু’বার সফর করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে বিমান বাহিনীর প্রধান এবং আর্জেন্টিনার সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফও ছিলেন।
উভয় দেশের মহাকাশ সংস্থা, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) এবং আর্জেন্টিনার সিওএনএই, মহাকাশ সহযোগিতার জন্য একটি কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সিওএনএই-এর পরিচালক জুলাই ২০২৩-এর ভারত সফরের সময় বলেছিলেন, “আমরা ভবিষ্যতের এল-ব্যান্ড স্যাটেলাইটের ক্রমাঙ্কন ও বৈধকরণে সহযোগিতা করার সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করছি, যা ভারত নাসার সঙ্গে একত্রে তৈরি করছে, এবং সেইসঙ্গে লঞ্চ ভেহিকল-এর ক্ষেত্রটিতেও ।"
আর্জেন্টিনা ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্প্রসারণ চালিয়ে যেতে চায়। উভয় দেশ এই পথে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কূটনীতির আরও উদাহরণ দেখতে পাওয়া যাবে।
এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমাদের আর্জেন্টিনার বিদেশমন্ত্রী ডায়ানা মন্ডিনোর একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এবং সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে সাম্প্রতিক ভারত সফরকে দেখা উচিত। মন্ডিনোর দাবি আর্জেন্টিনার ব্রিকস গ্রুপে যোগদান না-করার সিদ্ধান্ত, যে কথাটি তাঁর সরকার ডিসেম্বর ২০২৩ সালে তাদের মেয়াদ শুরু করার পর থেকে পুনরাবৃত্তি করেছে, অবশ্যই ভারত-আর্জেন্টিনা সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। বিপরীতে, আর্জেন্টিনা ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্প্রসারণ চালিয়ে যেতে চায়। উভয় দেশ এই পথে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কূটনীতির আরও উদাহরণ দেখতে পাওয়া যাবে।
হরি শেষশায়ী অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন ভিজিটিং ফেলো এবং কনসিলিয়াম গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
[১] সমস্ত বাণিজ্য ডেটা https://www.trademap.org/ থেকে নেওয়া
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.