২২ ডিসেম্বর ভারতের তরফে ঘোষণা করে জানানো হয় যে, জানুয়ারি মাসে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, তাঁর আমন্ত্রণটি অল্প সময়ের মধ্যে ঠিক করা হয়েছিল। যাঁর প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল, অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওয়াশিংটন ডিসি-তে বার্ষিক স্টেট অব দি ইউনিয়ন ভাষণের কারণে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
শেষ মুহূর্তের অনুরোধ সত্ত্বেও ফরাসি প্রেসিডেন্টের তরফে এই নিশ্চিতকরণের বিষয়টি স্পষ্টতই এ কথার পুনরাবৃত্তি করে যে, ফ্রান্সই ভারতের একটি সর্বকালীন বন্ধু, যার উপর ভারত নির্ভর করতে পারে। ষষ্ঠ বারের মতো ফরাসি নেতা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হবেন। জাক শিরাক ফরাসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৬ সালে এবং ১৯৯৮ সালে আবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসাবে এই অনুষ্ঠান প্রধান অতিথি হয়েছিলেন। অন্য ফরাসি নেতাদের মধ্যে যথাক্রমে ১৯৮০, ২০০৮ এবং ২০১৬ সালে ভ্যালেরি গিসকার্ড ডে’ইস্তাইং, নিকোলাস সারকোজি এবং ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদে উপস্থিত ছিলেন।
একটি অবাধ, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিকের বিষয়ে নিজেদের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি এবং প্যারিসের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। ইউরোপ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক উভয় ক্ষেত্রেই বড় ভূ-রাজনৈতিক মন্থনের সম্মুখীন হয়ে দু’টি দেশ কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে এবং ভারত ও ফ্রান্সের জন্য আরও ঘনিষ্ঠ কৌশলগত কর্মসূচি অনুসরণ করার নেপথ্যে একটি মূল চালক হিসাবে ইন্দো-প্যাসিফিককে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি দুই দেশই এই ধরনের সংস্থাগুলিকে আরও প্রতিনিধিত্বমূলক ও কার্যকর করে তোলার মাধ্যমে বহুপাক্ষিকতা এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য জোর দিয়েছে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্যারিস সফরের সময় প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিটি প্রকৃতপক্ষে ‘অভিন্ন মূল্যবোধ, সার্বভৌমত্ব এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অটুট প্রতিশ্রুতি ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ, বহুপাক্ষিকতার প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং একটি স্থিতিশীল বহুমুখী বিশ্বের জন্য এক সাধারণ অনুসন্ধান’-এর কথাই দর্শায়।
ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফরের সংখ্যা আসলে একে অপরকে গুরুত্ব প্রদর্শন করার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। মোদী ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ফরাসি জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। ভারত-ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনের সময়ে এই সফরটি ছিল আর একটি উপলক্ষ্য। যদি দুই পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত নথিগুলির উপর এক বার দ্রুত নজর বুলিয়ে নেওয়া যায়, তা হলে সফরটিকে একটি বড় সাফল্য বলেই মনে করা হবে। দুই পক্ষই ভারত-ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনে একটি যৌথ বিবৃতি অর্থাৎ হরাইজন ২০৪৭-সহ বেশ কিছু নথিপত্র প্রকাশ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টুওয়ার্ডস আ সেঞ্চুরি অফ ইন্ডিয়া-ফ্রান্স রিলেশনস, একগুচ্ছ ফলাফলের একটি তালিকা এবং ভারত-ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিক রোডম্যাপ বা পথনির্দেশিকা। তার পরে ম্যাক্রোঁ সেপ্টেম্বর মাসে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ভারতে আসেন যখন দুই নেতা গ্রীষ্মে স্বাক্ষরিত নানাবিধ চুক্তির পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেন।
ভারত এবং ফ্রান্স বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, প্রতিরক্ষা এবং মহাকাশ-সহ সব কৌশলগত ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতার নিরিখে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদার এবং সেই বিষয়গুলি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আলোচনাতেও উঠে এসেছে। দু’জনই বিশেষ ভাবে আলোচনা করেছেন যে, কী ভাবে দুই দেশ শিল্প ও স্টার্ট-আপে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারে, বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিতে, ছোট মডিউলার রিঅ্যাক্টরের যৌথ উৎপাদন এবং ডিজিটাল গণ অবকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, সংযোগ, জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে।
ফ্রান্স ভারতের সমগ্র রাজনৈতিক পরিসর এবং বৃহত্তর জনমানসে নিঃশর্ত সমর্থন পেয়েছে, যা ভারত সরকারকে কোনও বাধা ছাড়াই এই ধরনের অংশীদারিত্বের পথে হাঁটতে সাহায্য করে, তা বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্র হোক বা প্রচলিত প্রতিরক্ষা পরিসর।
প্রকৃতপক্ষে, এর নেপথ্যে থেকেছে ইতিহাসের সঙ্কটময় সময়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের পাওয়া দৃঢ় সমর্থন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারত এবং ফ্রান্স নিজেদের অংশীদারিত্বকে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার কয়েক মাস পরে ভারত তার প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা নিন্দিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন সহ একাধিক দেশ ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু সে সময়ে ফ্রান্স ভারতের নিন্দা করেনি বা ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়নি। এ সব কথা নয়াদিল্লি দীর্ঘদিন মনে রাখবে।
তাই ভারতের কৌশলগত গণনার মধ্যে ফ্রান্সকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। এবং মোহাম্মদ জিশান যেমন গত বছরের জুলাই মাসে লিখেছিলেন, ‘যদি ভারতের কোনও প্রকৃত মিত্র থাকে, তবে তা সম্ভবত ফ্রান্স।’ তর্কসাপেক্ষে কোনও ইতিহাসের বোঝা ব্যতিরেকেই জাপান দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জিশান ভারত মহাসাগরে উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের নিরিখে মধ্যম শক্তি হিসাবে ফ্রান্সের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেছেন: ‘ভারতের অগ্রাধিকারমূলক প্রতিরক্ষা অংশীদার হওয়ার জন্য ফ্রান্সের শক্তি ও দুর্বলতার এক যথার্থ সংমিশ্রণ রয়েছে।’
এমনকি জুলাই মাসে মোদীর সফরের সময় প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতামূলক কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক দিকে যখন রুশ অস্ত্রের অপ্রতুলতা ও অন্য দিকে ভারতের আরও অস্ত্র ও মঞ্চের প্রয়োজন প্রকাশ্যে উঠে এসেছে, তখন নিজের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য অংশীদার পরিসরে বৈচিত্র্য আনার ভারতীয় প্রচেষ্টার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে ফ্রান্স।
ক্ষমতার রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল ভারসাম্যের মধ্যে চিনের আগ্রাসী এবং লোভনীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি ফ্রান্স-ভারত সম্পর্ককে চিরকালীন দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছে। যাই হোক, এ কথাও উল্লেখ করা উচিত যে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে দুই দেশের মধ্যে কিছু মতপার্থক্যও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স ইউক্রেনের একটি শক্তিশালী সমর্থক এবং ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই ভাবে ফ্রান্স চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। এগুলি সম্ভবত নয়াদিল্লি এবং প্যারিসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না, সে কথা স্পষ্ট হলেও বিষয়গুলির উপর ভারতের নজর দেওয়া উচিত।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.